চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে ইন্দোনেশিয়া

চারদিকে যখন অঘোষিত যুদ্ধের দামামা বেজে চলেছে, তখন শির উঁচু করে মাথায় 'আমামা' বাঁধছে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়া - ইন্টারনেট

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ০৭ আগস্ট ২০২০, ১৮:২১

চীনের শক্তিমত্তাকে শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান বা অস্ট্রেলিয়ার মতো বৃহৎ শক্তিগুলোই নয়, আশপাশের অন্যান্য দেশও সন্দেহ ও ভীতির চোখে দেখছে - এ খবর আমাদের অনেকেরই খুব বেশি জানা নেই অথবা জানা থাকলেও বিষয়টাকে খুব-একটা গুরুত্বের সাথে নিই না। কিন্তু এসব দেশের সাথে চীনের সর্ম্পক যথেস্ট খারাপের দিকে যাচ্ছে। দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের ক্রমবর্ধমান তৎপরতাকে চ্যালেঞ্জ মনে করছে ইন্দোনেশিয়া এবং অনেকটা অবিশ্বাস্য শোনালেও সত্য, ভবিষ্যতের যে-কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেশটি নিজেদের আকাশ-প্রতিরক্ষাক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশও যেনো রণপ্রস্তুতি নিচ্ছে।

ইন্দোনেশিয়াকে নিজেদের সেকেন্ড হ্যান্ড ইউরোফাইটার টাইফুন জঙ্গিবিমান সরবরাহের প্রস্তাব দিয়েছে অস্ট্রিয়ান বিমান বাহিনী। ২০০২ সালে তারা এসব বিমান সংগ্রহ করেছিল। তখনই বেশি দামে এসব বিমান কেনায় দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। এসব বিমান হাতে এলে দক্ষিণ চীন সাগরে ইন্দোনেশিয়ান জলসীমায় চীনের অনুপ্রবেশ আরো ভালোভাবে ঠেকানো যাবে বলে মনে করেন ইন্দোনেশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রাবোবো সুবিয়ান্তো।

তবে সমস্যা দেখা দিয়েছে বিমানগুলোর দাম নিয়ে। এ কারণেই ১৫ টুইন ইঞ্জিনের এসব টাইফুন বিমান কেনা বিলম্বিত হচ্ছে ইন্দোনেশিয়ার। কিন্তু সুবিয়ান্তো তার পূর্বসূরিদের মতো নন। সেনাবাহিনীর সাবেক এ জেনারেল বেশ ভালোভাবে জানেন ইন্দোনেশিয়ার আকাশযুদ্ধের সক্ষমতা বাড়াতে হলে কোন-কোন সরঞ্জামের প্রয়োজন হবে। উত্তরের নৌ-সীমান্তে চীনের দিক থেকে ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনী। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সেখানে আরো গাইডেড-মিসাইল ফ্রিগেট মোতায়েন করেছেন তিনি।

নিজেদের আক্রমণের আওতা কমিয়ে আনার লক্ষ্যে ২০১৪ সালে সুমাত্রা দ্বীপে ঘাঁটি গেড়েছিল ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনী। সম্প্রতি তাদের জঙ্গি বিমানগুলো পৌঁছে গেছে জাভা সাগরের পশ্চিমাঞ্চল এবং নতুনা দ্বীপপুঞ্জের চারপাশের জলসীমায়। একে দেখা হচ্ছে ইন্দোনেশিয়ার এ যাবত কালের সবচাইতে বড় নৌ-রণকৌশলের একটি হিসেবে।

অষ্ট্রিয়ান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় তিন বছর আগেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছে যে, ২০২০ সালের মধ্যেই তারা তাদের বর্তমান জঙ্গি বিমানগুলো পাল্টে নতুন বিমান সংগ্রহ করবে। এর কারণ হিসেবে দেশটি জানায়, বর্তমানে অস্ট্রীয় বিমানবাহিনীর হাতে থাকা ইউরোফাইটার টাইফুন জঙ্গিবিমানগুলোর মেয়াদ ৩০ বছর। সে-পর্যন্ত বিমানগুলো রাখতে গেলে খরচ পড়বে ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার, যার বেশিরভাগই ব্যয় হবে রক্ষণাবেক্ষণে।

ইন্দোনেশিয়া যদি অস্ট্রিয়ার কাছ থেকে ইউরোফাইটার টাইফুন জঙ্গিবিমানগুলো কেনে, তাহলে তা হবে তাদের বিমানবাহিনীতে জঙ্গি বিমানবহরের তৃতীয় সারি। বর্তমানে তাদের হাতে আছে রাশিয়ায় তৈরী ১৬টি মাল্টিরোল এসইউ-২৭/৩০ জঙ্গি বিমানের একটি বহর এবং আমেরিকায় নির্মিত তিনটি লকহীড মার্টিন এফ-১৬এর আরেকটি বহর। শেষের বহরটি স¤প্রতি দক্ষিণ চীন সাগরের আকাশে টহল দেয়।

এর বাইরেও রাশিয়ার কাছ থেকে কয়েকটি অত্যাধুনিক সুখোই জঙ্গি জেট বিমান কেনার উদ্যোগ নিয়েছিল ইন্দোনেশিয়া। তবে রাশিয়ান জেট বিমান ও মিসাইল কিনলে আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে - এমন আশঙ্কায় উদ্যোগটি এখন অচল হয়ে আছে।

ইন্দোনেশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সুবিয়ান্তো ইতিমধ্যে সেকেন্ড হ্যান্ড ইউরোফাইটার টাইফুন জঙ্গিবিমানগুলো কেনার ব্যাপারে তার অস্ট্রিয়ান প্রতিপক্ষ ক্লাউডিয়া ট্যানেরের সাথে কথা বলেছেন। যদি বিক্রি চূড়ান্ত হয়, তাহলে আশা করা হচ্ছে, ইউরোফাইটার টাইফুন জঙ্গিবিমানগুলোকে ট্র্যান্স ৩এ মানে উন্নীত করা হবে। আর তা হলে বিমানগুলো আকাশ ও ভূমি - উভয় ক্ষেত্রেই হামলার সক্ষমতা অর্জন করবে।

কেনাবেচা সম্পন্ন হলে ইন্দোনেশিয়াই হবে প্রথম এশীয় দেশ, যারা ইউরোফাইটার টাইফুন জঙ্গিবিমানের মালিক। ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের নয়টি দেশের বিমান বাহিনীতে এ ধরনের পাঁচ শতাধিক জঙ্গি বিমান রয়েছে। এ ধরনের একটি নতুন জেট বিমানের দাম ১০ কোটি মার্কিন ডলার।

কোনো-কোনো বিশ্লেষক ইন্দোনেশিয়ার ইউরোফাইটার টাইফুন জঙ্গিবিমান সংগ্রহকে দেখছেন অন্তবতীকালীন সংগ্রহ হিসেবে। কারণ, এর পরে কোনো এক সময় ইন্দোনেশিয়ার হাতে আসার কথা কেএফএক্স/আইএফএক্স জঙ্গি বিমান। ২০১০ সাল থেকে ইন্দোনেশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার যৌথ উদ্যোগে এসব বিমানের নির্মাণকাজ চলছে। এ কাজ করে চলেছে কোরিয়ান অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ এবং পিটি দিরগানতারা ইন্দোনেশিয়া।

নতুন জঙ্গি বিমানগুলোর প্রথম পরীক্ষামূলক উড্ডয়নের কথা রয়েছে ২০২২ সালে। ইন্দোনেশিয়া আশা করছে তারা এ রকম ৪৮টি বিমান কিনবে। প্রতিটি বিমানের দাম পড়বে ৫০ থেকে ৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

টাইফুনের দিকে চোখ পড়ার আগে ইন্দোনেশিয়ান মন্ত্রীর নজর কাড়ে ফ্রান্সের উদ্ভাবিত ডাসাল্ট রাফায়েল মাল্টিরোল জঙ্গি বিমান। এর আগে ব্রিটেন, ইটালি, স্পেন ও জার্মানির সাথে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ইউরোফাইটার নির্মাণ কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছিল ফ্রান্স। কিন্তু শরীকদের সাথে বিরোধে ওই কর্মসূচি ভেস্তে গেলে ফ্রান্স নিজের জন্য উদ্ভাবন করে দাসাল্ট রাফায়েল মাল্টিরোল জঙ্গি বিমান।

ইন্দোনেশিয়ান প্রতিরক্ষামন্ত্রী সুবিয়ান্তো কিন্তু রাশিয়ার কাছ থেকে ১১টি এসইউ-৩৫ জঙ্গি বিমান কেনার চুক্তি প্রায় চূড়ান্ত করে এনেছিলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে প্রেসিডেন্ট জোকো উইদাদোর হস্তক্ষেপে চুক্তিটি আর হতে পারেনি। রাশিয়ার সাথে এ চুক্তি হলে আমেরিকার প্রতিক্রিয়া কী হবে, তা নিয়ে প্রেসিডেন্ট উইদাদো উদ্বিগ্ন ছিলেন। তিনি ভয় পাচ্ছিলেন, এর বিরূপ প্রভাব পড়বে যুক্তরাষ্ট্র-ইন্দোনেশিয়া বাণিজ্যর ওপর।

তবে আপডেটেড এফ-১৬ভি কিনতে গিয়ে সুবিয়ান্তোকে কোনো রকম মার্কিন চাপের মুখে পড়তে হয়নি। ১৯৭০এর দশকের গোড়ার দিকে উদ্ভাবিত এক ইঞ্জিনের এ জঙ্গি বিমান ৭৬টি শত্রুবিমানকে গুলি করে ভূপাতিত করেছে, আর নিজে ভূপাতিত হয়েছে একবার।

এখানে বলা ভালো যে, পূর্ব তিমুরে ইন্দোনেশিয়ান সামরিক বাহিনীর বাড়াবাড়ির অভিযোগে মার্কিন সরকার ওই দেশের কাছে মার্কিন অস্ত্র বিক্রির ওপর ১৫ বছরের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তখনই হুঁশ ফেরে ইন্দোনেশিয়ার। তারা বিভিন্ন দেশ থেকে অস্ত্র সংগ্রহের গুরুত্ব বুঝতে পারে এবং সে-ব্যাপারে তৎপর হয়।

এমন অবস্থায় মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের অযাচিত এক সিদ্ধান্তের মাজেজা কী, বুঝতেই পারছেন না প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা। ওই সিদ্ধান্তে ইন্দোনেশিয়াকে ২০০ কোটি ডলার দামে আটটি বেল-বোয়িং এমভি-২২ অসপ্রে টিল্ট-রোটর ট্রান্সপোর্ট প্লেন এবং এর সরঞ্জাম কেনায় সম্মতি দেয়া হয়েছে। এতে উভচর অভিযানে সহায়ক ও ত্রাণবাহী বিমান হিসেবে অসপ্রে-র গূণপনা বয়ান করা হলেও সিদ্ধান্তটি সবাইকে বিস্মিত করে। কারণ, প্রতিরক্ষামন্ত্রীর ''উইশ লিস্ট'' বা কাঙ্খিত সামরিক সরঞ্জামের তালিকায় এ বিমানের নাম কখনোই ছিল না। ফলে ইন্দোনেশিয়ান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সেক্রেটারি-জেনারেল, সাবেক এয়ার মার্শাল দন্নি তাউফান্তো জানিয়ে দেন, অসপ্রে বিমান কেনার কোনো পরিকল্পনা ইন্দোনেশিয়ার নেই।

এর আগে ২১ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে মিডিয়াম-লিফট ইউএইচ-৬০ বø্যাক হক প্রায় কিনতে বসেছিল ইন্দোনেশিয়া। পরে দামের কথা ভেবে পিছিয়ে যায় তারা। এর বদলে সেনাবাহিনীকে ১৫টি রাশিয়ান এমআই-১৭ভি৫ ট্রান্সপোর্ট ওয়ার্কহর্স বিমান কিনে দেয়ার কথা ভাবছে সরকার। এগুলোর দাম মার্কিন বø্যাক হকের তিন ভাগের এক ভাগ আর সৈন্য পরিবহনক্ষমতা দ্বিগুণ।

ইন্দোনেশিয়া অতি সম্প্রতি ৭৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে আটটি সফিস্টিকেটেড অ্যাপাচে এএইচ-৬৪ অ্যাটাক হেলিকপ্টার কিনেছে, যার সমালোচনা করেছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা। একইভাবে তারা সমালোচনা করেছেন ১০০টি জার্মান লিওপার্ড ট্যাঙ্ক কেনারও। বলেছেন, বেশিরভাগ রাস্তা ও সেতুর পক্ষে এসব ট্যাঙ্কের ভার বহন করা সম্ভব হবে না।

কিন্তু মনে হয় উভয় ক্ষেত্রেই সমালোচনার লক্ষ্য হচ্ছে, অস্ত্রশক্তিতে ইন্দোনেশিয়া যেন প্রতিবেশী সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডকে ছাড়িয়ে যেতে না-পারে। কারণ, তাহলে দেশটির বহিঃ প্রতিরক্ষাক্ষমতা ছড়িয়ে পড়বে বিশাল দ্বীপপুঞ্জে, যার আয়তন ১৯ লাখ বর্গকিলোমিটার।

যদিও করোনা অতিমারীর কারণে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ইন্দোনেশিয়ার সামরিক ব্যয় সাময়িকভাবে সঙ্কুচিত হয়ে এসেছে, কিন্তু দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের ক্রমবর্ধমান আগ্রাসী তৎপরতা ইন্দোনেশিয়াকে বাধ্য করছে তার সমুদ্রসীমা রক্ষায় আরো বেশি করে নজর দিতে।

এ কারণেই হয়তো বা, গত মে মাসে জাতিসংঘকে দেয়া এক কূটনৈতিক নোটে ইন্দোনেশিয়া সাফ জানিয়ে দেয়, 'সমুদ্রসীমা অধিকার ও স্বার্থের মনগড়া দাবি তুলে চীন এ নিয়ে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার যে প্রস্তাব দিয়েছে, তা গ্রহণ করার কোনো ইচ্ছা ইন্দোনেশিয়ার নেই। কেননা, আন্তর্জাতিক আইনে চীনের দাবির কোনো ভিত্তি নেই। জুলাই মাসের শেষার্ধে নতুনা দ্বীপপুঞ্জের চারপাশ ঘিরে স্মরণকালের সর্ববৃহৎ নৌমহড়া করেছে ইন্দোনেশিয়া। এতে অংশ নেয় ২৯টি রণতরী, ১৯টি জঙ্গি বিমান ও মেরিন ল্যান্ডিং ক্র্যাফট।

এদিকে ইন্দোনেশিয়ার শক্তি সঞ্চয়ের মড়ায় তাদের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্ক এসপার যে-কোনো সময় ইন্দোনেশিয়া সফরের ঘোষণা দিয়েছেন।

পরিস্থিতি বিবেচনায় বলা যায়, চারদিকে যখন অঘোষিত যুদ্ধের দামামা বেজে চলেছে, তখন শির উঁচু করে মাথায় 'আমামা' বাঁধছে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়া। সময়ই বলে দেবে কত দূর যাবে বা যেতে পারবে দেশটি।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে