চীনের নতুন এন্টিস্টিলথ রাডারে যা থাকছে

এন্টি স্টিলথ রাডার চীনই প্রথম বানালো এমন নয় - ইন্টারনেট

  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ১৭ ডিসেম্বর ২০২০, ১০:৫১

শত্রুর চোখে অদৃশ্য হয়ে থাকতে পারার কারনেই মার্কিন বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান লকহিড মার্টিনের এফ-টোয়েন্টি টু এবং এফ-থার্টি ফাইভ বিমানগুলোর চাহিদা বাড়ছে। বিশ্বজুড়ে এই যুদ্ধ বিমানগুলো দৃষ্টি আকর্ষন করছে। কিন্তু মার্কিন বিমান প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে বড় ধরনের দু:সংবাদ নিয়ে এসেছে চীন। দেশটির সামরিক বিশ্লেষকরা দাবি করছেন, চীন এমন একটি মিটার ওয়েভ এন্টি স্টেলথ রাডার আবিস্কার করেছে যা দিয়ে এডভান্সড প্রযুক্তির স্টেলথ বিমানও সনাক্ত করা সম্ভব হবে। শুধু তাই নয়, এ রাডার দিয়েই স্টেলথ বিমানগুলোকে লক্ষ্য করে মিসাইলও নিক্ষেপ করা যাবে।

চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চায়না ইলেক্ট্রনিক্স টেকনোলোজি গ্রুপ কর্পোরেশনের সিনিয়র সাইন্টিস্ট উ জিয়াংকি গ্লোবাল টাইমসকে জানিয়েছেন মিটার ওয়েভ ধরনের এ রাডারটি যেকোনো যানবাহনের ওপর, ভূমিতে কিংবা যুদ্ধজাহাজে ওপর সহজেই স্থাপন করা যায়। এ রাডারটি এমন শক্ত ধরনের জাল তৈরি করে যার নজর থেকে প্রতিপক্ষের স্টেলথ বিমানগুলো কোনোভাবেই নিস্তার পায় না।

বর্তমান সময়ের স্টেলথ বিমানগুলোকে এমনভাবে নির্মাণ করা হয় যাতে মাইক্রোওয়েভ ধরনের রাডারের দৃষ্টি থেকে তা এড়িয়ে চলতে পারে। কিন্তু চীন মিটারওয়েভ ধরনের রাডার দিয়ে এ ধারণাকে ভুল প্রমাণ করেছে। যদিও আগে ধারণা করা হতো যে, মিটার ওয়েভগুলো এর অল্প রিসোলিউশনের কারণে শুধুমাত্র হুমকি সম্পর্কে সতর্কবার্তা দিতে পারে, এর বেশি কিছু নয়।

সাধারণ যে হাই ফ্রিকোয়েন্সি রাডারগুলো থাকে তা দিয়েও একটি নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত স্টেলথ বিমানগুলোকে সনাক্ত করা যায়। এছাড়া এর রিপিটিশন ফ্রিকোয়েন্সিও অনেক কম। হাই ফ্রিকোয়েন্সি রাডার দিয়ে একেবারে নিখুঁতভাবে টার্গেটের দুরত্ব ও অবস্থান নির্নয় করা যায় না। বড়োজোড় একটি নির্দিষ্ট এলাকার এয়ারস্পেসে প্রতিপক্ষের কোনো বিমান চলে আসলে এ রাডারগুলো দিয়ে তার সেন্সরকে অনুভব করা যায়।

এ সীমাবদ্ধতা দূর করার জন্যই উ জিয়াংকির নেতৃত্বে একটি দল গবেষণা শুরু করে। আর এ টিমের হাত দিয়েই চীন প্রথমবারের মতো একটি মিটারওয়েভ স্পারসে সিনথেটিক ইমপালস রাডার তৈরি করতে পেরেছে। এ রাডারগুলো প্রতিপক্ষের বিমান অনেক ওপরে থাকা অবস্থাতেই তার যাবতীয় ডাটা পাওয়া যাবে। এ রাডারগুলো একইসঙ্গে সেন্সরে পাওয়া তথ্যগুলোকে তাৎক্ষনিকভাবে হেডকোয়ার্টারেও পাঠিয়ে দিতে সক্ষম হবে। কোনো একটি দিক থেকে নয়, বরং সকল দিক থেকে একই সময়ে এ রাডারগুলোর সেন্সর ইকো গ্রহণ করতে পারবে।

আরেক চীনা সামরিক বিশেষজ্ঞ ওয়েই দোংজু বলেন, এ রাডারটি এরিয়াল টার্গেটকে সনাক্ত করতে সাহায্য করবে। এ রাডারে সিনথেসাইজিং প্যারামিটার আছে যা দিয়ে স্টেলথ বিমানকে সনাক্ত করা যায়। রাডারটি মূলত এডভান্সড এলগোরিদমের আকারে তথ্যগুলো সংগ্রহ করে। যেহেতু এ রাডারগুলো পরিস্কারভাবে স্টেলথ বিমানকে দেখতে পারে এবং প্রতিনিয়ত তাদেরকে যথাযথভাবে অনুসরণও করতে পারে তাই ভূমি বা আকাশ থেকে টার্গেটকে দূর পাল্লার মিসাইল নিক্ষেপের ক্ষেত্রেও ত ভূমিকা রাখতে পারে।

এন্টি স্টিলথ রাডার চীনই প্রথম বানালো এমন নয়। ২০১৮ সালে রাশিয়া পি-এইটিন-টু নামের একটি রাডার নির্মান করে। এটি ছিল সাবেক সেভিয়েত আমলের পি-এইটিনের উন্নত সংস্করণ। রাশিয়ার তৈরি এ রাডার দিয়ে নজরদারি করা যায় এবং স্টেলথ প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রতিপক্ষের টার্গেট সনাক্তও করা যায়। পি-এইটিন-টুকে খুব সহজে স্থানান্তর করা যায় এবং এ রাডারটি দিয়ে ইন্টেগরেটেড সেকেন্ডারি প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিমান চালনার তথ্যও সংগ্রহ করা যায়।

রাশিয়ার সামরিক অস্ত্র ও প্রযুক্তি আমদানি ও রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান রসোবর্ন এক্সপোর্ট এ রাডারটির নির্মাতা। এ রাডারটিকে হাই ফ্রিকোয়েন্সি রাডার হিসেবে দাবি ককরা হয়। এ রাডার দিয়ে সনাক্ত করা, মূল ঘাটির সাথে সমন্বয়করণ, দূরত্ব ও দ্রাঘিমাংশ পরিমাপ করা, আকাশে ভাসমান বিভিন্ন বস্তুকে আলাদা আলাদাভাবে সনাক্ত করা এবং পরোক্ষভাবে জ্যামও সৃষ্টি করা যায়। তবে, এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যে মনে হচ্ছে, রাশিয়ার এ রাডারের চেয়েও চীনের আবিস্কৃত মিটারওয়েভ রাডারটি অনেক বেশি কার্যকর। এদিক দিয়ে চীন এখন বিশ্বে অন্য সব দেশের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

এবার আসা যাক চীন ও ভারত প্রসঙ্গে। ভারত ও চীনের সামরিক কর্মকর্তা ও দু দেশের সীমান্তে উত্তেজনা কমাতে আলোচনা চালিয়ে গেলেও পাংগং লেক এলাকায় চীন সামরিক শক্তি বাড়িয়েছে। আবার ভারত-মিয়ানমার সীমান্তে হঠাৎ করে চীনা অস্ত্র বিশেষ করে চীনের তৈরি একে ফর্টি সেভেন, এম সিক্সটিন এবং চীনা পিস্তলের ব্যবহার বাড়ছে। ভুটান সীমান্তের প্রায় দুই কিলোমিটার ভেতরে এসে চীন নিজেদের মতো করে সশস্ত্র কার্যক্রম চালাচ্ছে বলেও ভারতীয় গনমাধ্যম দাবি করেছে।

ভারতীয় গনমাধ্যম দাবি করা হয়েছে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে পাকিস্তাানের সম্পর্ক সাম্প্রতিক সময়ে একটু নাজুক হওয়ায় চীনের ওপর পাকিস্তানের নির্ভরতা আরো বেড়েছে। আর পাকিস্তানের প্ররোচণাতেই চীন এখন ভারতের সাথে বিভিন্ন সীমান্তে তার সামরিক কার্যক্রম বৃদ্ধি করেছে।

মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট সম্প্রতি একটি প্রতিবেদনে জানিয়েছে, চীনা কর্তৃপক্ষ এখন ভারতকে প্রতিদ্বন্দী ভাবতেও শুরু করেছে। চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি সম্প্রতি কিজিল জিলগা এলাকাতেও তার সেনা মোতায়েন বাড়িয়েছে। এ এলাকাটি দৌলত বেগ ওলডি থেকে ৭০ কিলোমিটার পূর্বে। কৌশলগত দিক দিয়ে ভারতের জন্য এ এলাকাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চীনা ট্যাংকের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে গোবাকেও। যেখান থেকে লাইন অব কন্ট্রোলের দুরত্ব ৬০ কিলোমিটার।

চীনা মোতায়েনকৃত সেনাদেরকে এমন কিছু অস্ত্র দেয়া হয়েছে যা বিশ্বের অনেক দেশ এখনো চোখেই দেখেনি। এ সেনাদেরকে ডিরেক্টেড এনার্জি উইপন ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে চীন ও ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে যথেষ্ট অনাস্থা তৈরি হয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকর বলেছেন, ভারতের সাথে চীনের সম্পর্ক রয়েছে তবে সে সম্পর্কে যথেষ্ট উত্তেজনা ও উৎকন্ঠাও রয়েছে। ২০২২ সালের মধ্যে চীন আশপাশের অনেক এলাকাতেই নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় বেশকিছু পরিকল্পনাও প্রনয়ন করেছে।

চীন একদিকে ভারত সীমান্তে সামরিক অবস্থান সংহত করছে অন্যদিকে ভারতের অর্থনৈতিক দুঃসময়ের জন্যেও অপেক্ষা করছে। করোনা পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে যদি ভারত আরো বিপর্যয়ের মুখে পড়ে যায় তাহলে চীন সে সুযোগটি নিতেও পারে বলে বিশ্লেষকরা আশংকা করছেন।

এত সব খবরের মাঝে ভারতের টাইমস নাও একটি প্রতিবেদনে জানিয়েছে চীন স¤প্রতি সিক্স টাইপ নাইনটুএইট ডি এসল্ট নৌযানগুলোকে পাংগং লেকে মোতায়েন করতে শুরু করেছে। এ ধরনের প্রতিটি নৌকায় ১০ জন সেনাকে তাদের অস্ত্র ও বোমাসহ বহন করা যায়। সীমানার খুব নিকট দিয়ে চীনা নৌযানগুলো যাতায়াত শুরু করায় ভারতীয় সেনাবাহিনীতে চাপা উদ্বেগও দেখা দিয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, পূর্ব লাদাখের পাংগং লেকের নিকটে ভারত স¤প্রতি এলিট মেরিন কমান্ডোদেরকে মোতায়েন করায় চীনা নৌবাহিনীও সক্রিয় হয়েছে।

ভারত বলছে, গত এপ্রিল-মে মাস থেকে চীনের সাথে যে উত্তেজনা চলছে তার অংশ হিসেবেই তারা পাংগংয়ে এলিট নৌ কমান্ডোকে মোতায়েন করেছে। ভারতের এসব কমান্ডোদেরকেও উন্নত নৌযান এবং লেকে অপারেশন চালানোর মতো পর্যাপ্ত সমরাস্ত্র দেয়া হয়েছে। এর আগে মার্কিন নিরাপত্তা বিভাগের একজন কর্মকর্তাও আভাস দিয়েছিলেন যে, চীন গালওয়ান উপত্যাকায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে সংঘাতের পরিকল্পনা করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস-চায়না ইকোনোমিক এন্ড সিকিউরিটি রিভিউ কমিশন, ইউএসসিসি তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে আরো জানায়, সর্বশেষ যুদ্ধে চীনারা ভারতের ২০ জন সেনাকে হত্যা করতে সক্ষম হয়েছে। যদিও সে সংঘাতে চীনের কেউ নিহত হওয়ার খবর মার্কিনীরাও নিশ্চিত করতে পারেনি।

ইউএসসিসি তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনও কংগ্রেসে জমা দিয়েছে। এর মাধ্যমে তারা কংগ্রেসকে অবহিত করতে চেয়েছে যে, লাইন অব এ্যাকচুয়াল কন্ট্রোলকে কেন্দ্র করে চীন ভারতের সাথে ঝামেলা পাকাতে চাইছে, যা পরবর্তীতে সামরিক সংঘাতেও রূপ নিতে পারে।

এখন পর্যন্ত স্যাটেলাইটে পাওয়া তথ্য ও ছবি থেকে দেখা যাচ্ছে, চীন এখনো ভারতীয় সীমান্তে সেনা মোতায়েন অব্যহত রেখেছে। মে মাসে যখন সর্বশেষ দুই দেশের মধ্যে সংঘাত হয়, তখনো চীন তার পিপলস লিবারেশন আর্মিও ১ হাজার প্রশিক্ষিত সদস্যকেও লাদাখে মোতায়েন করেছিল বলে মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদনে জানানো হয়।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে