আবার আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের ড্রাগনলেডি

চীনের বিবৃতিতে বলা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ইউ-২ স্পাই প্লেনের গোয়েন্দাগিরির ফলে তাদের স্বাভাবিক মহড়া কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যহত হয়েছে - এশিয়া টাইমস

  • মেহেদী হাসান
  • ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৫:৩৩

দীর্ঘকাল পর আবার আলোচনায় এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের ড্রাগনলেডি। যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহাসিক একটি গোয়েন্দা বিমানের নাম ড্রাগনলেডি। পুরো নাম ইউ-২ স্পাই প্লেন। এর নিক নাম ড্রাগনলেডি। ৬৪ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র এয়ারফোর্স ব্যবহার করছে শক্তিশালী এ গোয়েন্দা বিমান। গত ২৫ আগস্ট চীনা নো ফ্লাই জোনে প্রবেশ করে ড্রাগনলেডি। এরপর বিশ্বব্যাপী আবার নতুন করে আলোচনায় এসেছে এ বিমানের দীর্ঘ অতীত ভূমিকার বিষয়।

রাশিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের চার দশকের বেশি সময় ধরে চলা ঠান্ডা লড়াই চলাকালে রাশিয়া, চীনসহ বিভিন্ন দেশের আকাশে যুক্তরাষ্ট্রের এরিয়েল নজরদারি করতো একটি গোয়েন্দা বিমান। এ সময় গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব মিশন পরিচালনায় অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল ড্রাগন লেডি নামে পরিচিত ইউ-২ গোয়েন্দা বিমান। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র এরিয়েল নজরদারি বৃদ্ধি করেছে চীন এবং রাশিয়ার ওপর। অতীতের মত যুক্তরাষ্ট্র ব্যবহার শুরু করেছে এই গোয়েন্দা বিমানটি।

অনেক সামরিক বিশেষজ্ঞদের মতে যুক্তরাষ্ট্রের এবারের স্পাই প্লেন গেম হতে পারে এক বিপজ্জনক খেলা। যুক্তরাষ্ট্রের এরিয়েল নজরদারির ফলে বাড়বে একে অপরের প্রতি উসকানিমূলক পদক্ষেপ। আকাশে ঘটতে পারে যুদ্ধ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনা। এ থেকে সূচনা হতে পারে ভয়ানক যুদ্ধের। ঠান্ডা লড়াইয়ের সময় রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের চারটি ড্রাগন লেডি গুলি করে ভূপাতিত করেছে। এর একটি রাশিয়ার আকাশে, একটি কিউবার আকাশে এবং দুটি তাইওয়ানের আকাশে। আর প্রতিবার রাশিয়া ব্যবহার করেছে তাদের বহুল আলোচিত এস-৭৫ মিসাইল। রাশিয়ার অভ্যন্তরে ৭০ হাজার ৫০০ ফিট উপরে টহল দেয়ার সময় রাশিয়া এস-৭৫ মিসাইলের সাহায্যে ভূপাতিত করে ইউ-২ গোয়েন্দা বিমান বা ড্রাগনলেডি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষ থেকে অপ্রত্যাশিত কোনো হামলার ঘটনা যেন না ঘটে তা প্রতিরোধের জন্য যুক্তরাষ্ট্র একটি গোয়েন্দা বিমানের প্রয়োজন অনুভব করে পর। এরপর তারা নির্মান করে ইউ-২ ড্রাগনলেডি। রাশিয়া এবং চীন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান স্পাই প্লেন গেম তথা এরিয়েল গোয়েন্দাগিরিকে আগ্রাসন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।

চীনের নো ফ্লাই জোনে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা বিমান ড্রাগনলেডির বারবার প্রবেশ এবং অবস্থানের বিরুদ্ধে মৌখিকভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছে চীন। চীনের মহড়া পরিচালনার সময় যুক্তরাষ্ট্র এ নজরদারি কার্যক্রম পরিচালনা করে। চীনের মিনিস্ট্রি অব ন্যাশনাল ডিফেন্স এর বিবৃতিতে বলা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ইউ-২ স্পাই প্লেনের গোয়েন্দাগিরির ফলে তাদের স্বাভাবিক মহড়া কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যহত হয়েছে। এতে আকাশ ও সমুদ্রে অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনার জন্ম দিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের গোয়েন্দাগিরি একটি সরাসরি উসকানীমূলক পদক্ষেপ। যুক্তরাষ্ট্রকে এ ধরনের কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার আহবান জানিয়েছে চীন।

এ বছরের ২৫ আগস্ট ড্রাগনলেডি চীনা নো ফ্লাই জোনে প্রবেশের পরদিন ২৬ আগস্ট চীন দক্ষিণ চীন সাগরে দুটি শক্তিশালী ব্যালিস্টিক মিসাইল পরীক্ষা চালিয়েছে। এ মিসাইলের নাম ডিএফ-২৬ এবং ডিএফ- ২১। মিসাইল দুটি বিমানবাহী রণতরী কিলার নামে পরিচিত।
চীনের আকাশে গোয়েন্দাগিরির কয়েক দিন আগে ১৯ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের দুটি সার্ভিল্যান্স বিমান কৃষ্ণ সাগরে টহল দেয়ার সময় বাধা দেয় রাশিয়ার এসইউ-২৭ ফাইটার জেট। যুক্তরাষ্ট্রের সার্ভিল্যান্স প্লেন কৃষ্ণসাগরে রাশিয়ার উপকূলে টহল পরিচালনা করছিল।

চার সপ্তাহের মধ্যে ছয়বার যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের টহল এবং রাশিয়ার পক্ষ থেকে তাকে বাধা দেয়ার ঘটনা ঘটে। এরপরই আবার যুক্তরাষ্ট্র এরিয়েল টহল পরিচালনা করে বাল্টিক সাগরে রাশিয়ার উত্তর উপকূলের কাছে। এরপর ২৮ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের ৬টি বি-৫২ বোমারু বিমান ন্যাটোর ৩০টি সদস্য দেশের আকাশে টহল পরিচালনা করে।
যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করেছে কৃষ্ণ সাগরে তাদের একটি বি-৫২ বোমারু বিমান টহল পরিচালনার সময় রাশিয়ান যুদ্ধ বিমান বিপজ্জনক উপায়ে বাধা দিয়েছে।

ইউএস এয়ার ফোর্সেস ইউরোপ এবং এয়ার ফোর্সেস আফ্রিকা পাবলিক এফেয়ারর্স এর বিবৃতিতে বলা হয়েছে রাশিয়ান যুদ্ধ বিমান বি-৫২ বমারের মাত্র ১০০ ফিট সামনে দিয়ে কয়েকবার উড়ে গেছে। এ ধরনের বাধা দানে মধ্য আকাশে বিমানের ভয়ানক সংঘর্ষের আশঙ্কা সৃষ্টি হয়। যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করেছে রাশিয়ান বিমানের এ ধরনের বাধা দানের ঘটনা ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইট রুলসের পরিপন্থী।

রাশিয়া চীনের আকাশ সীমার কাছাকাছি এভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনঘন স্পাই প্লেনের টহল পরিচালনা স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে দেখছেন না বিশ্লেষকরা। অনেকের আশঙ্কা আকাশে যে কোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।

রাশিয়া ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে উদ্দেশ্য করে হুমকি দিয়েছে তার দিকে ছুটে আসা যে কোনো ধরনের মিসাইলকে সে পারমানবিক বহনকারী মিসাইল হিসেবে বিবেচনা করবে। ফলে রাশিয়া তার দিকে ছুটে আসা যে কোনো মিসাইলের জবাব দেবে পারমানবিক বোমা হামলার মাধ্যমে। ইতোমধ্যে রাশিয়া কিছু পাল্টা পদক্ষেপ নেয়া শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তের কাছে আন্তর্জাতিক আকাশ সীমায় রাশিয়াও নজরদারি বাড়িয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের এ আকাশ নজরদারির জবাবে যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কার কাছে রাশিয়া কৌশলগত বোমারু বিমান টিইউ-৯৫ এর টহল দিয়েছে। এসময় রাশিয়ান বোমারু বিমানের খুবই কাছ দিয়ে উড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী জঙ্গি বিমান। যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার কোনো যুদ্ধ বিমান যখনই প্রতিপক্ষের আকাশ সীমার কাছাকাছি টহল দেয় তখনই আকাশে এনকাউন্টারের ঘটনা ঘটছে।

প্রতিবারই প্রতিপক্ষের টহল বিমানকে চ্যালেঞ্জ জানানো হচ্ছে। অপর দিকে দক্ষিন চীন সাগরে গত জুলাই মাস থেকে যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত শক্তি প্রদর্শনের পর চীনও পাল্টা শক্তি প্রদর্শন করেছে সম্প্রতি মহড়া পরিচালনার মাধ্যমে। অনেকের মতে চীনের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের ইউ-২ স্পাই প্লেনকে বাধা দেয়ার মত যুদ্ধ বিমান নেই। কিন্তু তার মানে এ নয় যে, তারা স্পাই প্লেন গুলি করে ভূপাতিত করতে পারবে না।

ঠান্ডা লড়াই চলাকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৬১ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত পরিচালনা করে অপারেশন ক্রোম ডোম। সোভিয়েত ইউনিয়নের পারমানবিক বোমা হামলা ঠেকাতে তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্রাটেজিক এয়ার কমান্ড দিনে রাতে ২৪ ঘন্টা বি-৫২ বোমারু বিমান আকাশে ভাসিয়ে রাখে পারমানবিক বোমা সজ্জিত করে। এ অপারেশনে তখন এক ডজন বি-৫২ বিমান ব্যবহার করা হয়।

সোভিয়েত ইউনিয়ন সীমান্ত বরাবর আকাশের টহলরত থাকত যুক্তরাষ্ট্রের বি-৫২ বোমারু বিমানসহ অন্যান্য বমার। এ বিমান যাতে আগেই হামলা পরিচালনা করতে পারে সে লক্ষ্যে সদা প্রস্তত থাকত বি-৫২ বমার।

এ সময় অন্যান্য বোমারু বিমানের সাথে ড্রাগনলেডি সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, ভিয়েতনাম এবং কিউবার আকাশে নিয়মিত টহল পরিচালনা ও গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করত।

ড্রাগনলেডি যুক্তরাষ্ট্র এয়ার ফোর্স, নাসা এবং গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ ব্যবহার করে। ১৯৬০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ পরিচালিত একটি ড্রাগন লেডি প্রবেশ করে রাশিয়ার আকাশ সীমায় । ড্রাগন লেডি যখন ৭৫ হাজার ৫০০ ফিট উপরে অবস্থান করছিল তখন রাশিয়া তাদের এস-৭৫ সারফেস টু এয়ার মিসাইল আক্রমন চালায় ।

এই আক্রমণের পর পাইলট প্যারাসুটের মাধ্যমে অবতরণ করতে সক্ষম হয়। তাকে গ্রেফতার করে রাশিয়া। কিউবার আকাশে টহল পরিচালনার সময় ১৯৬২ সালে একটি ড্রাগন লেডি ভ‚পাতিত করা হয়। এটিও ভ‚পাতিত করে রাশিয়া এস-৭৫ মিসাইলের সাহায্যে। এ ঘটনায় মারা যায় বিমানটির পাইলট। এরপর রাশিয়ার আক্রমনের ফলে তাইওয়ানের আকাশে বিধ্বস্ত হয় দুটি ড্রাগনলেডি বা ইউ-২ গোয়েন্দা বিমান।

ইউ-২ যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীতে যুক্ত হয় ১৯৫৬ সালে। এর গতি ঘন্টা ৫০০ মাইল। এর নির্মাতা যুক্তরাষ্ট্রের সমরাস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান লকহিড মার্টিন। লকডিহড মার্টিন ১০৪টি এ বিমান তৈরি করে। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া বৃটেন, তাইওয়ান ব্যবহার করেছে এ বিমান।

আমেরিকায় ড্রাগনলেডির কারখানা : এশিয়া টাইমস
আমেরিকায় ড্রাগনলেডির কারখানা : এশিয়া টাইমস

 

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র এয়ারফোর্সের কাছে ৩০টি ড্রাগন লেডি রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশের আকাশে এবং আকাশে সীমা বরাবর নিয়মিত গোয়েন্দাগিরি করে এসব স্পাই প্লেনের সাহায্যে। এছাড়া বিভিন্ন দেশে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের ঘাটিতে মোতায়েন রয়েছে ড্রাগনলেডি।

এ ধরনের এরিয়েল সার্ভিল্যান্সের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র তার শত্রুরাষ্ট্রের রাডার ক্ষমতা পরীক্ষাসহ বিভিন্ন ধরনের তথ্য সংগ্রহ করে। ২০১২ সালে সর্বশেষ আপগ্রেড ভার্সনের নাম ইউ-২এস। ইউ-২ গোয়েন্দা বিমানে সিগনাল ইন্টিলিজেন্স, ইমেজ ইন্টেলিজেন্স, ইলেকট্রনিক ইন্টেলিজেন্স, মিজারমেন্ট এবং সিগনেচার ইন্টেলিজেন্স এর ক্ষমতা রয়েছে। ইরাক এবং আফগানিস্তান অভিযানে ড্রাগন লেডি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সার্বক্ষনিক সঙ্গী। ইরাক অভিযানে ২০০ এর অধিক মিশন পরিচালনা করে ড্রাগনলেডি।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে