লাদাখ সংঘাতের পর কেন এতো অস্ত্র কিনছে ভারত

ভারতীয় সেনাবাহিনী যুক্তরাষ্ট্র থেকে জরুরি ভিত্তিতে নতুন করে ৭২ হাজার ৪শ এসল্ট রাইফেল কিনতে যাচ্ছে - ইন্টারনেট

  • মেহেদী হাসান
  • ২৭ জুলাই ২০২০, ১৮:২১

লাদাখ সংঘাতের পর অস্ত্র কেনার হিড়িক পড়েছে ভারতে। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে ৫ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ইউএস ডলারের অস্ত্র কেনার অনুমোদনের পর জরুরি ভিত্তিতে আবার ৭২ হাজার ৪০০ এসল্ট রাইফেল কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত। রাশিয়ার সাথে যৌথ উদ্যোগে সাড়ে সাত লাখ কালাশনিকভ রাইফেল তৈরি নিয়ে দেখা দিয়েছে জটিলতা। এছাড়া রাশিয়া থেকে মিগ-২৯ ও এসএই-৩০ বিমান কেনার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তীব্র সামলোচনা চলছে ভারতে।

ভারতের বিপুল অস্ত্র কেনার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দুটি কারনে সমালোচনা চলছে। প্রথম কারন হলো নির্বিচারে কেনা এসব অস্ত্রের অনেক কিছু চীন ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তেমন কাজে আসবে না। এভাবে অস্ত্র ক্রয় করা ছয় বছর আগে ঘোষিত মোদি সরকারের ‘মেক ইন ইন্ডিয়া বা আত্ম নির্ভর ভারত গড়ার নীতির বিরোধী।

১৯৯৯ সালে পাকিস্তানের সাথে কারগিল যুদ্ধের পরও তড়িৎগতিতে ভারত বিপুল পরিমান অস্ত্র ক্রয়। বিশেষজ্ঞদের মতে জরুরি প্রয়োজনের সময় আগে থেকে হাতে না অস্ত্র থাকা উচিত। কিন্তু বড় ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর এভাবে তাড়াহুড়া করে অস্ত্র ক্রয় করা করা মোটেই পরিকল্পিত নীতির পরিচয় নয়।

ভারতীয় সেনাবাহিনী যুক্তরাষ্ট্র থেকে জরুরি ভিত্তিতে নতুন করে ৭২ হাজার ৪শ এসল্ট রাইফেল কিনতে যাচ্ছে । এর আগে ২০১৯ সালে ৭শ কোটি ভারতীয় রুপি ব্যয়ে একই সংখ্যক এসল্ট রাইফেল কেনার অর্ডার দেয় ভারত। সেগুলো তারা বুঝে পেয়েছে। সম্প্রতি চীনের সাথে লাদাখে সংঘাতের পর নতুন করে অতিরিক্ত এ রাইফেল কেনার পরিকল্পনা নিয়েছে ভারত।

ভারতের হিন্দুস্তান টাইমসের খবরে বলা হয়েছে ভারতীয় আর্মির মোট ৮ লাখ এসল্ট রাইফেল দরকার । তারই অংশ হিসেবে ধারাবাহিকভাবে এসব রাইফেল কিনে পুরনো রাইফেলের স্থলে ব্যবহার করা হবে।

ভারত সাড়ে ৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে রাশিয়া, ইসরাইল এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্ত্র কেনার অনুমোদন দিয়েছে । এর মধ্যে রয়েছে রাশিয়ার ২১টি মিগ-২৯ ও ১২টি এসইউ-৩০ যুদ্ধ বিমান, এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম, মিসাইলসহ বিভিন্ন ধরনের সমরাস্ত্র। এভিয়েশেন বিশেষজ্ঞদের মতে রাশিয়ার এসব যুদ্ধ বিমান ভারতের উচু পাহাড়ি এলাকায় তেমন কাজে আসবে না।

১৯৯৯ সালে পাকিস্তানের সাথে কারগিল যুদ্ধের পরও আতঙ্কিত ভারত ব্যাপক অস্ত্র কেনে বিদেশ থেকে। ভারতের ভিন্ন ধারার অনলাইন পোর্টাল দি ওয়াইর এরে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ১১ সপ্তাহের এ সংঘাতে ভারতের ৫০০ এর বেশি সৈন্য নিহত হয় এবং এর দ্বিগুনেরও বেশি স্থায়ীভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করে। কারগিল যুদ্ধের পর ভারত ক্ষুদ্র কামান হাউইটজার, ট্যাঙ্কস, ইনফ্যান্ট্রি কমব্যাট ভিহিক্যাল, নাইট ভিশন ডিভাইসেস, টাটরাস ট্রাক-মাউন্টেট মিসাইল সিস্টেম এবং অন্যান্য অনেক অস্ত্র ক্রয় করে।

ভারতের সামরিক বিশ্লেষক মেজর জেনারেল এপি সিং বলেন, লাদাখের মত ঘটনা ঘটতে পারে সেটা বিবেচনায় নিয়ে আগে থেকেই পরিকল্পনা অনুসারে প্রয়োজনীয় অস্ত্র সংগ্রহ করে রাখা উচিত। ঘটনার পরপর এসব সংগ্রহ করে লাভ কি? প্রয়োজনের সময় হাতে না থাকলে ঘটনার পরপর আতঙ্কিত হয়ে জরুরি ভিত্তিতে সংগ্রহ করা অস্ত্র আর্মির দক্ষতা বৃদ্ধি করে না।

দি ওয়াইর এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লাদাখ ঘটনাকে কেন্দ্র করে চীনকে মোকাবেলায় মিসাইলসহ যেসব অস্ত্র কেনা হচ্ছে , তা বুঝে পেতে ২ থেকে ৩ বছর সময় লেগে যাবে। ৩৩টি যুদ্ধ বিমান পাওয়া যেতে পারে ২০২২-২৩ সালে। হালকা ট্যাঙ্ক, এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম এবং ড্রোন পেতে সময় লাগতে পারে ১৮ থেকে ৩০ মাস। আর জরুরি ভিত্তিতে অর্ডার দেয়া অস্ত্র আসতে লাগবে কয়েক মাস থেকে এক বছর। এই প্রতিবদনে বলা হয়েছে অস্ত্র আমদানী কমিয়ে স্বনির্ভর হওয়ার জন্য ৬ বছর আগে উদ্যোগ নেয়া হয় ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’। কিন্ত অব্যাহতভাবে তা অবহেলা করা হচ্ছে।

ভারতীয় আর্মির জন্য উপযুক্ত এসল্ট রাইফেল সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়া হয় ১৯৯০ এর দশকে। আর্মি তখন এর দায়িত্ব দেয় ডিফেন্স রিসার্স এন্ড ডেভেলপমেন্ট ওর্গানাইজেশন ডিআরডিওকে। এ অস্ত্র উদ্ভাবনে ডিআরডিও সময় নেয় প্রায় এক দশক এবং এর দাম পড়ে অনেক । ভারতীয় আর্মি তাদের জন্য ডিরআডিও উদ্ভাবিত ইন্ডিয়ান স্মল আর্মস সিস্টেম বা ইনসাস এসল্ট রাইফেলের অনুমোদন দেয়। কিন্তু ভারতীয় আর্মি এ রাইফেল ব্যবহারের সাথে সাথে দেখা দেয় সমস্যা।

তীব্র সংঘাতের সময় এটি জ্যাম হয়ে যায় এবং গরম আবহাওয়ায় ভাল কাজ করে না। এরপরও পরবর্তী সেনা প্রধান এটা ব্যবহার অব্যাহত রাখেন। যা ছিল কারগিল যুদ্ধের সময় পদাতিক বাহিনীর প্রধান অস্ত্র।

তবে ফ্রন্ট লাইন ইনফ্যান্ট্রি এবং রাষ্ট্রীয় রাইফেল ইউনিটকে কাউন্টার ইন্সারজেন্সি অপারেশনের জন্য দেয়া হয় কালাশনিকভ একে-৪৭। ভারত তখন বুগলগেরিয়া থেকে ১ লাখ একে-৪৭ সংগ্রহ করে রাইফেল গ্যাপ পূরনের জন্য। ভারতের উদ্ভাবিত একটি ইনসাস রাইফেলের দাম ছিল তখন ১৬ থেকে ১৮ হাজার রুপি আর একে-৪৭ এর পার ইউনিটের দাম ছিল ৪ হাজার ১৮৫ রুপি।

ভারত যেখানে নিজেই রাইফেল আমদানি করে সেখানে সে নিজেদের উদ্ভাবিত ইনসাস রাইফেল বিক্রি করেছিল নেপালের কাছে। ২০০৫ সালে এ রাইফেল নিয়ে নেপালের সাথে দ্বন্দ্ব দেখা দেয় ভারতের। নেপাল অভিযোগ করে মাওবাদীদের সাথে সংঘাতের সময় ভারতের ইনসাস এসল্ট রাইফেল ঠিকমতো কাজ করে না। ফলে রয়াল নেপাল সেনারা ব্যাপক হতাহতের সম্মুখীন হয়। নেপালের অভিযোগে ভারত আমলে না নিয়ে উল্টো চরম উষ্মা প্রকাশ করে। ভারত পাল্টা অভিযোগ করে নেপাল আর্মি এটা ঠিকমতো ব্যবহার এবং রক্ষাণাবেক্ষণ করতে পারে না।

অথচ ইনসাস রাইফেলের নানা ধরনের সমস্যার কারণে ভারতীয় আর্মিই ২০১০ সালে এটি সংগ্রহ বাতিল করে। ভারতীয় আর্মির তখন প্রয়োজন ছিলো সাড়ে সাত লাখ এসল্ট রাইফেলের। এ ছাড়া প্যারা মিলিটারি এবং রাজ্য পুলিশেরও এ ধরনের রাইফেলের প্রয়োজন দেখা দেয়।

২০১১ সালে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয় বিশ্বের ৪০টির বেশি সমরাস্ত্র প্রতিষ্ঠানের কাছে টেন্ডার পাঠায় ৬৬ হাজার মাল্টি ক্যালিবার রাইফেল সংগ্রহ এবং প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে এ রাইফেল ভারতে তৈরির জন্য। ২০১৪ সালের শেষে শেষ হয় এ উদ্যোগ এবং এর মধ্যে চারটি রাইফেল প্রাথমিকভাবে বাছাই করা হয়। ইতালী, চেক রিপাবলিক, ইসরাইল এবং যুক্তরাষ্ট্রের । কিন্তু এর একটিও ঠিক ভারতীয় আর্মির জন্য যা দরকার তা ছিল না। ২০১৫ সালে বাতিল করা হয় মাল্টি ক্যালিবার রাইফেলের টেন্ডার।

আজো ভারতীয় আর্মির সবচেয়ে বড় আর সবচেয়ে অপারেশনালি একটিভ তথা পদাতিক বাহিনী তাদের জন্য উপযুক্ত এসল্ট রাইফেল সংগ্রহ করতে পারেনি। মাল্টি ক্যালিবার রাইফেল টেন্ডার বাতিলের পর ভারতীয় আর্মি আবার উদ্যোগ নেয় এ রাইফেল সংগ্রহের । তারা চেষ্টা করে অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি বোর্ড থেকে এগুলো সংগ্রহের। কিন্তু ব্যর্থ হয় আর্মি। এরপর ২০১৯ সালের মার্চে আমেথির কাছে করওয়ায় নরেন্দ্র মোদী উদ্বোধন করেন সাড়ে সাত লাখ কালাশনিকভ রাইফেল তৈরির কাজ। রাশিয়ার কাছ থেকে লাইসেন্স নিয়ে ভারত এ রাইফেল তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে।

চীন এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দুই ফ্রন্টে যুদ্ধের জন্য ভারত এক দশক ধরে পদাতিক বাহিনীর জন্যএকটি উপযুক্ত রাইফেল সংগ্রহের চেষ্টা করছে। ভারতীয় আর্মি ৭৩ বছরের পুরনো কালশনিকভের মডেল পরিবর্তনে রাজি হয়েছে। কিন্তু উপযুক্ত এসল্ট রাইফেল সংগ্রহের কাহিনী এখনো অসম্পূর্ণ। কালাশনিকভ রাইফেল তৈরির জন্য গঠন করা হয় ইন্দো-রাশিয়ান প্রাইভেট লিমিটেড জয়েন্ট ভেনচার। ২০১৯ সালের ফেব্রæয়ারিতে নিউ দিল্লী এবং মস্কো সরকারের মধ্যে এ লক্ষ্যে চুক্তি হয়। কিন্তু চূড়ান্ত চুক্তি এখনো সম্পন্ন হয়নি।

সমস্যা দেখা দিয়েছে এর দাম নিয়ে। সর্বশেষ জুন মাসে রাজনাথ সিংয়ের মস্কো সফরেও এ বিষয়ক জটিলতা নিষ্পন্ন করা যায়নি। সমস্যা সুরাহায় ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয় একটি কস্টিং কমিটি গঠন করেছে এবং আগস্টের শেষে তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা রয়েছে।

রাশিয়া ভারতে তৈরি প্রতি কালাশনিকভ এসল্ট রাইফেল বাবদ ২০০ ডলার রয়াল্টি দাবি করেছে। ফলে সাড়ে সাত লাখ রাইফেলের জন্য ভারতকে লাইসেন্স ফি দিতে হবে ১৫ মিলিয়ন ডলার। এ ছাড়া এ রাইফেল উৎপাদনের জন্য কারখানা স্থাপন এবং উৎপাদন খরচ তো রয়েছেই। ফলে আকাশ ছোয়া দাম পড়বে প্রতিটি রাইফেলের। এতে বিস্মিত ভারতের অনেকে। জয়েন্ট ভেনচারের মাধ্যমে বছরে তৈরি হবে ৭০ হাজার রাইফেল। কিন্তু ভারতের আর্মির এখনই দরকার উপযুক্ত এসল্ট রাইফেল। ফলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৭২ হাজার এসল্ট রাইফেল সংগ্রহ শেষ হওয়ার পরপর আবার নতুন করে ৭২ হাজার এসল্ট রাইফেল কেনার উদ্যোগ নিয়েছে।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে