রাশিয়ার সেই ব্যাকফায়ার, আমেরিকার নতুন হুমকি

সেই ব্যাকফায়ার - এয়ারফোর্স টেকনোলজি ডটকম

  • মেহেদী হাসান
  • ৩১ জুলাই ২০২০, ১৮:০৩

পঞ্চাশ বছর আগের রাশিয়ান একটি যুদ্ধবিমান নতুন করে ভয়ঙ্কর হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য। বিমানটির নাম টিইউ-২২এম। ন্যাটো এবং যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এটি পরিচিত ‘ব্যাকফায়ার’ নামে। পারমানবিক এবং প্রচলিত উভয় ধরনের বোমা বহন করতে পারে ব্যাকফায়ার।

টিইউ-২২ এম বা ব্যাক ফায়ার একটি সুপারসনিক বোমারু বিমান। স্নায়ুযুদ্ধের সময় এ বোমারু বিমান যুক্তরাষ্ট্রের নেভির বিমানবাহী রণতরীর জন্য ছিল বড় ধরনের এক আতঙ্ক। ব্যাক ফায়ার হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রের এই যুদ্ধ বিমান যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নতুন আতঙ্ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। কারন এতে যুক্ত হয়েছে দীর্ঘ পাল্লার হাইপারসনিক মিসাইল। সুপারসনিক এ বোমারু বিমান স্থল এবং সাগর উভয় ক্ষেত্রে ছুড়তে সক্ষম হাইপারসনকি মিসাইল। আর যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বর্তমানে হাইপারসনকি মিসাইল প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেই। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের গোটা নেভি এবং বিশেষ করে বিমানবাহী রণতরীর জন্য নতুন আতঙ্ক হিসেবে হাজির হয়েছে ব্যাকফায়ার ।

রাশিয়া ২০১৮ সালে ঘোষণা দেয় ৩০টি টিইউ-২২এম বোমারু বিমানকে আপগ্রেড করে হাইপারসনকি সিমাসইল বহনে সক্ষম করা হবে। ইতোমধ্যে এ মিসাইল পরীক্ষা চালানো হয়েছে টিইউ-২২ এম থেকে। ২০২১ সাল থেকে অপারেশন শুরু করবে এ বিমান। টিই-২২ এম বা ব্যাকফায়ার নির্মাণ করেছে টুপোলেভ ডিজাইন ব্যুরো। এটি একটি দীর্ঘ পাল্লার স্ট্রাটেজিক এন্ড মেরিটাইম স্ট্রাইক বমার।

ব্যাকফায়ার প্রথম আকাশে ওড়ে ১৯৬৯ সালের ৩০ আগস্ট। সোভিয়েত বিমানবাহিনীতে যুক্ত হয় ১৯৭২ সালে। সোভিয়েত এয়ার ফোর্স এবং সোভিয়েত নেভল এভিয়েশন যুক্তরাষ্ট্র বিরোধী স্নায়ুযুদ্ধের সময় ব্যবহার করে এ বিমান। সোভিয়েত এয়ার ফোর্স একে ব্যবহার করে মিসাইল ক্যারিয়ার স্ট্রাটেজিক বমার হিসেবে। অপর দিকে সোভিয়েত নেভিতে এটি পালন করে লং রেঞ্জ মেরিটাইম এন্টি শিপিং ভুমিকা। এখন পর্যন্ত রাশিয়ান এয়ারফোর্সে এবং রাশিয়ান নেভল এভিয়েশনে যুক্ত রয়েছে এ বিমান। মোট ৪৯৭টি ব্যাক ফায়অর নির্মান করা হয় । সর্বশেষ এ বিমান নির্মান করা হয় ১৯৯৭ সালে। বর্তমানে রাশিয়ান এয়ার ফোর্সের কাছে শতাধিক ব্যাক ফায়ার রয়েছে।

স্নায়ুযুদ্ধের সময় সোভিয়েত এয়ারফোর্স এবং নেভির কাছে থাকা ব্যাকফায়ার ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। নতুন শক্তি নিয়ে আবার রাশিয়ান নেভিতে ফিরে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র নেভির আতঙ্ক ব্যাকফায়ার। এর কারণ সুপারসনিক এ বিমানের ৮০ শতাংশ আপগ্রেড করা হয়েছে। অপরদিকে এ বিমানের জন্য সোভিয়েত আমলে তৈরি করা হয় এন্টি শিপ মিসাইল কে এইচ। সুপারসনিক ব্যাক ফায়ার যেমন আপগ্রেড করা হয়েছে তেমনি কেএইচ মিসাইলে আনা হয়েছে হাইপারসনিক স্পিড যার গতি শব্দের চেয়ে ৫ গুন বেশি।

সুপারসনিক ব্যাক ফায়ারের বেশ কয়েটি ভার্সন রয়েছে । যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাক ফায়ার হলো টিইউ-২২ এম৩এম। রাশিয়ান নেভিতে যুক্ত রয়েছে এ ভার্সন। টিইউ-২২ এম৩এম বিমানে স্টেলথ সক্ষমতা ছাড়া অন্য সব ধরনের আধুনিক শক্তি কৌশল যোগ করা হয়েছে। ব্যাক ফায়ারের যেমন অনেকগুলো ভার্সন রয়েছে তেমনি এর জন্য তৈরি এন্টি শিপ মিসাইলেরও অনেকগুলো ভার্সন রয়েছে।

২০১৮ সালে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন রাশিয়ার পার্লামেন্ট ডুমায় জানান, কেএইচ-৪৭এম২ কিনঝাল মিসাইলের গতি হাইপারসনিক। এর আওতা ১ হাজার ৩৬০ মাইল। আর এটি প্রচলিত এবং পারমানবিক উভয় বোমা বহনে সক্ষম। এ মিসাইল টিইউ-২২এম ৩ এম বিমান থেকে পরীক্ষা চালানো হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে টিইউ-২২এম ৩ এম সুপারসনিক বিমান থেকে ছোড়া হাইপারসনিক মিসাইল প্রতিরোধের ব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্র নেভির কাছে নেই।

ফলে পারমানবিক বোমা বহনে সক্ষম এ যুদ্ধ বিমান এখন এয়ার টু সারফেস এবং এন্টি শিপ উভয় ক্ষেত্রে ভয়ঙ্কর শক্তি নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। হাইপারসনিক মিসাইল যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এ মুহর্তে সবচেয়ে বড় হুমকি কারন তাদের কাছে এ মিসাইল প্রতিরক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র হাইপারসনিক মিসাইল গ্লাইড ভেহিক্যাল পরীক্ষা চালিয়েছে।


সোভিয়েত আমলে ব্যাক ফায়ার যেসব এন্টি শিপ মিসাইল ব্যবহার করেছে তা হলো কেএইচ-১৫ এবং কেএইচ -২২। আর বর্তমানে আপগ্রেড করা মিসাইলের নতুন নাম হলো কেএইচ ১০১, কে এইচ ৫৫৫ এবং কে এইচ-৩২, কে এইচ -৪৭ এম২। প্রতিটি এন্টি শিপ মিসাইল প্রচলিত এবং পারমানবিক উভয় বোমা বহনে সক্ষম আর এর গতি আল্ট্রা হাই। কেএইচ-৩২ মিসাইলের গতি হাইপারসনিকের ঠিক কাছাকাছি। রাশিয়ান রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা তাসের খবরে বলা হয়েছে এর গতি ম্যাক- ৫ বা শব্দের চেয়ে ৫ গুন বেশি। টিইউ-২২ থেকে এ মিসাইল ভ‚মি এবং সাগরে আক্রমন পরিচালনায় সক্ষম। এর পাল্লা ৬২০ মাইল।

ব্যাক ফায়ারের নির্মাতা টুপোলেভ ডিজাইন ব্যুরো জানিয়েছে ২০২১ সাল থেকে সংস্কার করা টিইউ-২২এম অপারেশন শুরু করবে। এর রেঞ্জ বর্তমানে ৪ হাজার ৩৫০ মাইল। এটি ১০০২ পাউন্ড ওজনের বোমা বহন করতে পারে। বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে ১ লাখ ৩০ হাজার ফিট উচ্চতায় শব্দের চেয়ে ৪ থেকে ৫ গুন বেশি গতির মিসাইল যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয়। বিদ্যমান পশ্চিমা সকল মিসাইল সিস্টেম এর কাছে অকার্যকর হয়ে যাবে।

রামিয়ার বার্তা সংস্থা তাস এবং স্পুটনিকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে সোভিয়েত আমলে ব্যবহার করা পারমানবিক বোমা বহনকারী কেএইচ-১৫ এখন ভ‚মি এবং এন্টি শিপ উভয় ক্ষেত্রে ছোড়া যায় আর একে ঠেকানো অসম্ভব। একটি ব্যাকফায়ার অনেকগুলো এ ধরনের মিসাইল বহন করতে পারে। এছাড়া ব্যাক ফায়ারের জন্য দীর্ঘ পাল্লার ক্রুজ মিসাইলও উদ্ভাবন করা হচ্ছে।

বিশ্লেষকদের মতে ব্যাক ফায়ারের কারণে যুক্তরাষ্ট্র নেভি অন্তত আগামী ২০ বছর পর্যন্ত হুমকির মুখে থাকবে। ব্যাক ফায়ারের পাইলট সংখ্যা ৪ জন। ইঞ্জিন সংখ্যা ২টি। বিমানটির দৈর্ঘ্য ১৩৯ ফিট ৪ ইঞ্চি। ইউং স্প্যান ১২৬ ফিট ৬ ইঞ্চি। উচ্চতা ৩৬ ফিট। খালি বিমানটির ওজন ৫৮ টন। মেক্সিমাম টেক অফ ওয়েট ১২৬ টন। ফুয়েল ক্যাপাসিটি ৫৪ টন। সর্বোচ্চ গতি ঘন্টায় ১ হাজার ৪শ মাইল। এর গতি শব্দের চেয়ে ১ দশমিক ৮৮ গুন বেশি বা ম্যাক ১ দশমিক ৮৮। এর ট্রাইসাইকে ল্যান্ডিং গিয়ারের কারনে অপ্রস্তুত রানওয়েতে অবতরণ করতে পারে।

পুন জ্বালানি সংগ্রহের মাধ্যমে দীর্ঘ সময় আকাশে অবস্থান করতে সক্ষম এ বোমারু বিমান। এর রয়েছে ভেরিয়েবল সুইপ উইং। ব্যাক ফায়ারের কয়েকটি ভার্সন রয়েছে। এগুলো টিইউ-২২ এম১ থেকে টিইউ-২২ এম ৪, এম আর, এম৩এম, এম আর, ডিপি প্রভৃতি।

১৯৬২ সাল থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন টিইউ-২২ এম বোমারু বিমান তৈরির কার্যক্রম শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা ১৯৬৯ সালে সোভিয়েত এ বোমারু বিমান তৈরির খবর পেয়ে যায়। ১৯৭০ সালে তারা এ বিমানের স্যাটেলাইট ইমেজ সংগ্রহ করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের এ বোমারু বিমান তৈরির খবরে ধাক্কা খায় যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা।

সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী নিকিতা ক্রুশ্চেভ এ বিমান তৈরির বিপক্ষে ছিলেন। ক্রুশ্চেভ মনে করতেন ইন্টার কন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক মিসাইল উদ্ভাবনের কারনে এ ধরনের বোমারু বিমান তেমন কাজে আসবে না। নিকিতা ক্রুশ্চেভ ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার ক্ষমতায় ছিলেন। টিইউ-২২এম ১৯৮২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর প্রথম ন্যাটো ক্যারিয়ার গ্রæপে হামলা চালায়। এরপর দ্বিতীয়বার হামলা চালায় একই বছর ১ লা অক্টোবর। একটি ক্যারিয়ার গ্রুপে একটি বিমানবাহী রণতরী এবং তার সমর্থনে ড্রেস্টয়ার, ক্রুজারসহ অন্যান্য রণতরীর বিশাল বহর থাকে।

ব্যাকফায়ার  প্রথম আকাশে ওড়ে ১৯৬৯ সালের ৩০ আগস্ট
ব্যাকফায়ার প্রথম আকাশে ওড়ে ১৯৬৯ সালের ৩০ আগস্ট

 

১৯৮৭ সালের ডিসেম্বরে আফগানিস্তানে মোতায়েন করা হয় টিইউ-২২ এম। আফগান মুজাহেদিনদের হাত থেকে খোস্ত শহর মুক্ত করার অভিযান পরিচালনা করে সোভিয়েত আর্মি। এতে অংশ নেয় টিইউ-২২ এম।

ভ্লাদিমির পুতিন ক্ষমতায় আসার পর ঘোষণা দেন ১৯৫২ সালে নির্মিত বিশ্বের একমাত্র প্রপেলার চালিত বোমারু বিমান টিইউ-৯৫কে আবার মিশন পরিচালনা করবে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার ১৯৯১ সালে শেষ বারের মত মিশন পরিচালনা করে টিইউ-৯৫ যা তারা তৈরি করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের বি-৫২ বমারের জবাবে। পুতিনের ঘোষণা অনুযায়ী ১৫ বছর পর ২০০৭ সালে টিইউ-৯৫ দীর্ঘ পাল্লার টহল মিশন শুরু করে। এসময় টিইউ-৯৫ এর সাথে মিশনে অংশ নেয় টিইউ-২২ এম।

২০১৫ সালের ১৭ নভেম্বর রাশিয়া জড়িত হয় সিরিয়া যুদ্ধে। এ যুদ্ধে রাশিয়া সিরিয়ায় ১২টি টিইউ-২২এম বোমারু বিমান মোতায়েন করে । সিরিয়ার বিভিন্ন ঘাটিতে মিসাইল হামলা চালায় রাশিয়া। ২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট সিরিয়া অভিযানে ইরানের হামেদান বিমান ঘাটি ব্যবহার করে ব্যাক ফায়ার। ২০১৭ সালের শেষ ভাগ পর্যন্ত সিরিয়ায় আসাদ সরকারের সমর্থনে রাশিয়া এ বিমান ব্যবহার করে।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে