কাতার চায় এফ-থার্টি ফাইভ, ইসরাইল আমেরিকা টানাপোড়েন

কাতারের এফ-৩৫ কেনার প্রস্তাব মোটেও বিস্ময়কর নয় - জে পোস্ট

  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ২১ অক্টোবর ২০২০, ২৩:৫৪

সংযুক্ত আরব আমীরাত বেশ কয়েক বছর আগেই এফ-থার্টি ফাইভ জেট বিমানের চাহিদা জানিয়ে রেখেছে। তারপর থেকে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশই এই যুদ্ধবিমানটির প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠে। আরব আমিরাতের পর মধ্যপ্রাচ্যের অপর কোনো দেশ থেকেও এফ-থার্টি ফাইভের চাহিদা আসা ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। এবার তাই হলো। রয়টারে সম্প্রতি প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, কাতারও সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এফ-থার্টি ফাইভ জেট বিমান কেনার প্রস্তাব দিয়েছে।

কাতারের এফ-৩৫ কেনার প্রস্তাব মোটেও বিস্ময়কর নয়। কাতার এর আগেও অনেকবার যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সর্বশেষ প্রযুক্তি সমৃদ্ধ সামরিক অস্ত্র ক্রয় করেছে। কিন্তু এবার কাতারের এ যুদ্ধবিমান কেনার আগ্রহটি বেশি আলোচিত হচ্ছে। কেননা বেশ জটিল একটি সময়ে দেশটি এমন এই আবদার করলো।

কাতার প্রশাসন খুব ভালো করেই জানে যে, আরব আমীরাত অনেক আগেই এফ-থার্টি ফাইভ বিমানের চাহিদা জানালেও এখনও পর্যন্ত তারা তা হাতে পায়নি। কারণ আমীরাতের এ বিমান ক্রয়কে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র আর ইসরাইলের মধ্যেও বেশ টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। নতুন করে কাতার এর মধ্যে নাক ঢুকানোর কারণে গোটা বিষয়টি শুধুমাত্র আমীরাতের জন্যই জটিল হয়ে গেলো, তাই নয় বরং গালফ কোঅপারেশন কাউন্সিলের অন্যন্য সদস্যরাষ্ট্রগুলোও এখন বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে যাবে।

হয়তো কাতার এ ধরনের একটি জটিলতা তৈরির পরিকল্পনা থেকেই এই সময়ে এসে এফ-থার্টি ফাইভ কেনার প্রস্তাব দিয়েছে। যারা এতদিন মনে করেছিলেন যে, উপসাগরীয় আরব অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যকার বিতর্ক একটু হলেও হ্রাস পেয়েছে, তারা ভুল হিসেব করেছেন। অন্তত কাতারের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ এমনটাই ইংগিত দিচ্ছে।

কাতার এফ-থার্টি ফাইভ বিমান কিনতে চাইলেও সহজে তা পাবে না। প্রস্তাবটি হয়তো অনেকদিন ঝুলেই থাকবে। কিন্তু যদি তারা বিমানটি কেনার বিষয়ে সত্যিই আন্তরিক হয়, তাহলেও বর্তমান সময়কে কখনোই এর জন্য উপযুক্ত বলে মনে হয় না। কাতারের এ চাহিদা বরং আমীরাতের এফ-থার্টি ফাইভ বিমান ক্রয়ের প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র আর ইসরাইলের সম্পর্কের মধ্যে তৈরি হওয়া ঘায়ে নতুন করে নুনের ছিটা দেবে। যদিও মার্কিনীদের জন্য এটি একটি আকর্ষনীয় প্রস্তাব,এরপরও কাতারের এ আগ্রহ মধ্যপ্রাচ্যের জটিলতাকে আরো বেশি উস্কে দেবে।

কাতারের সাম্প্রতিক প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্রও চাপের মুখে পড়ে গেছে। যদি যুক্তরাষ্ট্র আরব আমীরাতের কাছে এ যুদ্ধবিমানগুলো বিক্রি করে, তাহলে কোন যুক্তিতে তারা কাতারকে ‘না’ করবে? এছাড়া কিছুদিন আগেই যুক্তরাষ্ট্র কাতারকে ন্যাটোর বাইরে অন্যতম অংশীদার ও সহযোগী রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। পাশাপাশি, কাতারের মাটিতে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল কমান্ডের একটি দফতর রয়েছে। মার্কিন যৌথ বিমান অভিযান পরিচালনার একটি কেন্দ্রও কাতার থেকে পরিচালিত হয়ে আসছে বহু বছর ধরে। কাতারে স্থাপিত প্রতিটি সামরিক স্থাপনাই এ অঞ্চলে মার্কিন অভিযান পরিচালনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

এসব বাস্তবতা এড়িয়ে কাতারকে না করা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সহজ নয়। এরপরও যদি যুক্তরাষ্ট্র চূড়ান্তভাবে কাতারকে এফ থার্টিফাইভ বিমান দিতে অস্বীকৃতি জানায়, তাহলে কাতার হয়তো রাশিয়া বা চীনের দিকে ঝুঁকে পড়বে। কিংবা এসব দেশ থেকে পঞ্চম প্রজন্মের অত্যাধুনিক বিমান ক্রয়ে আগ্রহ দেখাবে। তেমনটা হলে মধ্যপ্রাচ্যে শক্তির প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্র অনেকটাই পিছিয়ে পড়বে।

ওয়াশিংটন অবশ্য পরিস্থিতিকে সামাল দেয়ার জন্য দোহা ও আবুধাবি- উভয়কেই সম্মতি জানাতে পারে। তবে, তাও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে কতটুকু ইতিবাচক হবে- তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। কারণ মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলো এভাবে যদি যুক্তরাষ্ট্রের উন্নত সমরাস্ত্র হাতে পেয়ে যায় তাহলে এ অঞ্চলে ইসরাইলের সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব খর্ব হবে। ইসরাইল তাই কোনোভাবেই মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের সমরাস্ত্র বিক্রিকে ভালোভাবে গ্রহণ করে না। আর যুক্তরাষ্ট্রও নিজেও মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের শক্তিকে দুর্বল করতে রাজি নয়।

এছাড়া এ ধরনের সমরাস্ত্র কেনার প্রস্তাব শুধুমাত্র আমীরাত বা কাতারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে- এমনটা মনে করারও কোনো কারণ নেই। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যন্য আরব দেশ বিশেষ করে সৌদি আরব, মিশর এবং জর্ডানও সম্ভবত খুব শীঘ্রই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এফ থার্টি ফাইভ বিমান কেনার আগ্রহ প্রকাশ করবে। আর এই বিমানটি ক্রয় করার অধিকারও এ দেশগুলোর রয়েছে। কিন্তু সম্ভাব্য এ পরিস্থিতিকেই ইসরাইল ভয় পাচ্ছে এবং তারা প্রতিনিয়ত ওয়াশিংটনকে এ বিষয়ে সতর্ক করে যাচ্ছে।

এফ থার্টি ফাইভ বিমান নিয়ে যে জটিলতাগুলোর সৃষ্টি হয়েছে তাতে এমনও হতে পারে, ওয়াশিংটন বিমান বিক্রির গোটা প্রক্রিয়াকে অন্তত কয়েক বছরের জন্য স্থগিত করে দিতে পারে। তেমনটাই ভাবছেন মার্কিন প্রশাসনের মিডলইস্ট বিষয়ক রিসার্চ সেন্টারের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিলাল ওয়াই সাব। তিনি মনে করেন, জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে এ প্রক্রিয়া স্থগিত হয়ে যাবে। কারণ বাইডেনের সাথে আমীরাতের কোনো বিশেষ সম্পর্ক নেই।

এরই মধ্যে জো বাইডেন সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে তিনি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ট্রাম্প প্রশাসনের অনুসৃত নীতি মানবেন না, বরং তিনি বেশ কিছু সংশোধনী নিয়ে আসবেন। এমনকী ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, তার জন্যেও এফ থার্টি ফাইভ বিমান বিক্রির বিষয়টি একটি বড়ো মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

বিলাল ওয়াই সাব আরো মনে করেন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর এ বিমান কেনার প্রয়োজন নেই। যদিও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো হয়তো এ চিন্তার সাথে একমত হবে না। এফ থার্টি ফাইভ বিমান না থাকলেই বরং আবুধাবি, দোহা এবং অন্যন্য আরব রাষ্ট্রের নিরাপত্তা স্বার্থ বেশি সংরক্ষিত হবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সামনে আনা ইরান নামের জুজুর ভয়।

এফ থার্টি ফাইভ বিমানটি খুবই শক্তিশালী ও কার্যকর বিমান হওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো হয়তো ভাবতে পারে যে, এফ থার্টি ফাইভ বিমান সমৃদ্ধ দেশগুলোতে ইরান আক্রমণ করার সাহস পাবে না। বিষয়টা এত সহজ নাও হতে পারে। একটি দেশকে শুধু বাধা দিয়ে যাওয়া কৌশল হিসেবে কখনোই উত্তম কৌশল নয়। বরং ক্রমাগতভাবে বাধা দিয়ে গেলে বিষয়টি আরো জটিল হয়ে যেতে পারে।

ট্রাম্প প্রশাসন তার সর্বোচ্চ সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে ইরানের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চেয়েছিল এরপরও মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের কর্মকান্ডকে দমিয়ে রাখা যায়নি। এমনকী ২০১৯ সালে সৌদি আরবের বেশ কয়েকটি তেল স্থাপনায় ইরান আক্রমন চালাতেও সক্ষম হয়েছিল। ইরানের এই ক্রমবর্ধমান তৎপরতার মধ্য দিয়ে মূলত যুক্তরাষ্ট্রের ইরানবিরোধী কৌশলের সীমাবদ্ধতাই প্রমাণ হয়।

আরো কিছু অনিশ্চয়তাও আছে। মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলো বিমান প্রতিরক্ষা খাতেই সবচেয়ে শক্তিশালী। ভবিষ্যতে তারা এখানে আর কত বিনিয়োগ করবে তাও নিশ্চিত করে বলা যায় না। যে খাতে তারা তুলনামূলক সমৃদ্ধ, সেখাতে মাত্রাতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করা বোকামি। বরং বিনিয়োগ যদি করতেই হয় তাহলে বিনিয়োগের মাধ্যমে তাদের দুর্বলতা গুলোকেই ভবিষ্যতে দূর করতে চাইবে।

যুদ্ধরত কোনো পক্ষই ভারসাম্য করতে আগ্রহী হয় না, বরং তারা জয় পেতে চায়। আর তাছাড়া এক্ষেত্রে জাতীয় প্রতিরক্ষার বিষয়টিও জড়িত। তাই যেকোনো দেশই তার বিরুদ্ধে চলমান হুমকিগুলোকে ধ্বংস ও দুর্বল করতে চাইবে। কিন্তু বিমান বাহিনী ছাড়া আরব দেশগুলোর অন্যন্য বাহিনীর দুর্বলতা অনেকটাই স্পষ্ট। অধিকাংশ দেশেরই নৌ অভিযান চালানোর সক্ষমতা সীমিত। এজন্য ভবিষ্যতে এই দেশগুলো অনেক বেশি নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়বে।

যদি আরব রাষ্ট্রগুলো ইরানের বিমান বাহিনীর চেয়ে বেশি সক্ষমতা অর্জনও করতে পারে, তারপরও তারা সমুদ্রে লড়াই করতে এসে ধরাশায়ী হয়ে যাবে। আরব দেশগুলোর নৌ বাহিনী এত বেশি দুর্বল হওয়ার কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চম নৌ বহরকে নিয়মিতভাবে এ অঞ্চলে টহল দিতে হয়।

ইরানের রিভোলিউশনারী গার্ড ইচ্ছে করলে নৌ পথে হামলা চালিয়ে মাত্র ৭ দিনে গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে তছনছ করে দিতে পারে। ইয়েমেন এক্ষেত্রে আরব দেশগুলোর জন্য একটি বড়ো উদাহরণ। ইরান নৌ পথে ইয়েমেনীদেরকে অস্ত্র সরবরাহ করেছে। অথচ এ ধরনের তথ্য থাকার পরেও আরব দেশগুলো তা বন্ধে কোনো ধরনের উদ্যেগ নিতে পারেনি।

অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এফ থার্টি ফাইভ বিমানের দিকে হাত না বাড়িয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর বরং মাইন ধ্বংসকারী যন্ত্র, যুদ্ধজাহাজ এবং আকাশ থেকে সমুদ্র পথে হামলা মোকাবেলায় সক্ষমতা অর্জন করা দরকার। আরবের দেশগুলোর আরেকটি সীমাবদ্ধতা হলো তাদের অর্থনৈতিক কাঠামো। যদি তারা তেল রফতানি না করতে না পারে তাহলে গোটা দেশের অর্থনীতি ভঙ্গুর অবস্থায় চলে যেতে পারে। অপরদিকে, যদি চীনের আগ্রাসনকে মুকাবেলা করতে হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রকে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরে নৌ বাহিনীর তৎপরতা বাড়াতে হবে। আর সেক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিনীদের যেসব সহযোগী রাষ্ট্র রয়েছে, তাদের নৌ বাহিনীর শক্তিও বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।

এফ থার্টিফাইভ বিমান নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে যে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে তার জন্য মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোর সমালোচনা করে লাভ নেই। বরং এর দায়ও যুক্তরাষ্ট্রের। এসব দেশের সঠিক প্রতিরক্ষা নীতি প্রনয়নে বা অগ্রাধিকার নির্ধারনে যুক্তরাষ্ট্র কখনোই সহযোগিতা করেনি।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে