প্রতিরক্ষা শিল্পে তুরস্কের অবাক সাফল্য

ইস্তানবুলে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বক্তব্য দিচ্ছেন - আনাদুলো

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ০৬ আগস্ট ২০২০, ১৯:০৪

মুসলিম দেশগুলো মাটির নিচে পাওয়া অঢেল অর্থ বিলাসব্যসনে ব্যয় করছে - এমন একটা ঢালাও অভিযোগ বরাবরই ছিল। বলা হতো, শত্রু যখন সমরসজ্জা করছে, মুসলিম দেশের নেতারা তখন সুখনিদ্রায় মগ্ন।

একসময় এ অভিযোগের সত্যতা থাকলেও এখন অনেক মুসলিম দেশেরই হুঁশ ফিরেছে। অনেক দেশই এখন অস্ত্রশিল্প ও সম্ভাব্য সমরায়োজনের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারছে। এ রকমই একটি দেশ তুরস্ক। তেলের টাকায় ধনী না-হয়েও এ দেশের প্রতিরক্ষা শিল্প খাত বহু পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে। তবে দীর্ঘ পথ পরিক্রমার বড় অংশজুড়ে তারা ছিল বিদেশনির্ভর। এখন সেই নির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে চাইছে দেশটি।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্প খাত প্রমাণ করেছে যে, নানা ধরনের অত্যাধুনিক অস্ত্রের ডিজাইনিং ও নির্মাণে ব্যাপক সক্ষমতা অর্জন করেছে তারা। তুর্কী কর্মকর্তারা এখন তাই বলছেন, মিলিটারি হার্ডওয়্যারের জন্য বিদেশী উৎস ও সরবরাহকারীদের ওপর তুরস্কের যে নির্ভরতা ছিল, নবলব্ধ সক্ষমতা তার অবসান ঘটাতে চলেছে।

তুর্কী কর্মকর্তাদের এ কথায় খানিকটা আতিশয্য থাকলেও তা একেবারে ভুল নয়। বাস্তবতা হলো, বড় রকমের মিলিটারি হার্ডওয়্যার ও প্রযুক্তির জন্য তুরস্ককে আরো কিছুটা সময় বিদেশী উৎসের ওপর নির্ভর করতে হবে। পাশাপাশি এটাও বাস্তব যে, প্রতিরক্ষাশিল্পে বিদেশনির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে প্রাণপণে লড়ে যাচ্ছে তুরস্ক নামের দেশটি।

আগামী ২০২৩ সাল হচ্ছে তুর্কী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার শতবার্ষিকী। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েব এরদোয়ান ঘোষণা করেছেন, ২০২৩ সালের আগেই দেশের প্রতিরক্ষাশিল্পের সবরকম বিদেশনির্ভরতা নির্মূল করার পরিকল্পনা নিয়েছে তুরস্ক।

তবে তুরস্ক ২০২৩ সালের, এমনকি চলতি দশক শেষ হওয়ার আগেও পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন করতে পারবে - এমনটি মনে করছে না অনেকেই। কারণ, তাদের সামরিক প্রকল্পগুলোর বেশিরভাগেরই এখন পর্যন্ত বিদেশী দক্ষতা, হার্ডওয়্যার ও প্রযুক্তির ব্যাপক প্রয়োজন রয়েছে।

তুরস্কের মিলজেম ন্যাশনাল ওয়ারশিপ প্রজেক্টের কথাই ধরা যাক। এ প্রকল্পে তুর্কী নৌবাহিনীর জন্য নতুন ধরনের মাল্টিপারপাস ফ্রিগেট ও করভেট নির্মাণ করা হয়। এগুলোর কোনোটি বিমানবিধ্বংসী, কোনোটি সাবমেরিনবিধ্বংসী যুদ্ধের উপযোগী। এই আকর্ষণীয় ও উচ্চাভিলাষী প্রকল্পটি তুর্কী নৌবাহিনীর আকার ও শক্তিমত্তা - দু'টোই বাড়িয়ে দিয়েছে।

তারপরও এ প্রকল্পটি শতভাগ দেশীয় হওয়া থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে। কেননা, এর মাত্র ৬০ ভাগ সরঞ্জামই দেশীয়। এছাড়া তুরস্কের নৌবাহিনীতে যুক্ত হতে যাচ্ছে টিসিজি আনাদোলু নামে নতুন একটি উভচর রণতরী। তুর্কী নির্মাণকৌশলের সাথে সমন্বয় করা হলেও এর ডিজাইন হুবহু স্পেনের রণতরী জুয়ান কার্লোস-১এর মতোই।

তুরস্কের টি১২৯ এটিএকে অ্যাটাক হেলিকপ্টারগুলোও স্পষ্টতই অগাস্টা ওয়েস্টল্যান্ড এ১২৯ হেলিকপ্টারের মতোই। তবে এর বাইরের দিকটা সাজানো হয়েছে তুরস্কের তৈরী আকাশযানের মতো করেই।

এ ক্ষেত্রে তুরস্কের বিদেশনির্ভরতার দিকটি করুণভাবে ফুটে ওঠে তখনই, যখন তারা এ ধরনের ৩০টি হেলিকপ্টারের একটি বহর দেড় বিলিয়ন মার্কিন ডলার দামে পাকিস্তানের কাছে বিক্রি করতে যায়। তখনই তাদের মনে করিয়ে দেয়া হয় যে, এসব হেলিকপ্টার বিক্রি করতে হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক্সপোর্ট লাইসেন্স প্রয়োজন হবে। কারণ, হেলিকপ্টারগুলোতে রয়েছে মার্কিন-নির্মিত ইঞ্জিন পার্টস।

তুরস্ক শিগগিরই পেতে যাচ্ছে আল্টে মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্ক। নতুন এই ট্যাঙ্ক পুরনো দিনের বিপুলসংখ্যক লিওপার্ড সেকেন্ড ও এম৬০ প্যাটন ট্যাঙ্কের জায়গা নেবে, পাশাপাশি বিদেশেও রফতানি হবে। তবে কথা হলো, এগুলো দক্ষিণ কোরিয়ার কে২ ব্ল্যাক প্যান্থারের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। তাদের টি-১৫৫ আর্টিলারি গানগুলোও দক্ষিণ কোরিয়ার কে-২ থান্ডার সিস্টেমের ওপর নির্ভরশীল, যদিও ওতে কিছু দেশীয় যন্ত্রাংশ যোগ এবং তুর্কী স্টাইলে মোডিফাই করা হয়েছে।

বিদেশী রাষ্ট্রগুলোর আচরণও এ ক্ষেত্রে উল্লেখের দাবি রাখে। যেমন, ব্রিটেনের কাছ থেকে পঞ্চম প্রজন্মের এফ-৩৫ জয়েন্ট স্ট্রাইক ফাইটার প্রোগ্রাম পাওয়ার চুক্তি ছিল তুরস্কের। কিন্তু ব্রিটেন চুক্তিটি স্থগিত করেছে। তুরস্কের 'অপরাধ', তারা রাশিয়ার কাছ থেকে অত্যাধুনিক এস-৪০০ এয়ার ডিফেন্স মিসাইল কিনেছে। ব্রিটেনের এ পদক্ষেপের ফলে আগামী অন্তত এক দশকের মধ্যে তুরস্কের পঞ্চম প্রজন্মের ফাইটার জেটের মালিক হওয়ার আশা তিরোহিত হয়ে গেল।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান দাবি করেছেন যে তার দেশ অদূর ভবিষ্যতে নিজেদের টিএআই টিএফ-এক্স প্রকল্প সম্পন্ন করবে অথবা রাশিয়ার কাছ থেকে এসইউ-৫৭ কিনবে। তবে প্রেসিডেন্ট যা-ই বলুন, এ দু'টির কোনোটিই এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান হচ্ছে না।

টিএফ-এক্সকে একটি সফল ফিফথ জেনারেশন ফাইটার জেট বিমান করতে গিয়ে তুরস্ককে নানা রকম বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে। প্রধান বাধাটি হলো, এর জন্য উপযুক্ত একটি ইঞ্জিনের ডিজাইন তৈরি এবং ইঞ্জিনটি বানানো। সাময়িক সমাধান হিসেবে ২০১৮ সালে তারা জেনারেল ইলেক্ট্রিকের এফ১১০ ইঞ্জিন ব্যবহারের ঘোষণাও দিয়েছিল।

সত্যি বলতে কী, একটি কার্যকর ও শব্দহীন ফিফথ জেনারেশন ফাইটার জেট বিমানের জন্য ফিফথ জেনারেশন ইঞ্জিন অবশ্যই প্রয়োজন। আর এর ডিজাইন ও নির্মাণকাজটিও চরম কঠিন। প্রায় এক দশক চেষ্টা করেও তার এসইউ-৫৭এর জন্য এ রকম একটি ইঞ্জিন বানাতে পারেনি রাশিয়া।

টি১২৯ হেলিকপ্টার। ছবি : এমিন সানসার, আনাদুলো
টি১২৯ হেলিকপ্টার। ছবি : এমিন সানসার, আনাদুলো



তা হোক, তবুও চেষ্টার বিরাম নেই তুরস্কের। টিএফ-এক্স বানানোর লক্ষ্যে ২০১৭ সালে ব্রিটেনের সাথে প্রাথমিকভাবে ১৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি চুক্তি করে তুরস্ক। ২০১৯ সালে রোলস-রয়েসও এ ইঞ্জিন বানানোর লক্ষ্যে পুরনো প্রস্তাবটি নতুন করে দেয় তুরস্কের কাছে। এতে তুরস্কও আগ্রহ দেখায়। এ ক্ষেত্রেও বাস্তবতা হলো, ইঞ্জিনটি তৈরি করতে বহু বছর লেগে যাবে। কেননা, এর আগে এফ-৩৫ বিমানের জন্য এফ১৩৬ টার্বোফ্যান ইঞ্জিন তৈরির একটি যৌথ প্রকল্পে অংশ নিয়েছিল রোলস রয়েস। জেনারেল ইলেকট্রিকের সাথে নেয়া ওই প্রকল্পটি প্রায় এক দশক আগে স্থবির হয়ে পড়ে। এ রকম অসম্পূর্ণ অভিজ্ঞতায় ভর করে কতোটা সফল হতে পারবে রোলস-রয়েস?

অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, আর যদি টিএফ-এক্সের জন্য একটি উপযুক্ত ইঞ্জিন বানানোর কাজে রোলস-রয়েস সফলও হয়, তাহলেও তারা কি তুরস্কের কাছে সেই প্রযুক্তি হস্তান্তর করবে, যা দিয়ে পরবর্তী সময়ে নিজেই ওই ইঞ্জিন বানাতে পারবে!

এ রকম অনেক সন্দেহ, দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও বাধার বিন্ধ্যাচল পেরিয়ে একটু-একটু করে এগিয়ে চলেছে তুরস্কের সামরিক কর্মসূচি। সাফল্য-ব্যর্থতার বিচার হবে পরে, আপাতত নিজেকে শক্তিশালী করার বিরামহীন চেষ্টার জন্য সাধুবাদ পেতেই পারে দেশটি।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে