প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নতুন স্নায়ুযুদ্ধ

দক্ষিণ চীন সাগরে মার্কিন রণতরী এবং সিঙ্গাপুর নেভির জাহাজ - এএফপি

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ৩১ আগস্ট ২০২০, ১৪:৪০

বিশ্বব্যাপী স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হয়েছে সেই কবে, বিগত শতাব্দীর '৯০এর দশকে কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সাথে-সাথে। কিন্তু যুদ্ধবাজরা আছে; তারা শেষ হয়ে যায়নি। তাই বলা চলে, যুদ্ধও শেষ হয়নি। এ যুদ্ধের নাম ''নতুন স্নায়ুযুদ্ধ''।

বিশ্ব এখন ভুগছে কোভিড-১৯ মহামারী নামে এক অভূতপূর্ব স্বাস্থ্য সমস্যা এবং এ সমস্যা থেকে সৃষ্ট অর্থনৈতিক অচলাবস্থায়। এ অবস্থারও কয়েক মাস আগে চীন-মার্কিন ''নতুন স্নায়ুযুদ্ধ'' ফুঁসে উঠতে শুরু করে সাগরে। মনে হচ্ছিল যেন দু'পক্ষে শুরু হয়ে যাবে সশস্ত্র সংঘাত।

দক্ষিণ চীন সাগরে সর্বশেষ নৌ-মহড়াকালে গত ১৮ আগস্ট মার্কিন নৌবাহিনীর ডেস্ট্রয়ার ইউএসএস মাস্টিন চীন ও তাইওয়ানের বিভাজন রেখার মাঝখানের পশ্চিম পাশ অতিক্রম করে। কোনো মার্কিন সমরযানের ওই পথ পাড়ি দেয়া এই প্রথম।

এতে ভীষণ ক্রূদ্ধ হয় চীন। বলে, মার্কিনীরা যা করলো তা ''চূড়ান্ত রকমের বিপজ্জনক'' একটি কাজ। একইসাথে চীন ওই অঞ্চলে নিজ স্বার্থ ও দাবি সুরক্ষারও অঙ্গীকার করে। 'দাবি' বলতে তারা বুঝিয়েছে ভবিষ্যতের কোনো একসময় তাইওয়ানকে চীনের সাথে একীভূত করা।

মার্কিন নৌবাহিনী যা করেছে তাতে অবশ্য আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘিত হয়নি। কারণ, ওই এলাকাটি ছিল চীনের ১২ নটিক্যাল মাইল সমুদ্রসীমার বাইরে। কিন্তু তা সত্ত্বেও কাজটিকে চীন তার প্রতি সরাসরি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে। কেননা, দেশটি তাদের ২০০ নটিক্যাল মাইল বিস্তৃত 'বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে' কোনো রকম বিদেশী সামরিক উপস্থিতির বিরোধী।

এর মাঝে ঘটে যায় আরেক কাকতালীয় ঘটনা। মার্কিন নজরদারী উড়োজাহাজ ইউএস নেভি লকহীড ইপি-৩ই অ্যারিস সেকেন্ড সম্প্রতি তাইওয়ানে যায়। মার্কিন সামরিক যানের তাইওয়ান যাওয়া একটি বিরল ঘটনা। এরও আগে দু' দেশ একটি বড় ধরনের দ্বিপাক্ষিক প্রতিরক্ষাচুক্তি করে এবং মার্কিন ক্যাবিনেট কর্মকর্তারা নজিরবিহীনভাবে তাইওয়ান সফরে যান।

তাইওয়ানে যুদ্ধজাহাজ যাওয়ার পাশাপাশি জাপানে উপস্থিতি বাড়ায় যুক্তরাষ্ট্র। জাপানের দাবিকৃত জলভাগে চীনের ক্রমবর্ধমান হানার জবাব দিতে জাপান সাগরে বড় রকমের মহড়ার আয়োজন করে। ওই মহড়ায় স্টেলথ বোমারু বিমান মোতায়েন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এটা ছিল ওই অঞ্চলে প্রধান মিত্র জাপানের প্রতি মার্কিন সমর্থনের একটা প্রদর্শনী।
তাইওয়ানকে চীন তার একটি প্রদেশ মনে করে। সেই তাইওয়ানের সাথে আমেরিকার প্রতিরক্ষা চুক্তি এবং চীন সংলগ্ন সমুদ্র সীমায় মার্কিন নৌবাহিনীর ক্রমেই বেশি করে আনাগোনা মেনে নিতে পারে না চীন। তাদের কথা হলো, পরাশক্তির এসব কাজ শান্তির প্রতি বাস্তব হুমকি। চীনা পিপলস আর্মির পূর্বাঞ্চলীয় কম্যান্ডের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হুঁশিয়ার করে দেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এসব পদক্ষেপ তাইওয়ানের স্বাধীনতার সমর্থকদের হাতকেই শক্তিশালী করবে, যার ফলে সশস্ত্র সংঘাতের ঝুঁকিই বাড়বে।

উক্ত কর্মকর্তা বলেন, সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে আমরা কঠোরভাবে হুঁশিয়ার করে দিতে চাই যে, 'এক চীন' নীতির প্রতি চ্যালেঞ্জ এবং তাওয়ান প্রণালীতে অস্থিরতা সৃষ্টি করে এমন কোনো বিবৃতি ও পদক্ষেপ চীন ও আমেরিকা কারো স্বার্থেরই অনুকূল হবে না। বরং এ অঞ্চলে উভয় দেশের স্বার্থহানি ঘটাবে এবং শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রতি হুমকি সৃষ্টি করবে, যা হবে খুবই বিপজ্জনক।

তবে চীন যা-ই বলুক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু বেপরোয়া। তারা চলতি বছরই তাইওয়ান প্রণালিজুড়ে কমপক্ষে ১০টি রণতরী মোতায়েন করেছে। তাদের এ পদক্ষেপের লক্ষ্য, তাইওয়ানের বিরুদ্ধে চীনের যে-কোনো সম্ভাব্য একতরফা কার্যক্রম ঠেকানো।

যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের তৎপরতায় স্বাভাবিকভাবেই চীন বসে থাকতে পারে না। তারা ক্রমাগত হুঁশিয়ারি দিয়েই চলেছে। গত মাসে চীনের আরেকজন শীর্ষস্থানীয় সেনা কর্মকর্তা ''চীনের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ এবং তাইওয়ান প্রণালীর শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করার'' পরিণাম সম্বন্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করে দেন।

চীনের কর্মকর্তার বলছেন , ''মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পূর্ণ ভুল এবং চরম বিপজ্জনক পথে হাঁটছে। তাদের বোঝা উচিত, দুই চীন একদিন অবশ্যই একীভূত হবে। চীনা জাতির মহাজীবন লাভের আকাঙ্খা একদিন পূর্ণ হবেই।''

চীনের অভিযোগ অবশ্য তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাখ্যান করে মার্কিন ইন্দো-প্যাসিফিক কম্যান্ড। তারা বলে, আন্তর্জাতিক আইন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের 'ফ্রী অ্যান্ড ওপেন ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিক ডক্ট্রিনের' সাথে সঙ্গতি রেখেই এসব রণতরী মোতায়েন করা হচ্ছে।

উত্তপ্ত দক্ষিণ চীন সাগরে টহলরত মার্কিন ইন্দো-প্যাসিফিক কম্যান্ডের সপ্তম নৌবহরের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ১৮ আগস্ট যে মার্কিন ডেস্ট্রয়ারটি রুটিনমাফিক তাইওয়ান প্রণালী অতিক্রম করেছিল তাতে আন্তর্জাতিক আইনভঙ্গের কোনো ঘটনা ঘটেনি। এর মধ্য দিয়ে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলকে অবাধ চলাচলের জন্য উন্মুক্ত রাখার মার্কিন অঙ্গীকারই প্রতিফলিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক আইনে কোনো বাধা না-থাকলে পৃথিবীর যে-কোনো স্থানেই মার্কিন নৌবাহিনী এ ধরনের তৎপরতা চালাবে। জাপানের সমুদ্র প্রতিরক্ষা বাহিনীর সাথে মার্কিন নৌবাহিনীর যৌথ মহড়ার পরপরই মার্কিন ডেস্ট্রয়ারটি চীনের জলভাগ অতিক্রম করে।

জাপানের সাথে মহড়াকালে মার্কিন নৌবাহিনী চারটি বি-১ ল্যান্সার, চারটি এফ-১৫সি ঈগল এবং দু'টি বি-২ স্পিরিট স্টিলথ বোমারু বিমান মোতায়েন করে। পূর্ব ও দক্ষিণ চীন সাগরে চীন মহড়া দিচ্ছে এবং সামরিক উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। আমেরিকাও তার মিত্রদের সাথে আরো বেশি করে সাথে থাকার কথা জানিয়ে দিচ্ছে। তারা দেখাতে চায় ইন্দো-প্যাসিফিক এলাকার বন্ধু ও অংশীদারদের প্রতি দায়িত্ব পালনে তারা কতটা সজাগ। মনে করা হচ্ছে, আগামী নভেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন শেষ না-হওয়া পর্যন্ত এ প্রদর্শনী চলবে।

গত ৬ আগস্ট প্রকাশিত ওয়াশিংটনভিত্তিক কংগ্রেশনাল রিসার্চ সার্ভিসের এক প্রতিবেদনে এই বলে সতর্ক করে দেয়া হয় যে, ''দক্ষিণ চীন সাগরের ওপর চীন কার্যকর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছে। এই এলাকাটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র ও অংশীদারদের কাছে কৌশলগত, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

প্রতিবেদনটিতে ইন্দো-প্যাসিফিক রিজিয়নে আমেরিকান মিলিটারি পলিসিকে আরো বেশি করে সমর্থন দিতে মার্কিন কংগ্রেসকে উদ্বুদ্ধ করা হয়। এতে জাপান ও ফিলিপিনস-সহ পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার প্রতি দেয়া মার্কিন অঙ্গীকার রক্ষার কথা মনে করিয়ে দেয়া হয়। বলা হয়, চীনের পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক মুরব্বী হওয়া যেভাবেই হোক ঠেকাতেই হবে।
দক্ষিণ চীন সাগরে আরো সামরিক ঘাঁটি স্থাপন, সৈন্য চলাচল, রসদ সরবরাহ ইত্যাদি নিয়ে চীনের সাথে আলোচনার উদ্যোগ নিতেও প্রতিবেদনে মার্কিন সরকারের প্রতি আহবান জানান হয়। এতে বলা হয়, চীনের সাথে প্রতিযোগিতামূলকভাবে ট্রাম্প প্রশাসন অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে। এখন কংগ্রেসের বিচার করার পালা, এসব পদক্ষেপ কতটুকু সঠিক। কংগ্রেসকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা কি এসব পদক্ষেপ অনুমোদন, বাতিল নাকি সংশোধন করবে। মার্কিন কংগ্রেস কী করে, তা-ই এখন দেখার পালা।

বিশ্লেষকরা বলছেন কংগ্রেস যে সিদ্ধান্ত নিক না কেন আগামি দিনে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে নতুন এই স্নায়ুযুদ্ধের উত্তেজনা আরো বাড়তে থাকবে। যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে সমর উপস্থিতি বাড়াতেই থাকবে। অপরদিকে চীনও তা মোকাবিলার প্রস্তুতি নিতে থাকবে।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে