ইসরাইল অনেক আগেই প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েছে ইরানকে পারমানবিক বোমার অধিকারী হতে দেবে না। কারন ইরানের পারমানবিক শক্তি অর্জন ইসরাইলের অস্তিত্বের জন্য হুমকি মনে করে। গত ২ জুলাই ইরানের পারমানবিক স্থাপনায় হামলা নিয়ে ইরান এখন পর্যন্ত সরাসরি যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরাইলের নাম বলেনি। তবে সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের শীর্ষ এক কর্মকর্তা বলেছেন তাদের কাছে তথ্য আছে কিভাবে এ ঘটনা ঘটেছে। নিরাপত্তার কারনে এখন তারা এটি প্রকাশ করছে না। বিডি ভিউজ ইনফোটেইনমেন্টে স্বাগত জানাচ্ছি আমি তাসনিম হোসাইন। আজ আমরা ইরানের পারমানবিক স্থাপনায় কারা কিভাবে হামলা চালিয়েছে সে সর্ম্পকে জানাবো।
নিউ ইয়র্ক টাইমস, গাডির্য়ানসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে খুব স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে ২ জুলাই ইরানের পারমানবিক স্থাপনায় হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে ইসরাইল। স্থাপনার মধ্যে শক্তিশালী বোমা রাখা হয়েছিল এবং তা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। ইরানে জুনের ২৬ তারিখ থেকে ৪ জুলাই পর্যন্ত বিভিন্ন স্থাপনায় সিরিজ হামলার ঘটনা ঘটেছে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে একে শত্রুরাষ্ট্র কর্তৃক ইরানের বিরুদ্ধে নাশকতামূলক কাজ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। একই সাথে এ ঘটনার জের ধরে ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে আরো ব্যাপক মাত্রায় সাইবার যুদ্ধের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কারন ইরান এ ঘটনার প্রতিশোধ নেবে এটাই মনে করেন বিশ্লেষকরা।
অপর দিকে বিশ্লেষকদের দাবি ইরান যদি পারমানবিক বোমা অর্জনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে থাকে তাহলে এ ঘটনা তাকে এ পথ থেকে ফেরাতে পারবে না । ইরানের ইসফাহান প্রদেশের নাতানজ পারমানবিক স্থাপনা পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে। ইরান প্রথমে একে সাইবার এটাক এবং আগুন লাগার ঘটনা বললেও স্যাটেলাইট ইমেজে ভবনটি বিধ্বস্তের যে ছবি প্রকাশিত হয়েছে তাতে এটি পরিষ্কার যে, এখানে বড় ধরনের বোমা বিস্ফোরনের ঘটনা ঘটেছে। নাতানজে ইরানের পারমানবিক কার্যক্রম যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইল হুমকি হিসেবে দেখে আসছিল। তাই নাতানজের ঘটনা ইরানের শত্রেুরাষ্ট্রের আক্রমনের ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। ইরান মনে করছে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইল এর পেছনে রয়েছে। ঘটনার মাত্র ২ দিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও অভিযোগ করেন ইরানের এডভান্সড সেন্ট্রিফিউজ কার্যক্রম ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণকে ৫০ গুন ত্বরান্বিত করবে।
ইরানের শত্রুদের অভিযোগ ইরান পারমানবিক বোমা তৈরির কাজে জড়িত। নাতানজ স্থাপনায় তারা সেন্ট্রিফিউজ ডিভাইস ডেভেলপ এবং ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকারণ কাজ করছে। গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে একের পর ধারাবাহিক এ দুর্ঘটনা প্রমান করে যে, এটা একটি রাষ্ট্র পরিচালিত নাশকতামূলক কার্যক্রম। এ বিষয়ে ৫ জুলাই ইসরাইলের কেবিনেট মুখপাত্র প্রকাশ্যে মুখ খোলেন। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বেনি গানজ এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রী গাবি আশকেনাজি উভয়েই এ ঘটনায় ইসরাইলের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেছে। গার্ডিয়ান লিখেছে কিন্তু তাদের সতর্ক বিবৃতিতে একটা সন্দেহ তৈরি হয়েছে যে, কয়েকটি ঘটনা অন্তত দুর্ঘটনা নয়।
জেরুজালেমে একটি বৈঠকে পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেন, ইসরাইলের দীর্ঘ নীতি হলো ইরানকে পারমানবিক অস্ত্র তৈরি করতে না দেয়া। ইরানের ঘটনায় আমাদের নাম না জড়ানোই ভালো। ইসরাইলের পররাষ্ট্র মন্ত্রী গাবি ৫ জুলাই সংবাদ সস্মেলনে বলেন ইরান পারমানবিক বোমার অধিকার হবে, এটা হতে দেয়া যায় না। গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বিশ্লেষকদের মতে ২৬ জুন মিসাইল তৈরি স্থাপনায় এবং ২ জুলাই নাতানজ পারমানবিক স্থাপনায় হামলাকে দুর্ঘটনা মনে করার কোনো কারন নেই।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনেও লেখা হয়েছে ইরানের ঘটনা বিষয়ে ইসরাইলে বিরুদ্ধে অভিযোগের জবাবে ইসরাইলী কর্মকর্তারা অস্পস্ট কথাবার্তা বলছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বেনি গানটজ বলেন, সবাই সব সময় সবকিছুতে আমাদের সন্দেহ করে। কিন্তু আমি মনে করি এটা ঠিক নয়।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে মধ্যপ্রাচ্যের একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তার উদ্বৃতি করে লেখা হয়েছে নাতানজ ঘটনা ইসরাইল ঘটিয়েছে। ভবনের ভেতরে একটি বিস্ফোরক ডিভাইস বসানো হয়েছিল। আর এটি বিস্ফোরিত হয়ে এ ঘটনা ঘটেছে। ন্যাশনাল রেভুলুশন গার্ডের একজন কর্মকর্তা নিউ ইয়র্ক টাইমসে জানিয়েছেন, কেউ একজন ভেতরে বোমা বহন করে এনেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো এ বোমা ভেতরে আনা হলো কিভাবে। এ ঘটনায় এটা পরিষ্কার যে, স্থাপনায় নিরাপত্তার ঘাটতি ছিল।
২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইল নাতানজ পারমানবিক স্থাপনায় সাইবার হামলা চালায়। ইরান এবং ইসরাইলের মধ্যে যে দ্ব›দ্ব চলছে। তা আরো বেগবান হচ্ছে । আর তা শুরু করছেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। নেতানিয়াহুর দাবি ইসরাইলের স্বার্থ রক্ষায় তিনি সবচেয়ে উপযুক্ত।
নাতানজ এবং পারচিনে ইরানের পারমানবিক কর্মসূচী স্থাপনায় বিস্ফোরণ এবং আগুনে ব্যাপক অবকাঠামোগত ধ্বংস হয়েছে। এ দুটি স্থাপনা হলো ইরানের মূল ইউরোনিয়াম সমৃদ্ধকরণ এবং ব্যালিস্টিক মিসাইলের জন্য রকেট ফুয়েল তৈরির কেন্দ্র। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইল অভিযোগ করে আসছে নতুন ব্যালিস্টিক মিসাইল টেকনোলজি পরীক্ষার মাধ্যমে ইরান জাতিসংঘ রেজুলেশন এবং পারমানিবক চুক্তি ভঙ্গ করেছে।
ইরানের সুপ্রিম লিডার আয়াতুল্লাহ আলী খামেনী পারমানবিক বোমা বানানো কর্যক্রমের অভিযোগ বারবার প্রত্যাখ্যান করেছেন । ইরানের শত্রুরা নিশ্চিত যে, ইরান পারমানবিক বোমা বানানোর পথে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে।
ইরানের পারমানবিক স্থাপনায় সর্বশেষ ঘটনা কোনো দুর্ঘটনা নয় বরং তাদের শত্রুরাষ্ট্রের হামলা হিসেবে দেখা হচ্ছে। এর লক্ষ্য ইরানের পারমানবিক কার্যক্রম নস্যাৎ করা, পিছিয়ে দেয়া যাতে ইরান পারমানবিক বোমা বানাতে না পারে।
ইরানের শত্রুদের অভিযোগ ইরান এ ভবনে এডভান্সড সেন্ট্রিফিউজ সিস্টেম কার্যক্রম পরিচালনা করছে। আর এটি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ এর গতি ৫০ গুন পর্যন্ত বাড়াতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের বিশ্লেষকদের দাবি এখানে ইউরেনিয়ামকে নিউক্লিয়ার ফুয়েলে পরিণত করার কাজ হচ্ছিল।
নাতানজ পারমানবিক স্থাপনা এর আগে ২০০৭ সালে সাইবার হামলার শিকার হয়। এ সাইবার আক্রমনে কমপক্ষে ১০০ সেন্ট্রিফিউজের কোড মুছে যায় এবং ধ্বংস হয়ে যায়। নিউ ইয়র্ক টাইমসসহ বিভিন্ন গণামধ্যমের খবর হলো এ ঘটনা ঘটিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইল।
২০১২ সালের ১ জুন নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, অফিস শুরুর এক মাসের মধ্যেই বারাক ওবামা ইরানের বিরুদ্ধে শক্তিশালী সাইবার আক্রমন পরিচালনার নির্দেশ দেন। বুশের সময় থেকে এ আক্রমন শুরু হয় এবং এর কোড নাম দেয়া হয় অলিম্পিক গেমস। আর ২০০৭ সালে ইরানের নাতানজ সাইবার হামলার নাম স্টক্সনেট।
ইসরাইলের গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক ২০১৮ সালে তেহরানের একটি সংরক্ষিত এলাকা থেকে ইরানের পারমানবিক কার্যক্রম বিষয়ক অর্ধটন রেকর্ড হাতিয়ে নেয় । আর এ তথ্য মোসাদ সরবরাহ করে ইন্টারন্যশনাল এটমিক এনার্জি এজেন্সির কাছে। ২ জুলাই নাতানজ বিস্ফোরনে ভ‚মির উপরের অংশের অনেক নিউ সেন্টিফিউজ ডিভাইস যেটা সুপারসনিক গতিতে ঘুরছিল তা ধ্বংস হয়েছে।
ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর প্রতিপক্ষ আভিগদর লিবারম্যান ইরানের এ ঘটনার জন্য দায়ী করেছেন ইসরাইলের গোয়েন্দ সংস্থা মোসাদের প্রধান ইয়োসি কোহেনকে। রেডিও সাক্ষাতকারে আভিগদর বলেছেন, মোসাদ প্রধান কোহেন প্রস্তুত হচ্ছেন রাজনীতিতে নামার। তিনি লিকুদ পার্টিতে নেতানিয়াহুর উত্তরসুরি হতে চান।
ইসরাইলের দাবি তারা ইরানের অনেকগুলো সাইবার এটাক নস্যাত করে দিয়েছে চলতি বছর। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল এপ্রিলে ইসরাইলের ওয়াটার প্লান্ট সিস্টেমের ওপর হামলা। অনেকের অভিযোগ ইরানের ওপর সর্বশেষ হামলা ইসরাইল প্রতিশোধ হিসেবে চালিয়েছে। ফলে ইরানও এ হামলার উপযুক্ত জবাব দেয়ার উদ্যোগ নেবে। ফলে দুই দেশের মধ্যে ভয়াবহ সাইবার যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
ইরান মনে করে ইসরাইল তাদের এ হামলার কথা তাদের সবচেয়ে ঘণিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়েছে । ফলে ইরান এ আক্রমনকে তাদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইল যৌথ হামলা মনে করে।
৫ জুলাই ইরাকে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক ও সামরিক অবকাঠামো এলাকায় ২টি রকেট আক্রমনের ঘটনা ঘটে। একে ইরান সমর্থিত যোদ্ধাদের কাজ মনে করা হচ্ছে। জুনের শেষ দিকে ইরাক সরকার ১৪জন ইরান সমর্থিত যোদ্ধা আটক করে। তারা ইরাকের গ্রিন জোনে হামলার পরিকল্পনা করছিল বলে অভিযোগ আনা হয়েছে। অনেকের মতে ৫ জুলাই ইরাকে হামলা ইরানের প্রতিশোধের একটি অংশ ।
নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে বর্তমানে দুর্নীতির বিচার চলছে। এতে দোষী হলে তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হতে পারে। আর এতে শেষ হয়ে যেতে পারে তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার। এ পরিস্থিতিতে ইরানের এ ঘটনা নেতানিয়াহুর জন্য সুফল বয়ে আনবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। কারন ইসরাইলে যে কয়জন ক‚টবুদ্ধির রাজনীতিবিদ রয়েছেন নেতানিয়াহু তার মধ্যে অন্যতম।
ইসরাইলের জন্য প্রধান হুমকি হলো ইরান। আর ইরান যদি পারমানবিক বোমার অধিকারী হয় সেটা ইসরাইলের অস্তিত্বের জন্য হুমকি। নেতানিয়াহু ইসরাইলের এমন এক গুরুতর শত্রু রাষ্ট্রের পারমানবিক স্থাপনায় আঘাত করে ইসরাইলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে নিজেকে অপরিহার্য প্রমানের সুযোগ নিতে এই হামলার নির্দেশ দিয়েছেন। তবে ইরান এবং পারমানু বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন ইরান যদি পারমানবিক বোমা বানানোর কাজে যুক্ত থাকে তা হলে এ ঘটনা সে কাজে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। হয়তো কয়েক মাস বা এক বছর পিছিয়ে যেতে পারে।
বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে