বাইডেনের প্রতিরক্ষানীতি কেমন হবে

ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী জো বাইডেন নির্বাচনের আগে বিভিন্ন সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পে সমালোচনার পাশাপাশি নিজের মতামত তুলে ধরেছেন - পলিটিকো

  • আহমেদ বায়েজীদ
  • ১৪ নভেম্বর ২০২০, ১৩:৩২

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগেই প্রার্থীরা রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে নিজের অবস্থান প্রকাশ করে থাকেন। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হচ্ছে প্রতিরক্ষা খাত। ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী জো বাইডেন নির্বাচনের আগে বিভিন্ন সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পে সমালোচনার পাশাপাশি নিজের মতামত তুলে ধরেছেন।

এছাড়া ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সিনেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময়ও পাওয়া গেছে এ বিষয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি। নির্বাচনী প্রচারণায়ও জানিয়েছেন কিছু বিষয়।

প্রতিরক্ষা নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বাইডেনের মিল-অমিল দুটোই আছে। অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ, পারমাণবিক চুক্তি, বিদেশে যুদ্ধ নীতি, সমরাস্ত্র বিক্রি এগুলোই যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা নীতির মেরুদন্ড। এর মধ্যে আর্মস কন্ট্রোল বা অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ইস্যুতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে পুরোপুরিই বিপরীত মেরুতে অবস্থান বাইডেনের। ট্রাম্প রাশিয়ার সাথে পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি বাতিল করেছিলেন। এই চুক্তির ব্যাপারে বাইডেন ইতিবাচক মানসিকতা পোষণ করেন। তিনি ইতোমধ্যেই এই চুক্তি নবায়ন করার অঙ্গীকারও করেছেন এবং সেটি হবে রাশিয়ার প্রস্তাব অনুযায়ী কোন পূর্ব শর্ত ছাড়াই আরো অন্তত ৫ বছরের জন্য।
এছাড়া ইরানের সাথে পারমাণবিক চুক্তি নিয়েও বাইডেন একই রকম ইতিবাচক।

বারাক ওবামার সরকারের সময় যুক্তরাষ্ট্রসহ ছয় বিশ্বশক্তি ২০১৫ সালে এই চুক্তিটি করেছিল ইরানের সাথে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার পরই বাইডেন বলেছেন, চুক্তির শর্ত ঠিক মতো মানা হলে তিনি আবার এই চুক্তিতে ফিরতে চান। তার পরিকল্পনা যে কোন মূল্যে ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র প্রস্তুত করা থেকে বিরত রাখা।

এছাড়া ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন মার্কিন সেনাবাহিনীকে সঙ্ঘাতময় এলাকায় ল্যান্ডমাইন ব্যবহারের অনুমতিও দিয়েছিল। জো বাইডেন বলেছেন, এ সিদ্ধান্ত বেসামরিক লোকদের জীবন হুমকির মুখে ফেলেছে। তাই তিনি নির্বাচিত হলে অপ্রোয়োজনীয় এই আইনটি বদলে দেবেন।

পারমাণবিক অস্ত্রের বিষয়েও ট্রাম্পের নীতির সাথে মিলছে না জো বাইডেনের পরিকল্পনা। ট্রাম্প চেয়েছিলেন পারমাণবিক অস্ত্র ছোড়ার তিনটি মাধ্যম অর্থাৎ আকাশ, নৌ ও স্থল পদ্ধতিকে আধুনিকায়ন করতে। রাশিয়ার একটি অস্ত্রের মোকাবেলায় ট্রাম্প সাবমেরিনে মোতায়েন করেছিলেন ডবিøউ সেভেনটি সিক্স- টু পারমাণবিক ওয়ারহেড। এছাড়া পরিকল্পনা করেছিলেন সাবমেরিন থেকে ক্রুজ মিসাইল উৎক্ষেপণেরও। জো বাইডেন এই দুটি পদ্ধতিরই বিরোধী। পারমাণবিক আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালেস্টিক মিসাইল ফোর্স গড়ার পরিকল্পনাও বাইডেন বাতিল করে দিতে পারেন।

১৯৭০ সালের মিনিটম্যান থ্রি মিসাইল ফোর্স পাল্টে নতুন এই মিসাইল ফোর্স গড়ার পরিকল্পনা নিয়েছিল ট্রাম্পের প্রশাসন। এই পরিকল্পনা বাতিল করতে গেলে নানান দিক থেকে বাধার সম্মুখীন হতে পারেন বাইডেন। অবশ্য এ বিষয়ে তিনি স্পষ্ট কিছু বলেননি এখনো।

প্রতিরক্ষা বাজেটের ক্ষেত্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর বিস্তর অভিযোগ জো বাইডেনের। বাইডেন বলেন এক্ষেত্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প কোন আর্থিক শৃঙ্খলা রাখতে পারেননি। গত কয়েক বছরে এই ব্যয় নিয়মিত বাড়িয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। ২০১৮ সালে ছিলো ৭০০ বিলিয়ন ডলার, পরের বছর বেড়ে হয়েছে ৭১৬ বিলিয়ন ডলার আর চলতি বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বাজেট ৭৩৩ বিলিয়ন ডলার। তবে এই সময় ডোনাল্ড ট্রাম্প মহাশূন্য বাহিনী গড়ে তুলেছেন। প্রতিরক্ষা বাজেটের অর্থে মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল তোলার জন্যও কিছু বরাদ্দ করেছেন।

জো বাইডেন জানিয়েছেন, তিনি চান রাশিয়া ও চীনকে মোকাবেলার জন্য অপ্রাসাঙ্গিক বিনিয়োগগুলোকে স্মার্ট বিনিয়োগ হিসেবে কাজে লাগাতে। তার ভাষায় সেই স্মার্ট ইনভেস্টমেন্ট হচ্ছে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনী খাত। যেমন সাইবার, মহাশূন্য, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মনুষ্যবিহীন অন্যান্য পদ্ধতি। আবার এই সংশ্লিষ্ট বেসামরিক খাত যেমন ক‚টনীতি, অর্থনৈতিক শক্তি, শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইত্যাদি খাতেও অর্থ খরচ করতে চান প্রতিরক্ষার অংশ হিসেবেই। অর্থাৎ বাইডেনের নীতি অনুযায়ী শুধু যুদ্ধবিমান বা ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিই প্রতিরক্ষার একমাত্র কাজ নয়। এর বাইরেও সংশ্লিষ্ট দিকগুলোতে তিনি এগিয়ে নিতে চান যুক্তরাষ্ট্রকে।

ইরাক ও আফগানিস্তানের যুদ্ধের বিষয়ে ট্রাম্পের নীতির সাথে অনেকটাই মিল আছে জো বাইডেনের নীতির। যদিও সিনেটর থাকার সময় ইরাক যুদ্ধের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন, তবু বাইডেন এখন চান ইরাক ও আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্যদের দেশে ফেরাতে। এ বিষয়ে তার প্রস্তাব হচ্ছে, বিশেষ অভিযানের জন্য ছোট একটি বাহিনী মোতায়েন রেখে, বড় সংখ্যার সৈন্যদের দেশে ফিরিয়ে নেয়া। ডোনাল্ড ট্রাম্প ইতোমধ্যেই আফগানিস্তান থেকে সৈন্য ফেরানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন। তার সরকার চুক্তি করেছিল তালেবানের সাথে।এই দিক থেকে জো বাইডেনের মিল আছে তার পূর্বসূরীর সাথে- তিনিও ট্রাম্পের মতো আর যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে নন।

আশা করা যেতে পারে বাইডেন হোয়াইট হাউজে এসে আফগান যুদ্ধ অবসানের ধারাবাহিকতা রক্ষা করবেন। ইরাক যুদ্ধের বিষয়েও তার এই মানসিকতা দেখা যেতে পারে। কারণ নির্বাচনী প্রচারণায়র সময় বাইডেন বলেছেন, তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকার সময় প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে ইরাক থেকে দেড় লাখ সৈন্য ফিরিয়ে আনতে রাজি করিয়েছিলেন।

অস্ত্র বিক্রিতে ট্রাম্প প্রশাসন রীতিমতো বিপ্লব করেছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতির প্রধান ফোকাসই ছিলো অস্ত্র বিক্রি করা। অস্ত্র বিক্রির প্রক্রিয়ার জটিলতা কমাতেও ট্রাম্পের উদ্যোগ ছিলো। ফায়ারআর্মস, ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা, ড্রোন সব কিছুই স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি বিক্রি করেছেন ট্রাম্প। চার বছরের মেয়াদের একেবারে শেষ দিকে এসে সংযুক্ত আরব আমিরাতকে এফ-থার্টিফাইভ স্টিলথ ফাইটার দেয়ার প্রাথমিক সম্মতিও দিয়েছেন। তুরস্ককে প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র না দেয়ার কারনে বারাক ওবামার সমালোচনাও করেছেন একাধিকবার।এসব ক্ষেত্রে জো বাইডেন অবশ্য এখন পর্যন্ত স্পষ্ট করে কিছু বলেননি।

বাইডেন বলেছেন, ইয়েমেন যুদ্ধে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোটকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহযোগিতা বন্ধ করবেন। এছাড়া রিয়াদের কাছে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করার পরিকল্পনাও রয়েছে এই ডেমোক্র্যাট নেতার। বহুবছর ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রের সবচেয়ে বড় ক্রেতা সৌদি আরব। জো বাইডেন চাইলেই সেটি পুরোপুরি বন্ধ করতে পারবেন কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কারন অস্ত্র বিক্রির সাথে জড়িত আছে অর্থের হিসাব। রিয়াদে অস্ত্রের চালান পৌছানোর আগে মার্কিন রাজস্ব খাতে জমা হয় মোটা অঙ্কের অর্থ। সেই অর্থে আবার সৌদি আরব থেকে তেল কেনে ওয়াশিংটন। তাই সৌদি আরবের কাছে অস্ত্র বিক্রি পুরোপুরি বন্ধ করা সহজ হবে না কোন মার্কিন প্রেসিডেন্টের জন্যই। তবু বাইডেন বলেছেন, আমেরিকা কখনোই শুধুমাত্র তেল কেনা বা অস্ত্র বিক্রির জন্য কোন নীতি নিয়ে অগ্রসর হবে না।

প্রতিরক্ষা ইস্যুতে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ন্যাটো। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন এই জোটটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামরিক জোট; কিন্তু ট্রাম্প যুগে এই জোটের মধ্যে অনেক তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে ট্রাম্পের নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারেন তিনি। বাইডেন নিজেও ইউরোপীয় মিত্রদের সাথে সম্পর্ক খারাপ করার দায়ে ট্রাম্পকে অভিযুক্ত করেছেন এবং নির্বাচনী প্রচারণার সময় বলেছেন, নতুন প্রেসিডেন্টের কাজ হবে যুক্তরাষ্ট্রের হারানোর সুনাম উদ্ধার করা। ন্যাটো সদস্য দেশগুলোর ওপর জোটের খরচ বহনের জন্য ট্রাম্প যে চাপ দিয়েছিলেন সেটিও সম্ভবত বাইডেন দেবেন না।

এর বাইরে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে গ্রেট পাওয়ার বা পরাশক্তির প্রতিযোগীতা। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী রাশিয়া ও চীন। চীনের সাথে লড়াই নিয়ে কিছু বিষয়ে ট্রাম্পের সাথে বাইডেন একমত হলেও এতটা আক্রমণাত্মক হতে চান না তিনি। সিনেটে থাকার সময় চীনের সাথে সম্পর্ক নিয়ে ইতিবাচক ছিলেন বাইডেন। পরে অবশ্য বিভিন্ন সময়ে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে উদ্দেশ্য করে বিতর্কিত কিছু মন্তব্যও করেছেন। সব মিলে চীন ইস্যুতে বাইডেন হয়তো মধ্যম পন্থা নিতে পারেন। সেটি হতে পারে চীনের ওপর চাপ অব্যাহত রেখে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বৃদ্ধি করা।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে ট্রাম্পের ভালো সম্পর্ক থাকলেও বাইডেন সেই পথে হাটবেন না সেটা নিশ্চিত। এক বক্তৃতায় তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পুতিনের অধীনস্ত হিসেবেও আখ্যায়িত করেছিলেন। তাই রাশিয়ার সাথে আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ওবামা যুগের মতোই তিক্ত হয়ে যেতে পারে।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে