তুরস্ক নিয়ে উভয় সংকটে যুক্তরাষ্ট্র

তুরস্কের কার্যক্রম নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন - এফটি ডটকম

  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ১৮ অক্টোবর ২০২০, ১৫:০৬

গ্রীসের একটি সংবাদপত্রে প্রথম খবর প্রকাশ হয়, তুরস্ক তার হাতে থাকা রাশিয়ার তৈরি এস-ফোর হান্ড্রেড নিরাপত্তা ব্যবস্থা চালু করেছে। গত আগস্ট মাসে বহুপাক্ষিক মহড়া থেকে ফিরে আসা গ্রীসের একটি এফ-সিক্সটিন বিমানকে ট্র্যাক করার জন্যই তারা এ পদক্ষেপ নেয়। যদি সত্যিই যুক্তরাষ্ট্রের নির্মিত বিমানটিকে ট্র্যাক করার জন্য আংকারা তার নিরাপত্তা রাডারটি ব্যবহার শুরু করে তাহলে বুঝতে হবে, যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের নিরবিচ্ছিন্ন হুমকিকে তুরস্ক আর পাত্তা দিচ্ছে না। আর তেমনটা হলে পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য মোটেও আর স্বস্তিদায়ক অবস্থায় থাকবে না।

তুরস্কের এস-৪০০ সচল করা নিয়ে পেন্টাগন এখনো মুখ খোলেনি। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের একজন মুখপাত্র শুধু এটুকু জানিয়েছেন যে, মার্কিন প্রশাসনের কর্মকর্তারা পত্রিকার এ প্রতিবেদনের বিষয়ে অবগত। অন্যদিকে, ক্যাপিটল হিলে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট দলের বেশ কিছু সিনেটররা মিলে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওকে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন।

চিঠিতে তারা বলেছেন, যদি পত্রিকার রিপোর্টটি সত্য হয় তাহলে ট্রাম্প প্রশাসনের উচিত তুরস্কের ওপর দীর্ঘমেয়াদে অবরোধ জারি করা। এ সিনেটরগন আরো মনে করেন, তুরস্ক যখন রাশিয়ার কাছ থেকে এ নিরাপত্তা ব্যবস্থাটি ক্রয় করেছে তখুনি বরং এ অবরোধ জারি করার প্রয়োজন ছিল। চিঠিতে তারা আরো বলেন, যেভাবে ড্যামকেয়ার মুডে তুরস্ক চলছে, তা থেকে বেরিয়ে আসার কিংবা রাশিয়া থেকে সংগৃহিত নিরাপত্তা ব্যবস্থাকেও ত্যাগ করার কোনো মানসিকতা তুরস্কের নেই। তাছাড়া মার্কিন এফ-সিক্সটিন যুদ্ধবিমানকে ট্র্যাক করার উদ্দেশ্যে তুরস্ক এস-ফোর হান্ড্রেড নিরাপত্তা ব্যবস্থা চালু করার ঘটনাটি যথেষ্ট উদ্বেগজনক। কেননা, এই নিরাপত্তা ব্যবস্থা চালু থাকলে রাশিয়ার হাতে স্পর্শকাতর অনেক তথ্যই চলে যেতে পারে।

২০১৭ সালে আংকারা রাশিয়া থেকে বিমান নিরাপত্তা ব্যবস্থা এস ফোর হান্ড্রেডটি ক্রয় করে। তখন থেকেই যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। তাদের মধ্যে আশংকা ছিল এই সিস্টেমটি ব্যবহার করলে ন্যাটো জোটের বৈমানিক কার্যক্রম সংক্রান্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মস্কোর জিম্মায় চলে যাবে। রাশিয়ান নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপর তুরস্ক ভরসা রাখায় কংগ্রেস এতটাই ক্ষেপে গিয়েছিল যে, ২০১৮ সালের মাঝামাঝি থেকেই মার্কিন কংগ্রেস তুরস্কের কাছে অস্ত্র বিক্রির সকল প্রস্তাব আটকে দেয়। মার্কিন কংগ্রেসের আপত্তিকে তোয়াক্কা না করে তুরস্ক গত বছর থেকে যখন রাশিয়ার কাছ থেকে এস-ফোর হান্ড্রেড নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিতে শুরু করে, তখন রাগে ক্ষোভে ট্রাম্প প্রশাসন তার ক্ষমতা ব্যবহার করে তুরস্ককে এফ-থার্টি ফাইভ প্রকল্প থেকে বাদ দেয়।

তুরস্ক এর আগেও বিমান বিধ্বংসী এবং মিসাইল বিধ্বংসী ব্যবস্থা ব্যবহার করেছে। নিজের হাতে থাকা একটি মার্কিন এফ-সিক্সটিন বিমানের ওপর তারা এসব পরীক্ষাও চালিয়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বøুমবার্গ জানায়, আংকারা আবারও কৃষ্ণ সাগর উপক‚লের সিনপ প্রদেশে এ পদ্ধতির আরেকটি পরীক্ষা চালানোর পরিকল্পনা করেছে। এ মহড়ায় তারা ৪শ কিলোমিটার অতিক্রম করতে পারে এমন সব মিসাইল নিক্ষেপ করবে।

এই দূরত্বের মিসাইল দিয়ে পরীক্ষা করার মধ্য দিয়ে তুরস্ক রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রকেও সতর্কবার্তা দিলো। কারণ, এই এলাকায় এমন দূরত্বে প্রায়ই মার্কিন ও রাশিয়ার যুদ্ধবিমানগুলো চলাচল করে। ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনটি অবশ্য বলছে যে, তুরস্ক মূল ব্যাটারিকে চালু করবে না, তবে তারা যন্ত্রপাতিগুলো পরীক্ষা করবে। তুরস্ক সময়মতো তার স্বার্থে সবকিছুই করতে পারে- এমনটাই পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন।

তবে, তুরস্কের এসব কার্যক্রমকে যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে মোকাবেলা করবে তা নিয়ে মার্কিন সরকারের ভেতর ও বাইরে মতপার্থক্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যদি তুরস্ক আসলেই রাশিয়ার তৈরি এস-ফোর হান্ড্রেড নিরাপত্তা ব্যবস্থা চালুও করে তাহলে তার জন্য তাদেরকে যথেষ্ট পরিমান অর্থই ব্যয় করতে হয়েছে। তাই কারো চাপে তুরস্ক এ প্রযুক্তি ব্যবহার বন্ধ করবে- তা মনে করার কোনো কারণ নেই। এছাড়া কংগ্রেস তুরস্কের ওপর অবরোধ আরোপের জন্য আগেও চাপ দিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা কার্যকর করা যায়নি।
২০১৭ সালে ওয়াশিংকটন কাটসা নামে একটি আইন প্রনয়ন করেছিল। কোনো দেশ যদি রাশিয়ার কাছ থেকে বড়ো আকারের কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা ক্রয় করে তাহলে এই কাটসা আইন অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রকে সে দেশটির ওপর অবশ্যই অবরোধ আরোপ করতে হবে। সিনেটররা বলছেন, তুরস্ক এস-ফোর হান্ড্রেড নিরাপত্তা ব্যবস্থা চালু করায় আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধেও অবরোধ জারি করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।

ওয়াশিংটনের সামরিক থিক ট্যাংক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ থমাস কারাকো বলেন, “যদি আসলেই তুরস্ক এস-ফোর হান্ড্রেড নিরাপত্তা ব্যবস্থা সংগ্রহ করে তাহলে তারা কোনো না কোনোভাবে তা প্রয়োগ করবেই। তবে, এ নিরাপত্তা ব্যবস্থা ব্যবহার করলেই তারা কাটসা আইনে অবরোধের আওতায় চলে যাবে- এমনও নয়। তাদের বিরুদ্ধে অবরোধ দেয়ার আগে যুক্তরাষ্ট্রকে আগে প্রমাণ করতে হবে, তুরস্ক এস-ফোর হান্ড্রেড নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে যুক্তরাষ্ট্র বা ন্যাটোর কোনো মিত্রদেশের বিরুদ্ধে নেতিবাচকভাবে ব্যবহার করেছে। এছাড়া কাটসা আইনে রাশিয়া থেকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা কেনার বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি, বরং রাশিয়া থেকে অস্ত্র না কেনার বিষয়ে বলা হয়েছে।

সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ প্রমাণ করছে যে, আংকারা এস-ফোর হান্ড্রেড নিরাপত্তা ব্যবস্থা চালুর দিকেই অগ্রসর হচ্ছে। এ নিরাপত্তা ব্যবস্থা ব্যবহার করে তারা একটি কমান্ড পোস্ট, মিসাইল লাঞ্চার এবং শক্তিশালী রাডার পরিচালনা করতে পারবে- যা দিয়ে শত শত মাইল দূর থেকেই তারা প্রতিপক্ষের বিমানকে সনাক্ত করতে পারবে।

রাডার অলস বসে থাকার মতো কোনো প্রযুক্তি নয়। রাডার যখন নজরদারির কাজে লাগানো হয়, তখন তার চোখে যা গোচর হয়, সবটাকেই সে দেখে। আর যখুনি তার নজরে সমস্যাকর কিছু চলে আসে, তখন তারা আরো বেশি শক্তি ধারণ করে সে বস্তুটিকে সনাক্ত ও নির্নয় করার চেষ্টা করে। এস-ফোর হান্ড্রেড নিরাপত্তা ব্যবস্থাটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে তুরস্ক শুধু যুক্তরাষ্ট্র বা ন্যাটোর কথা ভাবছে না। তুরস্কের জন্য মাথাব্যথার বড়ো কারণ হলো গ্রীস।

এরদোয়ান এমনিতেই নিজ দেশে অর্থনীতিকে নিয়ে বেশ চাপে আছেন। পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন এনে তিনি অর্থনীতিকে বরং ভিন্নমাত্রায় দাঁড় করাতে চাইছেন। গেল গ্রীষ্মে ভূমধ্যসাগরে সঞ্চিত গ্যাসের মজুদ নিয়ে এ অঞ্চলের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বেশ উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পাশাপাশি, সাইপ্রাসের বিভক্ত দ্বীপপুঞ্জ এবং তুরস্ক থেকে গ্রীসে বেশ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অভিবাসী চলে যাওয়ায় গ্রীস ও তুরস্কের মাঝে টানাপোড়েন বেড়েছে।

গত সেপ্টেম্বর মাসে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও গ্রীস, ক্রীট এবং সাইপ্রাস সফর করেন। সফরকালে সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত বিতর্কের বিষয়ে তিনি প্রকাশ্যে সাইপ্রাস ও গ্রীসের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ঘোষণা করেন। পম্পেও বলেন, “যদিও পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় গ্রীস ও সাইপ্রাসের ন্যায্য অধিকার আছে। তারপরও প্রাকৃতিক গ্যাস অনুসন্ধানের নামে তুরস্ক এসব এলাকায় অভিযান পরিচালনা করছে। তুরস্কের এমন কার্যক্রম নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন।

বিগত দুই বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তুরস্কের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বেশ টানাপোড়েনের ভেতর দিয়েই অগ্রসর হয়েছে। এস-ফোর হান্ড্রেড নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে সংকটের সূত্রপাত হলেও পরবর্তীতে ২০১৯ সালে এরদোয়ান প্রশাসন সিরিয়ায় আক্রমণের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তাও যুক্তরাষ্ট্র ভালোভাবে নেয়নি।

তুরস্ক নিয়ে উভয় সংকটে যুক্তরাষ্ট্র। ছবি : দ্যা নিউইয়র্ক টাইমস
তুরস্ক নিয়ে উভয় সংকটে যুক্তরাষ্ট্র। ছবি : দ্যা নিউইয়র্ক টাইমস

 

আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, রাশিয়ার কাছ থেকে এস-ফোর হান্ড্রেড নিরাপত্তা ব্যবস্থা ক্রয় করার মাধ্যমে তুরস্ক ইংগিত দিয়েছে যে, তারা যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর অন্যন্য মিত্রের শিকল থেকে বেরিয়ে যেতে চায়। আবার অনেকে মনে করছেন, তুরস্ক আগেও যা করেছে এখনও তাই করছে। তারা বরাবরই নিজেদের স্বার্থরক্ষাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। তাই নিজেদের জাতীয় স্বার্থে যা সঠিক মনে করে তারা তাই করে। এক্ষেত্রে অন্যদের আপত্তিকে তারা খুব একটা গ্রাহ্য করতে চায় না।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের ওপরমহল যতই নিরুত্তাপ ভাব দেখাক না কেন, সেনা কর্মকর্তারা তুরস্কের সাথে যেকোনো ধরনের দূরত্ব সৃষ্টি নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন। কেননা, যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার সাথে তুরস্ক জড়িয়ে গেছে।

তুরস্কের ইনসিরলিক বিমান ঘাটিতে বেশ কয়েকটি আমেরিকান বি-সিক্সটি ওয়ান নিউক্লিয়ার বোমা রয়েছে। তাছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের যে কোনো অভিযান পরিচালনায় তুরস্কের এসব স্থাপনা ব্যবহার করতে হয়। তাছাড়া তুরস্কের হাতে বসফোরাসের নিয়ন্ত্রণও রয়েছে। এই বসফোরাস প্রনালী দিয়েই নৌপথে কৃষ্ণসাগরে প্রবেশ করতে হয়। তাই যুক্তরাষ্ট্র চাইলেই হুট করে তুরস্কের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে