কিলার ড্রোনের ভয়াল পরিণাম

গত পাঁচ বছরে ড্রোন প্রযুক্তি দ্রুত বিস্তার লাভ করেছে - দ্যা গার্ডিয়ান

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৩:৫৯

ড্রোন হচ্ছে দূর থেকে নিয়ন্ত্রিত এক ধরনের ছোট আকাশযান। ১৯৯০এর দশকে এর প্রথম দেখা মেলে। তখন শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক নজরদারির কাজেই এটি ব্যবহার হতো। কিন্তু ব্যাপারটা সেখানেই থেমে থাকেনি। আকারে ছোট এবং নির্মাণব্যয় অনেক কম হওয়াতে দ্রæত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ড্রোন। এটি এখন ব্যবহৃত হচ্ছে সবরকম কাজে - বিনোদন শিল্পে, চলচ্চিত্রে, কারো চলাফেরা বা কথাবার্তা মনিটর করতে এবং এমনকি প্রত্যন্ত এলাকায় জীবনরক্ষাকারী ওষুধ পাঠানোর কাজেও।

ড্রোন মানুষের জন্য উপকারী প্রযুক্তি হিসাবে এখন আর নেই। মানুষ হত্যার কাজে নিরাপদ এক বাহন হিসাবে ব্যবহার হচ্ছে।

সময়ের ব্যবধানে সামরিক প্রযুক্তি অনেক এগিয়েছে, যদিও অনেকটা ধীরে। ফলে ড্রোনের ব্যবহারেও অনেক বিবর্তন এসেছে। ১৯৯৯ সালে কসোভো যুদ্ধের সময় সার্বদের গোপন অবস্থান শনাক্ত করার কাজে প্রথম ড্রোন মোতায়েন করা হয়। আর ড্রোনকে প্রথম অস্ত্রসজ্জিত করা হয় নাইন-ইলেভেনের পরপরই। এর পর থেকে তথাকথিত ''সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই''-এ ড্রোন ব্যবহার হয়ে আসছে।

এখন পৃথিবীজুড়ে হাজার হাজার মিলিটারি ড্রোন নজরদারির কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রতিরক্ষা-বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ কাজে ড্রোনের ব্যবহার মোটেই কমবে না, বরং দিনে দিনে আরো বাড়বে। অ্যানালিস্ট গ্রুপ জেন্স-এর বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, বিশ্বে আগামী ১০ বছরে ৮০ হাজারেরও বেশি নজরদারি ড্রোন এবং প্রায় দুই হাজারের মতো অ্যাটাক ড্রোন বিক্রি হবে।

অস্ত্রসজ্জিত ড্রোনগুলোর দাম খুব কম নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর দাম শুরুই হয় প্রতি ইউনিট ১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে। তার ওপর আছে ট্রেইনিং ব্যয় এবং লাগে ড্রোনগুলো দূর থেকে চালানোর জন্য ক্রূ।

কারা কিনছে বা কিনবে এসব ড্রোন? ধরা যাক ব্রিটেনের কথা। তুলনামূলকভাবে ছোট হলেও বর্তমান বিশ্বে ব্রিটেন একটি প্রভাবশালী দেশ। দেশটির রাজকীয় বিমান বাহিনীতে রয়েছে নয়টি ক্ষেপণাস্ত্রবাহী রিপার ড্রোন। তারা পরিকল্পনা করছে ২০২৩ সালের মধ্যে আরো ১৬টি নেক্সট-জেনারেশন প্রটেক্টর ড্রোন কেনার। এতে তাদের প্রাথমিক ব্যয় হবে ৪১৫ মিলিয়ন ইউরো।

ড্রোনের প্রতি বিভিন্ন দেশের এমন আগ্রহ দেখে জেন্স এর বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশ শুধু ২০১৯ সালেই ড্রোন কেনার কাজে ৮০০ কোটি মার্কিন ডলার খরচ করেছে। করবে না কেন? মানুষবিহীন এসব আকাশযান দিয়ে নজরদারি করা যায়, আক্রমণ চালানো যায়। তুলনামূলকভাবে দাম কম। ফলে কম বাজেটের সেনাবাহিনীও সহজেই ড্রোন কিনতে পারে।

এবার দেখা যাক কোন দেশগুলো ড্রোন সবচাইতে বেশি ব্যবহার করে। এ তালিকায় আমরা তিনটি দেশের নাম পাই - মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ইসরাইল। এর সাথে সম্প্রতি যোগ হয়েছে তুরস্কের নাম। এর মধ্যে প্রথম দু'টি দেশ ব্যবহার করে জেনারেল অ্যাটমিকস-এর তৈরি করা প্রিডেটর ও রিপার ড্রোন। জেনারেল অ্যাটমিকস হচ্ছে ক্যালিফোর্নিয়ার একটি কম্পানি। নীল বøু ও লিন্ডেন বøু নামের দুই বিলিয়নেয়ার ভাই এ কম্পানির মালিক। অপরদিকে ইসরাইল ব্যবহার করে নিজেদের নির্মিত ড্রোন।

গত পাঁচ বছরে ড্রোন প্রযুক্তি দ্রুত বিস্তার লাভ করেছে। এ সময় পাকিস্তান ও তুরস্কের মতো দেশও নিজস্ব ড্রোন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে। ২০১৬ সাল থেকে তুরস্ক নিজ দেশের কুর্দি বিদ্রোহী এবং উত্তর ইরাক ও সিরিয়ার কুর্দি গ্রæপগুলোর ওপর ব্যাপকভাবে ড্রোন হামলা চালিয়ে আসছে। এছাড়া লিবিয়ায় বিদ্রোহী নেতা খলিফা হাফতারকে পর্যুদস্ত করে ফেলে তুর্কি ড্রোন। এসব ড্রোনের সমর্থন জাতিসংঘ সমর্থিত জিএএনএ সরকার হাফতারের দখলে থাকা বিশাল এলাকা দখলে নিতে সক্ষম হয়। এরপর তুরস্কের ড্রোনের বাজার সম্প্রসারিত হয়। বহু দেশ এখন তুরস্কের ড্রোন কিনছে।

এদিকে সংযুক্ত আরব আমীরাতসহ অনেক দেশে চীন নিজেদের নির্মিত উইং লুং ও সিএইচ সিরিজের ড্রোন সরবরাহ করে আসছে । আমীরাত এগুলো ব্যবহার করে প্রাণঘাতী হামলা চালাচ্ছে লিবিয়ায়। পাশাপাশি মিশর, নাইজেরিয়া,সউদি আরব ও ইরাকও চীনের কাছ থেকে ড্রোন কিনছে, যদিও এসব দেশের অনেকটিরই জানা নেই এসব ড্রোন দিয়ে তারা আসলে কী করবে। তারপরও ড্রোনের বিস্তার থেমে নেই। এ দৌড়ে আছে রাশিয়া এবং ভারতও।

২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে সউদি আরবের তেলক্ষেত্রে যে হামলা হয় তার জন্য ইরানকেই দায়ী করা হয়। ধারণা করা হয় যে, ওই হামলায় ড্রোন ও মিসাইল দুটোই ব্যবহার করা হয়।

ড্রোনকে অস্ত্রসজ্জিত করার বিষয়টি দ্রুত গতি পায় নাইন-ইলেভেনের পরপরই। প্রিডেটর ড্রোন দিয়ে আকাশ থেকে আল-কায়দা নেতা ওসামা বিন লাদেনের অবস্থান শনাক্ত করা হয়। তবে ২০০১ সালের অক্টোবরে ড্রোনের প্রথম হামলাটি ব্যর্থ হয়। ওই হামলার টার্গেট ছিলেন আফগানিস্তানের তালিবান নেতা মোল্লা ওমর। হামলায় তাঁর অবস্থানস্থলের বাইরে তার কয়েকজন দেহরক্ষীর প্রাণহানি হয়।

মোল্লা ওমরকে হত্যা করতে ব্যর্থ হলেও হতোদ্যম হয়নি যুক্তরাষ্ট্র। তারা আফগানিস্তানের পাশাপাশি তথাকথিত ''সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই''-এর অজুহাতে পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলীয় উপজাতি অধ্যুষিত এলাকায়ও রিপার ড্রোন মোতায়েন করে। এ থেকে বাদ যায়নি ইরাক, সোমালিয়া, ইয়েমেন, লিবিয়া ও সিরিয়াও।

ড্রোন হামলা বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র কোনো তথ্য প্রকাশ না-করলেও ব্রিটেন একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যায়, ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল - এ চার বছরে ইরাক ও সিরিয়ায় আইএস-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ২,৪০০টি হামলায় রিপার ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছে, যা গড়ে প্রতিদিন প্রায় দুইবার।

অবাক করার মতো হলেও সত্য, কুয়েতের একটি বিমানঘাঁটিতে মোতায়েন করা ড্রোনগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেভাদায় বসে চালায় ব্রিটিশ পাইলটরা। প্রতি তিন ঘণ্টা পরপর পাইলট পরিবর্তন করা হয়। একজন ব্রিটিশ সমরবিশেষজ্ঞ বলেন, প্রচলিত বিমানহামলার চাইতে ড্রোনহামলা পাঁচ-ছয়গুণ বেশি কার্যকর।

তবে একজন ড্রোনবিশেষজ্ঞ বলেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন, লোকজন যেমন মনে করে, ড্রোন তার চাইতে বেশি অ্যানালগ। রিপার ড্রোন ওঠানামায় এখনও মানুষ পাইলটের দরকার হয়।

ড্রোন কতোটা নির্ভুলভাবে লক্ষ্যস্থলে আঘাত হানতে সক্ষম- এ বিষয়ে সঠিক তথ্য পাওয়া সম্ভব নয়। তবে এটা তো ঠিক যে, ড্রোন অনেকবারই ভুল টার্গেটে হামলা করেছে। গোপনীয়তার বেড়াজাল ভেদ করে বেরিয়ে আসা এক বিরল তথ্যে দেখা যায়, ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আফগানিস্তান, ইরাক ও সিরিয়ায় ৪৭৩ বার বিমানহামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এতে কমপক্ষে ১১৬ জন অসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে, যা এ হামলার লক্ষ্য ছিল না। একটি মানবাধিকার সংস্থার মতে ওসব মার্কিন হামলায় ১,১৪৭ জন সিভিলিয়ানের প্রাণহানি ঘটেছে। ড্রোনের ভুলেই এটা ঘটেছে।
ব্রিটেন অবশ্য বলেছে ভিন্ন কথা। তাদের দাবি, ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সিরিয়া ও ইরাকে তাদের ড্রোনহামলায় মাত্র একজন অসামরিক মানুষ নিহত বা আহত হয়েছে। আর সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে চার হাজার ৩১৫ জন।

ঘটনা যেমনই হোক, এটা কিন্তু ঠিক যে ড্রোনের আবির্ভাব বদলে দিয়েছে ও দিচ্ছে যুদ্ধের প্রচলিত নিয়মবিধি। বিশেষজ্ঞরা এ পরিবর্তনে আশার চাইতে আশঙ্কাই প্রকাশ করছেন বেশি। তাদের ধারণা, ড্রোনের সাহায্যে সারা বছরই অঘোষিত যুদ্ধ চলতে পারে। আর এতে যোদ্ধার চাইতে অসামরিক মানুষেরই প্রাণ যাবে বেশি। তবে কি মানুষের ভাগ্যে নেমে আসবে বিভিন্ন সায়েন্স ফিকশনে বর্ননা করা ভয়াল পরিণাম? কম্পিউটারই পরিচালনা করবে ড্রোন, চালাবে হামলা? মানবজাতি আপনসৃষ্ট প্রযুক্তির কাছে পরাভূত ও নিশ্চিহ্ন হবে? এসব প্রশ্নের জবাব লুকিয়ে আছে আগামী দিনের গর্ভে।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে