চীন-রাশিয়ার যৌথ মহড়া থেকে কী বার্তা পেল বিশ্ব

-

  • মুরশিদুল আলম চৌধুরী
  • ১৬ জানুয়ারি ২০২১, ১০:২৪

সম্প্রতি জাপান সাগর ও পূর্ব চীন সাগরে চীন ও রাশিয়ার বিমানবাহিনীর যৌথ মহড়া থেকে বড় একটি ভূরাজনৈতিক বার্তা পেয়েছে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল। চীনা বিশেষজ্ঞরা আভাস দিয়েছেন, আগামীতে এ ধরনের মহড়া নিয়মিতভাবে চলতে পারে।

দুই দেশের কৌশলগত বোমারু বিমানগুলো এ মহড়ায় অংশ নেয়। এক বছরের মধ্যে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে দ্বিতীয়বার এ ধরনের মহড়া হলো। রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, রাশিয়ার দুইটি টিইউ-৯৫এমএস এবং চীনের চারটি এইচ-৬কে বোমারু বিমান এ মহড়ায় অংশ নেয়।

বিবৃতিতে বলা হয়, তৃতীয় কোনো দেশকে টার্গেট করে নয়, বরং দুই দেশের মধ্যকার সামরিক সহযোগিতা চুক্তির অংশ হিসেবে এ মহড়া চালানো হয়েছে। এ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইনও কঠোরভাবে মেনে চলেছে দুই দেশ।

চীন ও রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, বার্ষিক সামরিক সহযোগিতা পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এ যৌথ মহড়া সম্পন্ন হলো। এতে বলা হয়, সমন্বিত কৌশলগত অংশিদারিত্ব আরও গতিশীল করতে এ মহড়া। এর মাধ্যমে বৈশি^ক স্থিতিশীলতা রক্ষায় দুই দেশের যৌথ পরিচালন সক্ষমতা বাড়বে।

এর কেবল এক মাস আগে, রাশিয়ার দুটি ক্ষেপণাস্ত্র-বহনকারী বোমারু বিমান টিউপোলেভ টিইউ-৯৫এমএস জাপান সাগর ও উত্তরপশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের নিরপেক্ষ জলসীমায় আট ঘণ্টা উড়তে থাকে। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, এ রুটের কিছু কিছু স্থানে এ বোমারু বিমান দুটিকে সঙ্গ দিয়েছে এসইউ-৩৫এস যুদ্ধবিমান।

এটা পরিষ্কার যে, রাশিয়ার জাতীয় প্রতিরক্ষা দৃষ্টিকোণ থেকে চীনের সঙ্গে এ মহড়া যে খুব আবশ্যিক ছিল, তা নয়। তবে প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে দেখানোর একটা বিষয় থাকে, এখানে সেটা করা হয়েছে এবং সঙ্গে একটা বার্তাও পাঠানো হয়েছে। এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র ও এর অংশীদারদের বিভিন্ন পদক্ষেপের পরিপ্রেক্ষিতে আঞ্চলিক রাজনীতির সঙ্গে এ যৌথ মহড়া অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।

সম্প্রতি মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্রবাহী যুদ্ধজাহাজ ইউএসএস মাস্টিন তাইওয়ান প্রণালী অতিক্রম করে। এরপর চীনের মূল ভূখণ্ডের প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দূরে প্রাতাস দ্বীপপুঞ্জে ‘লাইভ ফায়ার ড্রিল’ পরিচালনা করে তাইওয়ান। প্রাতাসের প্রধান দ্বীপটি দক্ষিণ চীন সাগরের প্রবেশদ্বারের কাছাকাছি অবস্থিত। প্রশান্ত মহাসাগরে যাওয়ার পথে তেলের ট্যাঙ্কার ও চীনা জাহাজগুলো এখানে যাত্রাবিরতি করে।

এ প্রণালীতে মার্কিন যুদ্ধজাহাজের উপস্থিতিতে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এক বিবৃতিতে চীন জানিয়েছে, প্রণালী পার হওয়ার পুরো সময়জুড়ে তাদের বিমান ও নৌবাহিনী যুক্তরাষ্ট্রের জাহাজটিকে ‘অনুসরণ ও পর্যবেক্ষণ’ করেছে। এতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র শক্তি প্রদর্শন করছে এবং তাইওয়ানকে নিজেদের স্বার্থে দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক আইন মেনেই তাদের নিয়ন্ত্রিত জাহাজটি এ পথ পাড়ি দিয়েছে।

কদিন আগে প্রথম মিসাইল করভেটের উদ্বোধন করে তাইওয়ান। তাইওয়ানের সংবাদমাধ্যম এটিকে ‘এয়ারক্রাফট-ক্যারিয়ার কিলার’ হিসেবে বর্ণনা করেছে। ঠিক একই সময়ে চীনের বিমানবাহী রণতরী শানডং বোহাই সাগরে ২৩ দিনের সফর সম্পন্ন করে।

এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে ইউএসএস ম্যাকিন আইল্যান্ড এবং ইউএসএস সোমারসেট নিয়ে মার্কিন নৌবাহিনীর ‘অ্যামফিবিয়াস রেডি গ্রুপ’ সংক্ষেপে এআরজি দক্ষিণ চীন সাগরে মহড়া করে এবং ‘লাইভ-ফায়ার ড্রিল’ পরিচালনা করে।

চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদপত্র গ্লোবাল টাইম এতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে লিখেছে, এআরজি হলো যুক্তরাষ্ট্রের পেশী সবল করার পদক্ষেপ। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ভেঙে দিতে পারে গ্রুপটি। পত্রিকাটি মন্তব্য করেছে, হোয়াইট হাউজে কে এলেন এটা দেখার বিষয় নয়, চীনের উচিত দক্ষিণ চীন সাগর এবং তাইওয়ান প্রণালীতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সঙ্ঘাতে যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া।

জাপানও তৎপর। ফারইস্টে সমমনা পশ্চিমা দেশগুলোকে মিলিটারি ইউনিট পাঠানোর অনুরোধ করেছে দেশটি। আভাস মিলেছে, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলকে অবাধ ও মুক্ত রাখতে তারা একতাবদ্ধ।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও জাপানের নৌবাহিনী ফিলিপাইন সাগরে যৌথ মহড়া চালিয়েছে। সাবমেরিন বিধ্বংসী জাহাজগুলো অংশ নেয় এ মহড়ায়। নতুন বছরের মাঝামাঝি জাপানের দূরবর্তী একটি দ্বীপে এ ধরনের আরেকটি মহড়ার পরিকল্পনা রয়েছে দেশগুলোর। বছরের শুরুতে মার্কিন নৌবাহিনী ও জাপানিজ মেরিটাইম সেলফ-ডিফেন্স ফোর্সের সঙ্গে যৌথ মহড়ায় একটি এয়ারক্রাফট-ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপ পাঠানোর পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে যুক্তরাজ্য।

জাপানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী নবু তিশি সম্প্রতি জার্মান প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠকে তিনি এ মহড়ায় একটি জার্মান জাহাজের অংশগ্রহণ চেয়েছেন। নবু তিশি বলেন, দক্ষিণ চীন সাগর হয়ে জাহাজের যাতায়াতের অধিকার নিশ্চিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, এ জলসীমা অতিক্রম করে জার্মানির জাহাজ মহড়ায় যুক্ত হলে এ চেষ্টা গতিশীল হবে।

এর পরিস্থিতিতে মার্কিন নেভাল সার্ভিস একটি সমন্বিত সমুদ্র কৌশল প্রণয়ন করেছে, যেখানে চীনের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতায় জয় করায়ত্ত করতে আরও আগ্রাসী পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। মার্কিন সেক্রেটারি অব দ্য নেভি কেনেথ ব্রেইথওয়েটও ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যে আড়াআড়ি পথ পুনঃপ্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছেন।

এদিকে, ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনকে মোকাবিলা করতে অস্ট্রেলিয়া, ভারত, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত জোট ‘কোয়াড’ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি টোকিওতে কোয়াডভুক্ত দেশগুলোর প্রতিনিধিরা বৈঠক করেছেন এবং সেখানে তারা এ অঞ্চলের নিরাপত্তা বিধানে বহুপক্ষীয় সুরক্ষাবলয় গঠনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন। বৈঠকে বলা হয়েছে, এশিয়ায় ন্যাটোর একটি ছোট সংস্করণ হিসেবে এটি কাজ করবে না, তবে এ অঞ্চলে যার যার সার্বভৌমত্ব, নৌচলাচলের স্বাধীনতা, সীমানাসংক্রান্ত স্বাধীনতা, অবাধ বাণিজ্য ইত্যাদি নিশ্চিত করার জন্য কোয়াড কাজ করে যাচ্ছে।

কোয়াডের এসব লক্ষ্যের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে চীন। দেশগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়, চীন থেকে উদ্ভূত করোনা মহামারিতে বিশ্ব যখন টালমাটাল, ঠিক সেই সময় চীনের আগ্রাসী আচরণ কোয়াডকে আঞ্চলিক নিরাপত্তার বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঐকমত্যে পৌঁছাতে আগ্রহী করেছে। ‘অবাধ ও মুক্ত ভারতীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল’ গঠনের ডাক দিয়ে ২০১৬ সালে জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে প্রথম কোয়াডের ধারণা দিয়েছিলেন এবং পরে যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে আসায় সেটি দ্রুতই একটি সক্রিয় জোট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল নিয়ে নতুন মার্কিন প্রশাসনের পদক্ষেপ কী হবে, তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। জো বাইডেন এ পর্যন্ত ‘কুয়াড্রিলেটারাল সিকিউরিটি ডায়ালগ’ শব্দগুলো উল্লেখ না করলেও ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’ শব্দযুগল উল্লেখ করেছেন। এ অঞ্চল নিয়ে ‘ফ্রি অ্যান্ড ওপেন’ শব্দগুলো উল্লেখ করার পরিবর্তে তিনি বলেছেন, ‘সিকিউর অ্যান্ড প্রোসপেরাস’।

এ প্রেক্ষাপটে মার্কিন নেতৃত্বাধীন শক্তিগুলোকে কোনো সুযোগ দিতে চায় না চীন ও রাশিয়া। জাপান সাগর ও পূর্ব চীন সাগরে চীন ও রাশিয়ার বিমানবাহিনীর যৌথ মহড়া একই উদ্বেগেরই প্রতিফলন। দেশ দুটি বলেছে, অঞ্চল-বহির্ভূত শক্তিগুলোর ক্রমবর্ধমান হস্তক্ষেপ সঙ্ঘাতের উস্কানি ছাড়া আর কিছু নয় এবং তাদের এ ধরনের উপস্থিতি আঞ্চলিক শান্তির জন্য বড় ধরনের হুমকি।

বিখ্যাত গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ইনস্টিটিউট অব রাশিয়ান, ইস্টার্ন ইউরোপিয়ান অ্যান্ড সেন্ট্রাল এশিয়ান স্টাডিজ’-এর গবেষক ইয়াঙ জিনের মতে, এ যৌথ মহড়ার মাধ্যমে চীন ও রাশিয়া জানাতে চায়, এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল ও ইউরেশিয়ার শান্তি ও স্থিতিশীলতার অপরিহার্য উপাদান তারা। যেসব বহিরাগত শক্তি আঞ্চলিক নিরাপত্তাকে হুমকিতে ফেলতে চায়, তাদের কর্মকাণ্ডই এ যৌথ মহড়ায় দেশ দুটিকে বাধ্য করেছে।

ইয়াংকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র কিংবা অন্য দেশগুলো যদি যুদ্ধে যেতে চায়, এ ধরনের চরম পরিস্থিতিতে সর্বশেষ অপশন হিসেবে চীন এবং রাশিয়া পাশাপাশি থেকে তা মোকাবিলা করবে।

গ্লোবাল টাইমসের সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, সামরিক জোট গঠনের অভিপ্রায় নেই চীন ও রাশিয়ার। তবে, যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের চাপের মুখে সামরিক সহযোগিতাসহ সমন্বিত কৌশলগত সহযোগিতা মজবুত করতে হবে তাদের।

সম্পাদকীয়তে বলা হয়, কৌশলগত সহযোগী হয়ে যৌথভাবে চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে কাজ করলে দেশ দুটি কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে, সুনির্দিষ্ট সমস্যা নিয়ে কাজ করতে একটি যৌথবাহিনী গঠন করতে পারবে, দেশদুটিকে চাপে ফেলার চেষ্টা প্রতিহত করতে পারবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের উটকো নাক গলানো প্রতিহত করতে পারবে।

ওয়াশিংটন যদি জাতীয় নিরাপত্তার জন্য রাশিয়াকে বৃহত্তম হুমকি হিসেবে দেখে, নিশ্চিতভাবে বাইডেনের অধীনে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া-চীন ত্রিভুজের আকার বদলে যাবে। চীন তো আভাস দিয়েই রেখেছে, বাইডেন বেইজিংয়ের সঙ্গে উত্তেজনা কমালেও চীন-রাশিয়া কৌশলগত অংশীদারিত্ব ঘনিষ্ঠ থাকবে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান চাপ সামাল দিতে এ ঘনিষ্ঠতা আরও মজবুত হবে।

একদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা এ অঞ্চলে প্রভাব ধরে রাখার জন্য আটঘাট বেঁধে নেমেছে, অন্যদিকে এ চেষ্টা প্রতিহত করতে অভেদ্য সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছে চীন ও রাশিয়া। এ উত্তেজনা কোথায় গিয়ে থামবে, সময়ই তা বলে দেবে।