ভূমধ্য সাগরে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা

পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তুর্কি জাহাজ - রয়টার্স

  • মেহেদী হাসান
  • ১৪ জুলাই ২০২০, ১৮:০২

উসমানীয়া শাসনমালে দীর্ঘকাল ভূমধ্য সাগর, কৃষ্ণ সাগর এবং এজিয়ানসাগরে ছিল তুর্কীদের নিরঙ্কুশ আধিপত্য। এ অঞ্চলের বাইরেও নৌ আধিপত্য ছিলো উসমানীয়দের। বর্তমানে ভূমধ্য সাগরে অবাধ বিচরণ চলছে পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, ফ্রান্স, ইতালিসহ এ অঞ্চলের সবগুলো দেশের নৌশক্তির। ভূমধ্য সাগর তীরের দেশগুলোর রাজনীতি আর সংঘাত ঘিরে দিন দিন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে ভূমধ্য সাগর।

ভূমধ্য সাগরে বর্তমানে বিশ্বের প্রায় সবগুলো পরাশক্তির জোরালো উপস্থিতি থাকলেও তুরস্ক চেষ্টা করছে আগের অবস্থান ফিরিয়ে আনতে। একই সাথে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর বর্তমানে রাশিয়া এখানে আবার জোরদার করেছে তাদের উপস্থিতি। তবে ভৌগোলিক কারনে সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে তুরস্ক। একই সাথে তুরস্ক গত এক দশকের বেশি সময় ধরে বৃদ্ধি করে চলেছে তাদের নৌ শক্তি। বর্তমানে তুরস্ক ভ‚-মধ্য সাগরে নৌ শক্তির দিক দিয়ে সমানভাবে পাল্লা দিচ্ছে পরাশক্তিগুলোর সাথে।

তিনটি সাগর বেষ্টিত তুরস্ক তাদের নৌ শক্তির উন্নয়নে অনেক দিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে আসছে এবং বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম সেরা একটি নৌ শক্তি হিসেবে গণ্য হচ্ছে। । তুরস্কের নৌ শক্তির প্রতি অধিক জোর দেয়ার কারন হলো তিনটি সমুদ্রে তাদের অধিকার নিশ্চিত করা। নৌ বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে তুরস্ক জোর দিয়েছে অন্যের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নিজের শক্তির ওপর দাড়াতে। আর এ ক্ষেত্রে তারা ইতোমধ্যে অনেক সফলতার পরিচয় দিয়েছে। সাগর ঘিরে নৌ শক্তি উন্নয়নের নাম দিয়েছে ‘ব্লু হোমল্যান্ড’।

পূর্ব ভূমধ্যসাগরে সাম্প্রতিক ঘটনাবলী প্রমান দিচ্ছে তুরস্কের নৌ শক্তির সক্ষমতা। এখানে তুরস্ক আঞ্চলিক শক্তি গ্রিস, গ্রিক সাইপ্রাস এবং মিশরসহ অন্যান্য শক্তির মোকাবেল করতে হচ্ছে। বিশ্বের সেরা ১০টি নৌ বাহিনীর একটি গণ্য করা হচ্ছে বর্তমানে তুরস্ক নেভি। এটি সম্ভব হয়েছে তাদের নিজস্ব পরিকল্পনা, নিজস্ব প্রযুক্তি, অস্ত্র এবং রণতরির কারনে। আঙ্কারার দীর্ঘ মেয়াদী লক্ষ্য হলো নৌ শক্তি বৃদ্ধি করা। আর এর উদ্দেশ্য হলো ভ‚মধ্যসাগর কেন্দ্রিক ভবিষ্যত আধিপত্যের লড়াই।

বর্তমানে লিবিয়ার গৃহযুদ্ধ ঘিরে রাশিয়া, ফ্রান্স, মিশর এবং গ্রিসের সাথে তুরস্কের দ্ব›দ্ব চলছে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত জাতিসংঘ সমর্থিত লিবিয়ার গভমেন্ট অব ন্যাশনাল একর্ড বা জিএনএ কে সমর্থন দিচ্ছে তুরস্ক। অপর দিকে জিএনএ বিরোধী বেনগাজীভিত্তিক হাফতার বাহিনীকে সমর্থন দিচ্ছে রাশিয়া, মিশর, ফ্রান্স, আরব আমিরাত, গ্রিস। একইভাবে সিরিয়াতেও রাশিয়া সমর্থিত আসাদ বাহিনীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে তুরস্ক।

সার্বিক পরিস্থিতিতে আঙ্কারা বর্তমানে গৃহযুদ্ধের কৌশল পরিবর্তন করেছে। আর এটি করেছে তারা পূর্ব ভ-‚মধ্য সাগরে রণতরী মোতায়েন এবং ত্রিপোলিতে ড্রোন মোতায়েনের মাধ্যমে। তুরস্ক ফ্রান্স, রাশিযা, মিশর এবং গ্রিসের সাথে নৌ শক্তির ভারসাম্য ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করেছে । এ দেশগুলো হাফতার বাহিনীকে সমর্থন দিচ্ছে। আর তুরস্কের সহায়তায় ত্রিপোলির জিএনএ সরকার এখন অগ্রসর হচ্ছে কৌশলগত উপক‚লীয় শহর সির্তের দিকে। সির্তে হলো লিবিয়ার সাবেক শাসক গাদ্দাফির জন্ম স্থান।

নৌ বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধির ওপর নির্ভর করছে পূর্ব ভূমধ্য সাগরে আঙ্কারার সমুদ্র সীমা রক্ষা এবং এখানকার তেল গ্যাস সম্পদ আহরণ। নৌবাহিনীর সহায়তায় তুরস্ক ইতোমধ্য অনুসন্ধান কাজ শুরু করেছে। তুরস্কের নেভি ফ্রিগেট গত চার মাস ধরে নিরবিচ্ছিন্নভাবে লিবিয়া উপক‚ল থেকে দূরে অভিযান পরিচালনা করছে। তুরস্কের অভিযানের মুখে গ্রিক ফ্রিগেট ঘাটিতে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছে। আর রাশিয়া টাগবোট ছাড়া অভিযান পরিচালনা করতে পারছে না। মিশর এখানে অনুপস্থিত। প্রতিরক্ষা শিল্প বিশেষজ্ঞ কেভিন স্কাই মিশরের নতুন রণতরীগুলোকে খেলনা জাহাজ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ফলে কোনো বাধা বিপত্তি ছাড়া তুরস্ক এখানে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে।

মিশর প্রেসিডেন্ট সিসি তার পূর্বসূরীদের তুলনায় মিশরের নৌ শক্তি বৃদ্ধির পরিকল্পনা নিয়েছেন। কিন্তু করোনায় আক্রান্ত হওয়ার কারনে এ শক্তি বৃদ্ধির জন্য যে বাজেট দরকার তা প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগন্য। দেশটি নৌ শক্তি বৃদ্ধির জন্য জোর চেষ্টা চালালেও তাদের প্রশিক্ষন আর প্রশিক্ষিত জনবলসহ অন্যান্য ঘাটতি রয়েছে। গ্রিস আর গ্রিক সাইপ্রিয়ট প্রশাসন তুরস্কের সাথে এখানে বেশ বাহাসে লিপ্ত হওয়ার চেষ্টা করছে। তবে বাস্তবে তারা তুরস্ককে থামাতে তেমন কিছ‚ করতে পারছে না।

গত জানুয়ারি মাসে গ্রিক প্রধানমন্ত্রী কারিয়াকোস মিটসোতাকিস তুরস্ককে মোকাবেলায় ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেছেন। এরপর ফ্রান্স ভূমধ্য সাগরে ফ্রিগেট পাঠায় গ্রিসের প্রতি সংহতি প্রকাশের অংশ হিসেবে। গ্রিক প্রতিরক্ষা গ্রিক প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভূমধ্য সাগরের গতিবিধি পর্যবেক্ষন করছে গ্রিস এবং প্রয়োজনে তুরস্কের বিরুদ্ধে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করা হবে। তবে ফ্রান্স আর গ্রিসের এ হুমকি আঙ্কারার কাছে গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় নয়।

যুদ্ধের হুমকির পর তুরস্কের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হুলুসি আকর বলেন, আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি গ্রিস তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আসবে না। আমার মনে হয় মুখ ফসকে একটি কথা তারা বলে ফেলেছে। গত ৯শ বছরেরও বেশি সময় ধরে গ্রিস তুরস্কের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ কোনো যুদ্ধে জয় লাভ করেনি। ফ্রান্স অভিযোগ করেছে পূর্ব ভ‚-মধ্য সাগরে তুরস্কের যুদ্ধ জাহাজ থেকে তাদের রণতরীর দিকে অস্ত্র তাক করা হয়েছে। তুরস্ক এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে এবং ফ্রান্সকে উত্তেজনা সৃষ্টির জন্য অভিযুক্ত করছে।

আঞ্চলিক দেশগুলো ছাড়াও পূর্ব ভূমধ্য সাগরে রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ইতালী এবং যুক্তরাজ্যের রণতরী মোতায়েন রয়েছে। এখানে যুক্তরাষ্ট্রের নৌ বহরে ১০টির অধিক রণতরী রয়েছে। রাশিয়াকে মোকাবেলার জন্য এখানে যুক্তরাষ্ট্র রনতরী মোতায়েন রেখেছে।

সিরিয়া যুদ্ধের পর থেকে ভূমধ্য সাগরে নৌ শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে রাশিয়া। গঠন করে মেডিটারেনিয়ান নেভাল ফোর্স। সম্প্রতি মোতায়েন করে দুটি সাবমেরিন যাতে মোতায়েন রয়েছে ক্রুজ মিসাইল। মস্কোকে ভ-‚মধ্য সাগরে প্রবেশের সুযোগ দিয়েছে সিরিয়ার আসাদ সরকার। মস্কো সিরিয়ার বন্দর ব্যবহার করছে । আর সিরিয়ার কাছ থেকে রাশিয়া এ সুবিধা পেয়েছে আসাদকে সমর্থনের কারনে।

রাশিয়ার দীর্ঘ আকাঙ্খা ইউরোপের উষ্ণ জলরাশিতে পৌছানো। আর ভ‚মধ্যসাগরে প্রবেশ রাশিয়ার এ ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ। এক সময় ভ-‚মধ্য সাগরে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিচরন ছিল। কিন্তু ১৯৯১ সালে সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙ্গে যাবার পর দুর্দশাগ্রস্ত রাশিয়ার বিচরণ বন্ধ হয় এখানে। তবে আবার রাশিয়া ফিরে যেতে চাইছে তার পূর্বের অবস্থানে।

ভূমধ্যসাগরে রাশিয়ার উপস্থিতি বাড়লেও তা তুরস্কের নৌ উপস্থিতির কারনে লিবিয়ার বিদ্রোহী হাফতার বাহিনীর কোনো কাজে আসছে না। রাশিয়াকে ভুমধ্যসাগরে আসতে হয় তুরস্কের বসবরাস প্রণালী দিয়ে। যদিও এ প্রনালী অতিক্রমের অনুমতি রয়েছে রাশিয়ার। তবে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে এ প্রনালী বন্ধ করে দেয়ার এখতিয়ার রয়েছে তুরস্কের।

রাশিয়া যখন ভূমধ্যসাগরে ইউরোপের উষ্ণ জলরাশিতে পৌছতে চাইছে তখন তুরস্কের পরিকল্পনা ভূমধধ্যসাগরে উসমানী সাম্রাজ্যের প্রভাব ফিরিয়ে আনা। গোটা ভূমধধ্যসাগর অঞ্চলে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সাথে তুরস্কের লক্ষ্য নিজেকে বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। আর এ স্বপ্ন ঘিরেই তুরস্ক তার নৌ শক্তি বৃদ্ধি করে চলছে এবং ইতোমধ্যে একটি শক্ত অবস্থানে পৌঁছেছে।

তিনটি সমুদ্রে তুরস্ক তার সমস্ত অধিকার নিশ্চিত করণ, রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় বিশেষ সমর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এর নাম ‘ব্লু হোমল্যান্ড’। গত মার্চে তুরস্ক সবচেয়ে বড় সামরিক মহড়া পরিচালনা করে। ভু-মধধ্যসাগর, কৃষ্ণসাগর এবং এজিয়ান সাগরে এক সাথে ১০০ শক্তিশালী রণতরী অংশ নেয় এ মহড়ায়। মহড়ারও নাম দেয়া হয়েছে ব্লু হোমল্যান্ড।

তুরস্কের ৮৭ ভাগেরও বেশি বানিজ্য সম্পন্ন হয় সমুদ্র বন্দরের মাধ্যমে। এ ছাড়া তুরস্ক সমুদ্র সীমার মধ্য দিয়ে চলে গেছে বেশ কয়েকটি আন্ত:দেশীয় পাইপলাইন। এসব কিছুই তুরস্কের নৌ শক্তির গুরুত্ব দিন দিন বৃদ্ধি করছে। গবেষণা খাতে তুরস্কের ব্যয় সম্প্রতি আগের তুলনায় তিনগুন বৃদ্ধি করা হয়েছে। গত বছর এ খাতে তুরস্ক ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ইউএস ডলার ব্যয় করেছে।

তুরস্ক সামরিক খাতে প্রযুক্তির উন্নয়ন ইতোমধ্যে একটি প্রশসংনীয় মাত্রায় নিয়ে গেছে। ভ‚মধ্যসগারীয় অঞ্চলে তুরস্কের সাবমেরিন বহর সবচেয়ে বৃহৎ। এরপরে ইসরাইল, গ্রিস এবং মিশরের অবস্থান।

বর্তমানে তুরস্কের কাছে ১১২টি রণতরী রয়েছে। ২০২৩ সালের মধ্যে এর সাথে আরো ২৪টি নতুন রণতরী যুক্ত হওয়ার কথা রয়েছে। এর মধ্যে থাকবে চারটি ফ্রিগেট। তুরস্কের কাছে বর্তমানে ১২টি সাবমেরিন ও ১৬টি ফ্রিগেট রয়েছে।

নৌ শক্তির উন্নয়নের ক্ষেত্রে তুরস্ক প্রাধান্য দিয়েছে অন্যের ওপর নির্ভরতা কমানো। নিজস্ব প্রযুক্তি, অস্ত্র এবং নিজস্ব রণতরীর ওপর দাঁড়ানো। এ বছরই তুর্কি নৌ বাহিনীতে যুক্ত হওয়ার কথা রয়েছে নিজস্ব তৈরী প্রথম বিমানবাহী রণতরী আনাদুলু।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে