ব্ল্যাকবার্ড : উঁচু দিয়ে উড়ে যে যুদ্ধবিমান

১৯৯৭ সালে ট্রেইনিং মিশনে ব্ল্যাকবার্ড - নাসা

  • মেহেদী হাসান
  • ২৯ জুলাই ২০২০, ১৯:১০

১৯৭৬ সালের ২৮ জুলাই ২৬ মাইল উচ্চতায় আকাশে ওড়ে একটি যুদ্ধবিমান। এসময় বিামনটির ওড়ার গতি ছিল শব্দের চেয়ে তিন ৩ গুন বেশি। নন রকেট চালিত পাইলট যুক্ত কোনো বিমান আজ অবধি আকাশের এত উচ্চতায় এত দ্রুত গতিতে উড়তে সক্ষম হয়নি।

ব্যতিক্রমী এ যুদ্ধ বিমানের নাম ব্ল্যাক বার্ড। বিমানটির পুরো নাম লকহিড এস আর -৭১ ব্ল্যাকবার্ড। এটি একটি কৌশলগত গোয়েন্দা বিমান । একই সাথে এর রয়েছে আকাশ থেকে আকাশে মিসাইল ছোড়ার ক্ষমতা। এর নির্মাতা বিশ্বখ্যাত যুক্তরাষ্ট্রের সমরাস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান লকহিড মার্টিন। যুক্তরাষ্ট্র এয়ার ফোর্স এবং নাসা ব্যবহার করে এ বিমান। এর সর্বোচ্চ গতি শব্দের চেয়ে তিন দশমিক ৫ গুন বেশি।

১৯৬০ সালে রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের একটি ইউ-২ গোয়েন্দা বিমান ভূপাতিত করে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয় খারাপ আবহাওয়ার কারনে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছে। কিন্তু রাশিয়া বিমানের গ্রেফতারকৃত পাইলট এবং বিমানের ধ্বংসাবশেষের ছবি প্রকাশ করায় বেকায়দায় পড়ে যুক্তরাষ্ট্র। এ ঘটনায় দুই দেশের সম্পর্কের মারাত্মক অবনতি ঘটে।

এরপর যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এমন একটি গোয়েন্দা বিমানের প্রয়োজন অনুভব করে যা ৯০ হাজার ফিট উপরে দ্রুত গতিতে উড়তে সক্ষম হবে এবং শত্রুর পক্ষে তা সনাক্ত করা বা আক্রমন করা সম্ভব হবে না।

বিশ্বে তখন সবচেয়ে নামকরা বিমান ইঞ্জিনিয়ার কেলি জনসনকে দায়িত্ব দেয়া হয় এমন একটি বিমানের নকশা প্রস্তুত করার জন্য। জন্ম হলো এস আর-৭১ বøাকবার্ড। এটি কেবল মাত্র গোয়েন্দা বিমান নয় বরং এয়ার টু এয়ার মিসাইল ছোড়ার ক্ষমতা যুক্ত করা হয় এতে।

এস আর-৭১ ব্ল্যাকবার্ড হলো যুক্তরাষ্ট্রের টপ সিক্রেট এ-১২ গোয়েন্দা বিমানের নতুন সংস্করন। রাডার ফাকি দেয়ার বিষয়ে অতি সক্ষমতার কারনে এস আর-৭১ কে বলা হয় স্টেলথ বিফোর স্টেলথ।

আকাশের খুব উচ্চতায় ওড়ার সক্ষমতার কারণে প্রতিপক্ষের কোনো মিসাইল একে আক্রমন করতে সক্ষম নয়। আর কোনো ধরনের বাধা ছাড়া শত্রুদেশের আকাশে উড়তে পারতো এ বিমান। আকাশের অতি উচ্চতায় উড়ার কারণে এ বিমানের পাইলটদের পরিধান করতে হয় স্পেস স্যুট, যে স্পেস স্যুট পরিধান করে মহাকাশ নভোচারীরা।

১৯৬০ সালের দুর্ঘটনার পর রাশিয়ার মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্র তৈরি করে ব্ল্যাকবার্ড। কিন্তু মজার বিষয় হলো রাশিয়ার আকাশে কখেনো ওড়েনি কোনো ব্ল্যাকবার্ড। ভিয়েতনাম ছাড়াও উত্তর কোরিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের গোয়েন্দা মিশন পরিচালনা করে ব্ল্যাকবার্ড।

১৯৮৭ সালের ২৯ জুন বাল্টিক সাগরে মিশন পরিচালনার সময় একটি এস আর ৭১ বিমানের একটি ইঞ্জিনে আগুন ধরে যায়। এসময় এ বিমানটি সুইডেনের আকাশ সীমা লঙ্ঘন করে সুইডেনে প্রবেশ করে।

৩০ বছর পর নাসা প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বিমানের ইঞ্জিনে আগুন লাগার পর রাশিয়ার সুপারসনিক মিগ-২৫ বিমান থেকে মিসাইল ছোড়ার নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু এস আর -৭১ বিমানটি সুইডেন এয়ার ফোর্সের নিয়ন্ত্রনে আসায় রাশিয়া তখন আর মিসাইল ছোডেনি। এ ঘটনায় ২০১৮ সালের ২৯ নভেম্বর সুইডেনের ৪ জন পাইলটকে পুরস্কৃত করে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনী।

এস আর -৭১ ব্ল্যাকবার্ড প্রথম আকাশে ওড়ে ১৯৬৪ সালে । যুক্তরাষ্ট্র বিমান বাহিনীতে যুক্ত হয় ১৯৬৬ সালে। বিভিন্ন দেশের আকাশ সীমায় গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনার সময় এ বিমান ২৬ মাইল পর্যন্ত উচ্চতায় অবস্থান করতে সক্ষম হয়।

২০২০ সাল পর্যন্ত বিশ্বের সর্ব উচ্চতায় এবং সর্বোচ্চ গতিতে ওড়ার রেকর্ড দখল করে আছে এসআর-৭১ ব্ল্যাকবার্ড। ১৯৭৬ সালের ২৮ জুলাই একটি ব্ল্যাকবার্ড বিমান ৮৫ হাজার ৬৯ ফিট বা ২৫ দশমিক ৯২ মাইল উচ্চতায় উড়তে সক্ষম হয়। একই দিন আরেকটি ব্ল্যাক বার্ড বিমান শব্দের চেয়ে ৩ দশমিক ৩ গুন বেশি বা ঘন্টায় ২ হাজার ১৯৩ মাইল গতিতে ওড়ার রেকর্ড স্থাপন করে।

কিছু কিছু বিমান জুম ক্লাইম্বের মাধ্যমে এ উচ্চতা অতিক্রম করলেও এ উচ্চতায় আকাশে অবস্থান করতে বা সমান্তরালে উড়তে সক্ষম হয়নি। ১৯৮৬ সালের ১৫ এপ্রিল একটি ব্ল্যাকবার্ড লিবিয়ার আকাশে শব্দের চেয়ে ৩ দশমিক ৫ গুন বেশি গতিতে ওড়ে । এটিই এখন পর্যন্ত ব্ল্যাবার্ড বা বিশ্বের কোনো যুদ্ধ বিমানের সর্বোচ্চ গতি।

১৯৭৪ সালে ১ সেপ্টেম্বর একটি ব্ল্যাকবার্ড নিউ ইয়র্ক থেকে লন্ডনে ১ ঘন্টা ৫৪ মিনিটে পৌছার রেকর্ড করে। এসময় বিমানটি ৩ হাজার ৪৬১ মাইল পথ অতিক্রম করে। প্রতি ঘন্টায় গতি বেগ ছিল ২ হাজার ৯০৮ মাইল।

সর্বোচ্চ গতির বাণিজ্যিক কমার্শিয়াল কনকর্ড এ পথ অতিক্রম করেছে ২ ঘন্টা ৫২ মিনিট। অপর দিকে বোয়িং ৭৪৭ বিমানের এ পথ অতিক্রম করতে সময় লাগে ৬ ঘন্টা ১৫ মিনিট।

১৯৭১ সালের ২৬ এপ্রিল ব্ল্যাক বার্ড টানা ১০ ঘণ্টায় ১৫ হাজার মাইল আকাশে ওড়ার রেকর্ড স্থাপন করে। এস আর -৭১ ব্ল্যাকবার্ডের রয়েছে বিভিন্ন ধরনের মডেল যা রাডার ফাকি দিতে সক্ষম। এর ইঞ্জিন সংখ্যা দুইটি। ককপিটও দুটি। আকাশে উডডয়নের অল্প সময় পরেই জ্বালানি ট্যাঙ্কার থেকে তেল সংগ্রহ করে এ বিমান।

এস আর-৭১ ব্ল্যাকবার্ডে রয়েছে সিগনালস ইন্টেলিজেন্স সেন্সর, একটি সাইড লুকিং এয়ারবর্ণ রাডার এবং ফটো ক্যামেরা। এ বিমানে রয়েছে প্রতিপক্ষের মিসাইল আক্রমন প্রতিহত করার ক্ষমতা। একই সাথে এটি একটি এয়ারবর্ণ যুদ্ধ বিমান। এতে নিযুক্ত থার্মোগ্রাফিক এবং ফেয়ারচাইল্ড ক্যামেরা পুরো মিশনের সময় সক্রিয় থাকে। বøাকবার্ড যুদ্ধ বিমানে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক কাউন্টিার মিজার।

১৯৬৮ সালের ৮ মার্চ জাপানের ওকিনাওয়া কাদেনা বিমান বন্দরে পৌছায় এস আর-৭১ ব্ল্যাকবার্ড। উদ্দেশ্য উত্তর ভিয়েতনামের আকাশে গোয়েন্দা মিশন পরিচালনা। এসময় আকাশে প্রায় ৩ হাজার ঘন্টা উডডয়ন করে মিশন পরিচালনা করে। উত্তর ভিয়েত নাম ছাড়া লাওসেও এ সময় মিশন পরিচালনা করে বøাকবার্ড। মিশন শেষে ১৯৯০ সালের মার্চ মাসে ওহাইও যাদুঘরে পাঠানো হয় এ বিমান।

ভিয়েতনামের আকাশে মিশন পরিচালনার সময় ব্ল্যাকবার্ড লক্ষ্য করে ৮০০ বার মিসাইল নিক্ষেপ করেছে ভিয়েতনামী যোদ্ধারা। তবে একটিও আঘাত করতে সক্ষম হয়নি। ব্ল্যাকবার্ড পাইলটরা জানিয়েছেন মিসাইলগুলো গাইডেড না হওয়ার কারনে অনেক সময় বিমানের ১৫০ গজ কাছ দিয়ে উড়ে গেছে। তবে উত্তর ভিয়েতনাম এবং লাওস মিশন পরিচালনার সময় ২টি ব্ল্যাকবার্ড বিধ্বস্ত হয় কারিগরি ত্রুটির কারণে। জাপানে নিয়োজিত এস আর-৭১ বিমানের নাম ছিল ‘হাব’।

ইউরোপে এস আর-৭১ বিমান মিশন পরিচালনার জন্য ব্যবহার করে যুক্তরাজ্যের মিলডেনহল বিমান ঘাটি। দুই ইঞ্জিন বিশিষ্ট এস আর -৭১ বিমানের রয়েছে তিনটি মডেল। এ বি এবং সি। প্রতি বিমানের পাইলট সংখ্যা দুই জন। বিমানটির দৈর্ঘ্য ১০৭ন ফিট। উচ্চতা ১৮ ফিট। দুই ডানার দুই প্রান্তের মাঝের দূরত্ব ৫৫ ফিট। শূন্য একটি বিমানের ওজন ৩০টন। ম্যাক্সিমাম টেকঅফ ওয়েট ৭৮ টন।

যুক্তরাষ্ট্র- রাশিয়া ঠান্ডা যুদ্ধের সময় এ বিমান সবচেয়ে দ্রুত গতিতে আর সর্বোচ্চ উচ্চতায় আকাশে উড়ে বেড়াতা। ৫৫ বছর পরও আজ অবধি এত গ্রুত গতি আর উচ্চতায় উড়তে পারে এমন কোনো বিমান নির্মিত হয়নি।

স্যাটেলাইট এবং ড্রোনের আগে এ বিমান যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু রাষ্ট্রের আকাশে উড়ে বেড়াত। শথ্রুরাষ্ট্রের পক্ষে এই বিমান চিহ্নিত করে ভূপাতিত করা সম্ভব ছিল না । এখন পর্যন্ত ৩২টি ব্ল্যাকবার্ড গোয়েন্দা বিমান নির্মিত হয়েছে। এর মধ্যে ১২টি বিধ্বস্ত হয়েছে দুর্ঘটনায়। যুক্তরাষ্ট্র বিমান বাহিনী সর্বশেষ এ বিমান ব্যবহার করেছে ১৯৯৮ সালে এবং নাসা সর্বশেষ এ বিমান ব্যবহার করেছে ১৯৯৯ সালে।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে