আমেরিকা থেকে মিসাইল কিনছে না জাপান

যুক্তরাষ্ট্রের প্যাট্রিয়ট মিসাইল অনেক পুরনো মডেলের - এএসপিআই

  • মেহেদী হাসান
  • ১১ জুলাই ২০২০, ২২:২৮

যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ব্যয়বহুল মিসাইল ক্রয় চুক্তি বাতিল করেছে জাপান। বর্তমানে জাপানে যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বল প্যাট্রিয়ট এবং রণতরীতে ইজেস মিসাইল ছাড়া আর কোনো মিসাইল সিস্টেম নেই। ফলে চীন ও উত্তর কোরিয়ার মিসাইল হামলার মুখে সম্পূর্ণ অনিরাপদ গোটা জাপান এবং জাপানে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের সমস্ত সামরিক ঘাটি। এ নিয়ে শঙ্কিত যুক্তরাষ্ট্র। এ অবস্থায় জাপানের মিসাইল ক্রয় চুক্তি বাতিলে বিস্মিত ওয়াশিংটন। জাপানের এই সিদ্ধান্তে ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর জাপানের নির্ভরতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

২০১৭ সালে জাপান যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে দুটি ইজেস এশোর মিসাইল সিস্টেম ক্রয় চুক্তি করে। এর আর্থিক মূল্য ৪ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ জন্য নির্দিষ্ট পরিমান অর্থও পরিশোধ করেছে জাপান। কিন্তু ২৫ জুন জাপান আকস্মিকভাবে জানিয়ে দিয়েছে তারা এ মিসাইল সিস্টেম মোতায়েন করবে না।

২০২৩ সালের মধ্যে জাপানের উত্তরে আকিতা এবং দক্ষিন পশ্চিমের ইয়ামাগুচিতে এ মিসাইল সিস্টেম মোতায়েনের কথা ছিল। উত্তর কোরিয়ার পারমানবিক বোমা এবং ব্যালিস্টিক মিসাইল হামলা প্রতিরোধে এ মিসাইল মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল জাপান। যুক্তরাষ্ট্রের এ মিসাইল সিস্টেমের মাধ্যমে গোটা জাপানকে মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেমের আওতায় আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল।

জাপানের এ সিদ্ধান্তে বিস্মিত ওয়াশিংটন। জাপান এ মিসাইল সিস্টেম মোতায়েন বাতিলের বিষয়ে অতিরিক্ত অর্থ, টেকনিক্যাল সমস্যা এবং স্থানীয় জনসাধারনের নিরাপত্তাহীনতা, পরিবেশগত সমস্যার কথা উল্লেখ করেছে।
জাপান অথনৈতিক ও কারিগরি কারন দেখিয়ে এ মিসাইল ক্রয় চুক্তি বাতিল করলেও অনেক বিশ্লেষকের মতে এর আসল কারন ভিন্ন। সেটা হলো এই মিসাইল মোতায়েনের কারনে উত্তর কোরিয়া এবং চীনের হামলার লক্ষ্যে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা আরো বাড়বে। বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্র-উত্তর কোরিয়া বা যুক্তরাষ্ট্র-চীনের যুদ্ধের মাঝখানে পড়তে চায় না জাপান। জাপানের আশংঙ্কা ইজেস মিসাইল মোতায়েন জাপানকে নিরাপদ করার চেয়ে বেশি অনিরাপদে বা নিরাপত্তাহীনতায় ফেলতে পারে।

২০১৮ সালের জুলাই মাসে রাশিয়া এবং চীন জাপানকে কঠোরভাবে হুমিয়ার করে ইজেস মিসাইল মোতায়েন না করার জন্য। দক্ষিন কোরিয়াকেও তারা একইভাবে সতর্ক করে। রাশিয়ার পক্ষ থেকে বলা হয় এ মিসাইল মোতায়েনে রাশিয়া ও চীনের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। একই সাথে এটা জাপান ও দক্ষিন কোরিয়ার নিজস্ব নিরাপত্ত কে হেয় করবে। আঞ্চলিক ভারসাম্য নষ্ট হবে। জাপান যদি এ কাজ থেকে বিরত না হয় তাহলে চীনকে সাথে নিয়ে রাশিয়া পাল্টা পদক্ষেপেরে হুমকি দেয়।

২০১৯ সালে উত্তর কোরিয়াও জাপানকে একইভাবে হুশিয়ারি দেয় যুক্তরাষ্ট্রের ইজেস মিসাইল মোতায়েনের বিরুদ্ধে। বিশ্লেষকদের মতে বর্তমানে রাশিয়া, চীন এবং উত্তর কোরিয়ার ভুমিকায় এ মিসাইল নিয়ে চাপের মুখে ছিল জাপান।

২০১৭ সালে উত্তর কোরিয়া ১৫টি ব্যালিস্টিক মিসাইল পরীক্ষা চালায়। অভিযোগ রয়েছে তখন ট্রাম্প প্রশাসন জাপানের ওপর চাপ সৃষ্টি করে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে উচ্চ মূল্যের এ মিসাইল সিস্টেম ক্রয়ের জন্য। জাপান তাতে রাজি না হলে জাপান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারেরও হুমকি দেয় ট্রাম্প প্রশাসন।

শেষ পর্যন্ত জাপান এ মিসাইল সিস্টেম কেনার সিদ্ধান্ত নিলেও অবশেষে তা দুই বছরের মাথায় বাতিল করে দিল। হোয়াইট হাউজ জাপানের সিদ্ধান্তে বিস্মিত হলেও এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেনি। সম্ভবত করোনা আর নির্বাচন কেন্দ্রিক সমস্যার কারনে ট্রাম্প বা হোয়াইট হাউজ এ বিষয়ে মুখ খুলতে পারছে না।

জাপানের এ সিদ্ধান্তে বিপদের সময় যুক্তরাষ্ট্র দেশটির ওপর কতটা নির্ভর করতে পারে তা নিয়েও যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বিশ্লেষক শঙ্কিত। চীনকে সামরিকভাবে চাপসৃষ্টির ক্ষেত্রে জাপান আদৌ কোনো সহায়তা করে কি না তা নিয়েও শঙ্কা দেখা দিয়েছে। প্রতিবেশির প্রতি আগ্রাসনের ক্ষেত্রে জাপানে অবস্থানরত যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যরা স্বাধীন ভূমিকা পালন করতে পারবে কি না এবং জাপানে অবস্থতি যুক্তরাষ্ট্রের ঘাটিসূমহ কাজে আসে কি না সে প্রশ্নও কেউ কেউ তুলেছেন । এমনকি ভবিষ্যতে চীন ও উত্তর কোরিয়ার চাপে জাপান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যও প্রত্যাহার করা হতে পারে এমন শঙ্কাও প্রকাশ করা হয়েছে।

ইজেস এশোর মিসাইল ক্রয় বাতিলের ফলে জাপান এবং জাপানে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাটি বর্তমানে চীন ও উত্তর কোরিয়ার হামলার মুখে রয়েছে বলে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্লেষকরা।

অপর যে কারনে জাপান এ মিসাইল ক্রয় চুক্তি বাতিল করেছে তা হলো জাপানের যে দুই অঞ্চলে এ মিসাইল মোতায়েনের সিদ্ধান্ত হয়েছে সেখানকার অধিবাসীরা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে। জাপানের রাজনীতিবিদরাও এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে। প্রতিবাদের কারন-এ মিসাইল মোতায়েনের ফলে ওই দুই এলাকার নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

রকেট বুস্টার, রাড়ার, মিসাইল উৎক্ষেপন ও পরীক্ষা, রেডিয়েশনজনিত পরিবেশ বিপযর্য় এবং স্থাপনার আশ পাশের এলাকার মানুষের জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

শত্রæ রাষ্ট্রের প্রতি মিসাইল ছোড়া এবং মিসাইল পরীক্ষার সময় দুর্ঘটনাবশত মিসাইল জাপানের জনবহুল এলাকায় পড়তে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে অতীতে মিসাইল বিস্ফোরনের নজরীর রয়েছে। ১৯৫৮ সালে সাতটি নাইক মিসাইল বিস্ফোরন হয় ইন্স্টলেশনের সময়। ১৯৬০ সালে নিউ জার্সিতে একটি বমার্ক মিসাইল বিস্ফোরণ ঘটে যাতে যুক্ত ছিল ১০ কিলোটন শক্তির পারমানবিক বোমা। তবে সৌভাগ্যবশত সেবার পারমানবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটেনি।

জাপানে বর্তমানে স্থল ভাগে যুক্তরাষ্ট্রের প্যাট্রিয়ট মিসাইল সিস্টেম এবং কয়েকটি ডেস্ট্রয়ারে ইজেস মিসাইল সিস্টেম মোতায়েন রয়েছে। এ ছাড়া আর কোনো মিসাইল সিস্টেম নেই।

ইজেস এশোর মিসাইল সিস্টেম মোতায়েনের সিদ্ধান্ত বাতিলের ফলে জাপান এবং জাপানে যুক্তরাষ্ট্রের সকল ঘাটি বড় ধরনের নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছে । বর্তমানে চীন এবং উত্তর কোরিয়ার মিসাইল হামলা থেকে জাপান বা জাপানে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাটি রক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই। এ নিয়ে শঙ্কিত যুক্তরাষ্ট্র।

জাপান বা জাপানে যুক্তরাষ্ট্রের আর্মি ও সামরিক ঘাটি রক্ষায় প্যাট্রিয়ট মিসাইল কাজে আসবে না। প্যাট্রিয়ট একটি দুর্বল মিসাইল সিস্টেম এবং সেটাও জাপানের কাছে যথেষ্ট পরিমান নেই । এ ছাড়া রণতরীতে যে ইজেস মিসাইল মোতায়েন রয়েছে তা যদি আরো বাড়ানো হয় তবু শত্রæর মিসাইল আক্রমন প্রতিহত করার ক্ষেত্রে তা গোটা জাপানকে এক সাথে সুরক্ষা দিতে পারবে না ।

জাপানের ওকিনাওয়ার মিসাওয়া, ইয়োকোতা এবং কাদেনায় যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিমান ঘাটি রয়েছে। মিসাওয়া ঘাটিতে রয়েছে এফ-৩৫ বিমান। আর শীঘ্রই এ ঘাটি হবে এফ-৩৫ বিমানের দ্বিতীয় বৃহৎ কেন্দ্র। এখানে আরো রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নেভল এয়ার ফ্যাসিলিটি। আর ইয়োকোসুকায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বড় একটি নৌ ঘাটি। এখানে ফরওয়োর্ড মোতায়েন করা হয় যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহী রণতরী রোনাল্ড রিগান।

যুক্তরাষ্ট্রের প্যাট্রিয়ট মিসাইল অনেক পুরনো মডেলের । অনেকবার এর সংস্করণ করা হলেও এর সফলতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে এ মিসাইল মোতায়েন রয়েছে কিন্তু ইয়েমেনের হামলা ঠেকাতে পারেনি এ মিসাইল। প্যাট্রিয়ট মিসাইল মোতায়েন থাকা সত্ত্বেও সম্প্রতি সৌদির দুটি তেল ক্ষেত্রে হামলা ঠেকাতে ব্যর্থতার পর এ মিসাইলের কার্যকারিত ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।

জাপান টাইমসের তথ্য অনুসারে বর্তমানে জাপানে যুক্তরাষ্ট্রের ৫৪ হাজার সৈন্য রয়েছে। এসব সৈন্যদের ৭৪ ভাগ খরচ বহন করে জাপান। অপর দিকে মিলিটারি বেজের তথ্য অনুসারে জাপানে যুক্তরাষ্ট্রের ২৩টি সামরিক ঘাটি রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ইজেস এশোর মিসাইল ক্রয় চুক্তি বাতিলের জাপানের সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর। যুক্তরাষ্ট্রকে না বলার জাপানের শক্তি আগামি দিনে প্রশান্তমাহসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত মিত্রতা নিয়ে নতুন ইঙ্গিত দিচ্ছে।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে