প্রযুক্তি, কৌশল আর তুরস্ক জিতিয়ে দিলো আজারবাইজানকে

এই যুদ্ধে আজারবাইজান হারানো ভূখন্ড উদ্ধার করে লাভবান হয়েছে - ইন্টারনেট

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ১৯ নভেম্বর ২০২০, ১৪:০৪

১৯৯০এর দশকের গোড়ার দিকে নগর্ণো-কারাবাখ নিয়ে আরো একবার যুদ্ধ হয়েছিল আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের। ওই যুদ্ধে হেরে যায় আজারবাইজান। আর্মেনিয়া দখল করে নেয় সাত জেলার সমন্বয়ে গঠিত নগর্ণো-কারাবাখ অঞ্চল। সদ্যসমাপ্ত যুদ্ধে সেই অঞ্চল মাত্র ৪৩ দিনে পুনর্দখল করে নেয় আজারবাইজান। বিডি ভিউজ ইনফোটেইনমেন্টে স্বাগত জানাচ্ছি আমি সাবরিনা কাজী। সবার মনে প্রশ্ন, আগের যুদ্ধে আজারবাইজান যেখানে গো হারা হেরে গিয়েছিল, এবার সেখানে কী করে অনেকটা সহজে জয়ী হলো? এই প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

সমর বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এই সময়ে যুদ্ধের ময়দানে আজারবাইজানের এমন সাফল্যের পেছনে কাজ করেছে তিনটি ফ্যাক্টর : প্রযুক্তি, কৌশল ও তুরস্ক। একজন রিসার্চ অ্যানালিস্ট একেবারে খোলাখুলিই বলেন, আজারবাইজানের প্রতি তুরস্কের সমর্থনই আগের সংঘাতের সাথে এবারের যুদ্ধের গুণগত পার্থক্য গড়ে দিয়েছে।

তার মতে, আজারবাইজানের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগর গাঞ্জা-র একটি সামরিক বিমানক্ষেত্রে তুরস্কের এফ-১৬ জঙ্গি জেট বিমানের উপস্থিতিই ''সুস্পষ্টভাবে নিশ্চিত'' করে দেয় যে, দক্ষিণ ককেসাস অঞ্চলের জিও-পলিটিক্যাল ব্যালান্স এখন আজারবাইজানের অনুকূলে।

এই অনুকূল পরিবেশের পেছনে কাজ করেছে উন্নততর অস্ত্র প্রযুক্তি। আর্মেনিয়ার সাথে যুদ্ধে নিজেদের কত সৈন্য নিহত হয়েছে, আজারবাইজান তা প্রকাশ না-করলেও বিমান হামলা ও রণাঙ্গন পরিদর্শনের কাজে সর্বাধুনিক ড্রোন ব্যবহারের কথা তারা লুকায়নি। এসব ড্রোন তারা সংগহ করেছে তুরস্ক ও ইসরাইল থেকে।

গত ২৭ সেপ্টেম্বর যুদ্ধ শুরুর পর আজারবাইজানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় রণাঙ্গনের কিছু ফুটেজ প্রকাশ করে। তাতে দেখা যায় তাদের চালকবিহীন আকাশযানগুলো কিভাবে শত্রুর ট্যাংক, আর্টিলারি, গ্রাউন্ড ফোরটিফিকেশন এবং এমনকি রাশিয়ার নির্মিত এস-৩০০ বিমানবিধ্বংসী মিসাইল সিস্টেম পর্যন্ত ধ্বংস করে ফেলছে।

১৯৯২-৯৪ সালের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন এমন এক আর্মেনীয় নারী যোদ্ধা মারগারিটা কারামিয়ান বলেন, এবারের যুদ্ধের শুরুতেই যখন দেখলাম ৩০টির মতো আজারবাইজানী ড্রোন এসে নগর্ণো-কারাবাখের দক্ষিণপূর্বাঞ্চলের ''আকাশ অন্ধকার'' করে ফেলেছে , তখন আমি যেন কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেললাম। চালকবিহীন এসব বিমানের হামলা থেকে বাঁচতে আর্মেনিয়ার সৈন্যরা দ্রæত আত্মগোপন করার কৌশল নেয়। সত্যি বলতে কী, এবারের যুদ্ধটা আসলেই একটি ''অন্য রকম'' যুদ্ধ।

তুরস্কের ইস্তাম্বুলের একটি থিংকট্যাংকের এক বিশেষজ্ঞের মুখেও শোনা যায় ওই আর্মেনীয় নারী সৈনিকের কথার প্রতিধ্বনি। তিনি বলেন, আর্মেনীয় সৈন্যরা অবাক হয়ে দেখেছে যুদ্ধের ময়দানে আজারবাইজানীদের প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্ব। কারণ, আজারবাইজানীদের মানুষবিহীন আকাশযানকে টেক্কা দেয়ার মতো সেন্সর, ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার কভার অথবা ড্রোন ঠেকানোর মতো অস্ত্রব্যবস্থা - কিছুই তাদের হাতে ছিল না।

ওই তুর্কী বিশেষজ্ঞ বলেন, এবারের আজারবাইজান-আর্মেনিয়া যুদ্ধের শিক্ষা হলো, প্রাগ্রসর ড্রোন যুদ্ধাস্ত্রের সামনে প্রচলিত স্থলযুদ্ধের কোনো পদ্ধতিই দাঁড়াতে পারবে না, তা সে সাঁজোয়া, মেকানাইজড অথবা মোটোরাইজড - যে রকম ফরমেশনেই হোক না কেন। এর ফলে আর্মেনীয় বাহিনী দ্রæত তাদের অবস্থান থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়, যেখানে তারা ১৯৯৪ সালের যুদ্ধবিরতির পর থেকে অবস্থান করে আসছিল।

ওপেন সোর্স গোয়েন্দা সূত্র থেকে প্রকাশিত দলিলপত্র থেকে দেখা যায়, নগর্ণো-কারাবাখে এক মাসে ১৭৫টির মতো বড় সংঘর্ষে হেরেছে আরমেনীয়রা। কিভাবে সম্ভব হলো এটা, জানাতে গিয়ে আজারবাইজানের এক বিশ্লেষক জানান, আর কিছু নয়, প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্বই আজারবাইজানের গলায় পরিয়ে দিয়েছে জয়ের মালা।

তিনি আরো বলেন, রুশ নেতৃত্বাধীন কলেকটিভ সিকিউরিটি ট্রিটি অরগানাইজেশন বা সিএসটিও-র সদস্য হিসেবে আর্মেনিয়া কেবল রাশিয়ান অস্ত্রই পেতে পারে। তা তারা পেয়েছেও। আর্মেনিয়ার ৯০-৯৫ ভাগ অস্ত্রই রাশিয়ায় তৈরী। বিপরীতে আজারবাইজানের অস্ত্রভান্ডারের রয়েছে বৈচিত্র্য। তারা তুরস্ক ও ইসরাইলসহ বিভিন্ন দেশ থেকে অস্ত্র আমদানি করেছে। গত এক দশক ধরে তারা তাদের তেল ও গ্যাস রফতানির অর্থ দিয়ে ন্যাটো জোটের বিভিন্ন সদস্য দেশ থেকে অস্ত্র কিনেছে।

তিনি জানান, স্পেন থেকে আজারবাইজান কিনেছে রেডার জ্যামিং সিস্টেম, চেক প্রজাতন্ত্র থেকে ২০১৮ সালে কিনেছে সেলফ- প্রপেল্ড ডিএএনএ হুইটজার আর্টিলারি এবং অতিস¤প্রতি তুরস্কের কাছ থেকে কিনেছে বায়রাক্তার ড্রোন। এ ড্রোন তুরস্কের তৈরী করা চারটি এমএএম লেসার গাইডেড মিসাইল বহনে সক্ষম।

এসব মিসাইল লিবিয়া ও সিরিয়ায় ব্যবহৃত হয়েছে। দেখা গেছে, সব ধরনের রাশিয়ান অস্ত্রের বিরুদ্ধেই এগুলো বেশ কার্যকর। সিরিয়ায় দেখা গেছে, এসব ড্রোন খুব সহজেই এস-৩০০ এর মতো রুশ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ধ্বংস করতে সক্ষম। লিবিয়াতেও প্রায় দুই ডজন রুশ-নির্মিত প্যান্তসির১এস আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়েছে তুরস্কের বায়রাক্তার টিবি২ এবং আনকা-এস কমব্যাট ড্রোন।

সিরিয়া ও লিবিয়ায় তুর্কী ড্রোনের এমন সাফল্য রাশিয়ার ঘুম হারাম করে দিয়েছে। কারণ, এর আগে রাশিয়া তাদের ওই আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে বিশ্বের অন্যতম কার্যকর সিস্টেম বলে প্রচার করতো।

তবে আজারবাইজানের প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্ব কেবল তাদের কেনা কমব্যাট সারভেইল্যান্স ড্রোন দিয়ে আসেনি। তুরস্ক এ সময় তাদের পুরো রোবোটিক ওয়্যারফেয়ার ডকট্রিন এবং তা চালানোর পদ্ধতিও আজারবাইজানকে দেয়।

আজারবাইজান এবারের যুদ্ধে আরেক চালাকি করেছে। তা হলো, তারা প্রথমে ড্রোন আকৃতির কিছু জিনিস শত্রুর আকাশে ছেড়ে দেয়। আর্মেনীয়রা শত্রুর ড্রোন মনে করে সেগুলো ধ্বংস করতে এগিয়ে গেলে আরো ওপরে থাকা আজারবাইজানী নজরদারি বিমানগুলো শত্রুর অবস্থান বুঝে ফেলে এবং পাল্টা হামলায় তাদের ধ্বংস করে।

আজারবাইজানের এক বিখ্যাত যোদ্ধা বলেন, আজারবাইজানী যোদ্ধারা শুরুতেই নগর্ণো-কারাবাখের দক্ষিণাংশ দখল করে নেয় এবং শহরমুখী সব যোগাযোগব্যবস্থার ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। এতে শত্রুরা একরকম ফাঁদে পড়ে যায় এবং পালাতে বাধ্য হয়।

আফগানিস্তানে আমেরিকা ও ন্যাটো বাহিনী যে কৌশল প্রয়োগ করেছে, আর্মেনিয়ার সাথে যুদ্ধে আজারবাইজানও তা অনেক সময় প্রয়োগ করেছে। আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার এবারের যুদ্ধে প্রথাগত যুদ্ধের ধারনা অনেকখানি বদলে গেছে। যুদ্ধ ক্ষেত্রে আগেও ড্রোনের ব্যবহার হয়েছে। আফগানিস্তান ও সিরিয়ায় যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন থেকে ড্রোন ব্যবহার করে আসছে। কিন্তু যুদ্ধ ক্ষেত্রে খুব কম সংখ্যক সৈন্য পাঠিয়ে কিভাবে বিশাল এলাকা নিয়ন্ত্রনে নেয়া যায় তার প্রমান হয়েছে আজারবাইজান-আর্মেনিয়া যুদ্ধে। অবশ্য এর আগে লিবিয়াতেও জাতিসংঘ সমর্থিত সরকারের সমর্থনে তুরস্ক ড্রোন ব্যবহার করেছিলো। যুদ্ধবাজ নেতা খলিফা হাফতারের ত্রিপেলি দখলের স্বপ্ন ধুলিস্যাত হয়েছিলো।

সমর বিশেষজ্ঞার বলছেন আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান উভয় দেশই যুদ্ধ ক্ষেত্রে পূর্ন মাত্রায় সামরিক উপস্থিতি নিশ্চিত করেছিলো। আর্মেনিয়া যে মানুষ বিহীন ড্রোনের কাছে এতটা অসহায়ভাবে পরাজিত হবে তা ছিলো কল্পনার বাইরে। যুদ্ধের সময় ও পরে প্রকাশ হওয়া ভিডিওতে দেখা গেছে বহু আর্মেনীয় সৈন্য কিছু বুঝে উঠার আগে তাদের মাথার ওপর এসে পড়েছে তুর্কি ড্রোন। তারা যে নিরাপদে আশ্রয় নেবে এমন অবস্থার সুযোগ ছিলো না। যা আর্মেনিয়ার সৈন্যদের মনোবাল পুরোপুরি ভাবে ধ্বংস করে দিয়েছে।

অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন নাগারনো কারবাখের যুদ্ধ হয়েছে প্রযুক্তি আর মানুষের মাঝে। আজারবাইজানী স্পেশ্যাল ফোর্স তাঁদের বেশিরভাগ ট্রেইনিং নিয়েছে তুরস্ক ও পাকিস্তানের সামরিক একাডেমিগুলোতে। ওখানে শেখা অনেক কৌশল এবারের যুদ্ধে প্রয়োগ করতে দেখা গেছে। তাছাড়া আর্মেনিয়ার সাথে অতীতের দু'ট যুদ্ধের অভিজ্ঞতাও আজারবাইজানকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। এভাবে নিজেদের হারানো ভূখন্ড উদ্ধারের লক্ষ্যে দিনে দিনে প্রস্তুত হয়েছে আজারবাইজান। তাদের সংকল্প ও চেষ্টা এনে দিয়েছে বিজয়। এ ইতিহাস থেকে অনেক কিছু শিক্ষা নেয়ার আছে।

এই যুদ্ধে আজারবাইজান হারানো ভূখন্ড উদ্ধার করে লাভবান হয়েছে। কিন্তু তুরস্কের লাভ কম নয়। যুদ্ধ ক্ষেত্রে তুরস্কের ড্রোনশক্তি কতটা কার্যকর তার একটা প্রমান হয়ে গেছে। আগামি দিনে যুদ্ধে ড্রোনের ব্যবহার কোন পর্যায়ে যেতে পারে তার প্রদর্শনী হয়ে গেলো। নি:সন্দেহে তুর্কি ড্রোন যুদ্ধের গতিধারা বদলে দিয়েছে। বহু দেশকে এখন ভাবতে হচ্ছে নিরাপত্তার জন্য ড্রোন প্রযুক্তির ব্যবহার কতটা করতে হতে পারে।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে