চীনের মোকাবেলায় মাঠে নেমেছে অস্ট্রেলিয়া

চীনকে মোকাবেলায় ডিফেন্স স্ট্রাটেজি বা প্রতিরক্ষা কৌশলের ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়া বড় ধরনের পরিবর্তনের ঘোষণা দিয়েছে - এশিয়া টাইমস

  • মেহেদী হাসান
  • ১০ জুলাই ২০২০, ১৪:০৪

যুক্তরাষ্ট্র, ভারতের পর এবার চীনকে মোকাবেলায় মাঠে নেমেছে অষ্ট্রেলিয়া। ভবিষ্যতে এ অঞ্চলে চীনের উত্থান আর আধিপত্য মোকাবেলায় ব্যাপক সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করেছে অস্ট্রেলিয়া। কেবলমাত্র চীনকে মোকাবেলায় অস্ট্রেলিয়া ১৮৭ বিলিয়ন ইউএস ডলার বাজেট বরাদ্দ করেছে।

অষ্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন বলেছেন, ভবিষ্যতে বিশ্ব আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের কেন্দ্রস্থল হলো ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চল। এ অঞ্চল ঘিরে চীন-যুক্তরাষ্ট্র-ভারত লড়াইয়ে অংশ নেবে অস্ট্রেলিয়া। চীনের উত্থান মোকাবেলায় সম্ভাব্য সকল পদপেক্ষ গ্রহণ করবে অস্ট্রেলিয়া। স্কট মরিসন মনে করেন চীনের কারনে ভয়াবহ অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়েছে অস্ট্রেলিয়া।

চীনকে মোকাবেলায় ডিফেন্স স্ট্রাটেজি বা প্রতিরক্ষা কৌশলের ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়া বড় ধরনের পরিবর্তনের ঘোষণা দিয়েছে। ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলে চীনের উত্থান মোকাবেলায় অষ্ট্রেলিয়া দুটি কৌশল নিয়েছে। প্রথমত নিজস্ব সামরিক শক্তি বৃদ্ধি এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ আঞ্চলিক দেশগুলোর সাথে অংশীদারিত্ব গড়ে তোলা।

বরাদ্দকৃত ১৮৭ বিলিয়ন ডলার থেকে অস্ট্রেলিয়া উল্লেখযোগ্য অর্থ ব্যয় করবে এন্টি-শিপ মিসাইলসহ দীর্ঘ পাল্লার মিসাইল সংগ্রহে। এ ছাড়া উদ্ভাবন করবে হাইপারসনিক মিসাইল। একই সাথে স্যাটেলাইট সার্ভিলেন্স, উচ্চ গতির প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি এবং গবেষণা খাতে উল্লেখযোগ্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ান ডিফেন্স ফোর্স একাডেমিতে জুলাইয়ের শুরুতে অস্ট্রেলিয়ান প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন ১৮৭ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র সংগ্রহ তালিকা এবং ডকুমেন্ট প্রকাশ করেন।
এর মধ্যে ৫১ বিলিয়ন ডলার নেভি, ৩৮ বিলিয়ন ডলার স্থল বাহিনী এবং ৪৭ বিলিয়ন ডলার বিমান বাহিনীর জন্য বরাদ্দ করা হবে।

১০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হবে কাউন্টার সাইবার থ্রেট এর ক্ষেত্রে। ৫ বিলিয়ন ডলার স্পেস ওয়ারফেয়ার এর ক্ষেত্রে। স্পেস ওয়ারফেয়ারের ক্ষেত্রে এটাই অস্ট্রেলিয়ার প্রথম পদক্ষেপ। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী মরিসন অভিযোগ করেন একটি দেশের পক্ষ থেকে তাদের স্বাস্থ্য খাতসহ গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে হামলা চালাচ্ছে।

অস্ট্রেলিয়া এ বছরের শেষের দিকে চার বছর মেয়াদী একটি নতুন সাইবার কৌশল প্রকাশ করবেন। বরাদ্দকৃত এ অর্থ দিয়ে অস্ট্রেলিয়া সেন্সর এন্ড ট্রাকিং সিস্টেম এর মাধ্যমে স্পেস সার্ভিলেন্স দক্ষতা বৃদ্ধি করবে। তৈরি করবে একটি স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক যাতে করে স্বাধীন কমিউনিকেশনস সক্ষমতা তৈরি হয়। দক্ষিন অস্ট্রেলিয়ায় স্যাটেলাইট উৎক্ষেপন ব্যবস্থা রয়েছে তাদের।

বরাদ্দকৃত অর্থের মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে সংগ্রহ করবে সমরাস্ত্র। এর মধ্যে রয়েছে দীর্ঘ পাল্লার এন্টি-শিপ মিসাইল। এজিএম-১৫৮সি মিসাইলের আওতা ৩৭০ কিলোমিটার। এ মিসাইল স্থাপন করা হবে সুপার হরনিট ফাইটার জেটে। এ ছাড়া এফ-৩৫ যুদ্ধ বিমানেও এ মিসাইল স্থাপন করা হবে। অষ্ট্রেলিয়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিপুল সংখ্যক এফ-৩৫ যুদ্ধ বিমান সংগ্রহের পথে রয়েছে।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রী লিন্ড রেনল্ড নিশ্চিত করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র্র থেকে অনির্দিষ্ট সংখ্যক এলআরএএসএম এন্টি-শিপ মিসাইল সংগ্রহ করবে অস্ট্রেলিয়া। যুক্তরাষ্ট্র থেকে সংগ্রহ করা অস্ত্র বিষয়ে প্রশিক্ষন শুরু হবে ২০২১ সালে।

এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়া সি-১৩০ হারকিউলিস, এয়ারবাস কেসি -৩০ বহুমুখী ট্যাঙ্কার ট্রান্সপোর্ট, বোয়িং ই-৭ এয়ারর্বণ আলি ওয়ার্নিং কন্ট্রোল বিমানের স্থলে নতুন বিমান সংগ্রহ করবে। এ ছাড়া সংগহ করবে দুটি মাল্টিপারপাস সি লিফটার। ৬ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার খরচ করা হবে গবেষণা এবং হাইপারসনিক মিসাইল উদ্ভাবনে। বর্তমানে রাশিয়া এবং চীনের কাছে এ মিসাইল রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এ মিসাইল অর্জনের পথে। সম্প্রতি তারা এর কিছু পরীক্ষা চালিয়েছে। জাপান এ মিসাইল উদ্ভাবনের কর্মসূচী হাতে নিয়েছে।

চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে যেসব উচ্চ গতির দীর্ঘ পাল্লার আধুনিক প্রযুক্তির অস্ত্র অর্জন করেছে সে ধরনের অস্ত্র তৈরি করতে চায় অস্ট্রেলিয়া। এরিয়েল সার্ভিলেন্সের জন্য গুরুত্ব দেবে দেশটি ড্রোন মোতায়েনের ক্ষেত্রে। এ অঞ্চলে তার মিত্রদের রক্ষায় অস্ট্রেলিয়া সাগরতলে হাই-টেক সেন্সর সার্ভিলেন্স সিস্টেম স্থাপন করবে যাতে করে শত্রুরাষ্ট্রের মেরিটাইম কার্যক্রম সনাক্ত করা যায়। অস্ট্রেলিয়া গুরুত্ব দেবে ড্রোন সাবমেরিন উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে। ২০৩০ সালের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া কমক্ষে ১২টি নতুন এটাক সাবমেরিন অর্জন করবে।

অস্ট্রেলিয়ার কাছে বর্তমানে ৬টি সাবমেরিন রয়েছে যা ১৯৯০ থেকে ২০০৩ সালে তাদের নৌবাহিনীতে যুক্ত হয়েছে। এসব সাবমেরিনে রয়েছে প্রযুক্তিগত জটিলতা এবং সবগুলোর মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে ২০২৬ সালের মধ্যে।

উইপন্স উইশ লিস্ট প্রকাশ করে স্কট মরিসন বলেন, ১৯৩০ এবং ১৯৪০ সালে বিশ্ব এবং আঞ্চলিক ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে যায় এবং অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়ে অষ্ট্রেলিয়া। আর বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া তার চেয়েও খারাপ অবস্থার মুখোমুখি। এ অঞ্চলে অস্ট্রেলিয়া যে বৈশ্বিক, অর্থনৈতিক আর কৌশলগত নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পড়েছে তা আগে কখনো দেখিনি। ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলে রাষ্ট্রে-রাষ্ট্রে দ্ব›দ্ব পরিস্থিতি দ্রæত অবনতি হচ্ছে।

দূর পাল্লার জাহাজ বিধ্বংসী মিসাইল
দূর পাল্লার জাহাজ বিধ্বংসী মিসাইল

 

অস্ট্রেলিয়া ২০১৬ সালের হোয়াইট পেপারে এ অঞ্চল সম্পর্কে যে পরিকল্পনা এবং আশঙ্কা করেছিল তা দ্রæত পাল্টে গেছে। স্কট মরিসন মনে করেন , কৌশলত প্রতিযোগিতা আর উত্তেজনার কেন্দ্র হলো ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চল। আমাদের এ অঞ্চল শুধু আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে না বরং আমাদের জীবদ্দশায় এ অঞ্চলই হবে বিশ্বে আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতার কেন্দ্র। ভৌগোলিক দাবি নিয়ে গোটা ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়ছে। আমরা চীন এবং ভারতের মধ্যে সম্প্রতি সীমানা নিয়ে সংঘাত দেখেছি। এভাবে দ্ব›দ্ব রয়েছে দক্ষিন চীন সাগর এবং পূর্ব চীন সাগরের সীমানা নিয়ে।

অস্ট্রেলিয়ার দুটি ডিফেন্স ডকুমেন্টে জোর দেয়া হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র এবং আঞ্চলিক দেশগুলোর সাথে মৈত্রী স্থাপন। একই সাথে নিজেদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে আত্মনির্ভরশীল হওয়া। সামরিক শক্তি প্রদর্শন এবং উপযুক্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রতি জোর দেন মরিসন।

চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতা মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। কিন্তু তারাই একমাত্র খেলোয়াড় নয় আর অস্ট্রেলিয়া এ খেলায় কোনো সাধারন দর্শক নয়। জাপান, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ভিয়েতনাম এবং প্যাসেফিক তাদের প্রত্যেকেরই এ খেলায় অংশ নেয়ার আগ্রহ আছে। আর অবশ্যই খেলায় অংশ নেয়ার আগ্রহ আছে অস্ট্রেলিয়ার।

অষ্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন সেনা সমাবেশে বলেন, কৌশলগত প্রতিযোগিতায় নতুন মাত্রা এসেছে। ভুল ধারণা আর সংঘাতের ঝুঁকি বেড়ে চলেছে। অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষা দক্ষতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে মরিসন তিনটি বিষয়ের ওপর জোর দেন। অস্ট্রেলিয়ার কৌশলগত পরিবেশ, অস্ট্রেলিয়ার স্বার্থ বিরোধী তৎপরতা প্রতিরোধ এবং প্রয়োজনে উপযুক্ত জবাব দেয়া।

দক্ষিণ চীন সাগর সমুদ্র বানিজ্য রুট নিয়ে চীনের যে যুদ্ধংদেহী মনোভাব সে কারনে অস্ট্রেলিয়াকে ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলের প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে অধিক ব্যয়ের পরিকল্পনা নিয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলকেন্দ্রিক অস্ট্রেলিয়ার নতুন বাজেটের একমাত্র লক্ষ্য হলো চীন। অস্ট্রেলিয়ার বলয়ের মধ্যে থাকা ছোট ছোট প্রশান্ত মহাসগারীয় জাতিগুলোর মধ্যে চীন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিভাবে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে বলে আশঙ্কা অস্ট্রেলিয়ার।
সম্প্রতি করোনা ভাইরাস ছড়ানো নিয়ে চীন ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে উত্তপ্ত বিতর্কের সৃষ্টি হয়। অস্ট্রেলিয়ান স্ট্রাটেজিক পলিসি ইনস্টিটিউটের পরিচালক পিটার জেনিংস বলেন, যখন তারা কারো বিরুদ্ধে সীমান বৃদ্ধির অভিযোগ করে, বল প্রয়োগের অভিযোগ করে সাইবার এটাক এবং অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের কথা বলে তখন বুঝতে হবে সেটা একটিই দেশ তা হলো চীন।

অষ্ট্রেলিয়া এ অঞ্চলে একটি চীনের সামরিক ঘাটি এবং অন্যান্য সামরিক অবকাঠামো নির্মাণ ঠেকানোর জন্য আঞ্চলিক বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সাথে অংশীদারিত্ব তৈরির পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সিঙ্গাপুর, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত এবং ভিয়েতনামের সাথে সম্পর্ক জোরদার করছে অষ্ট্রেলিয়া। ইন্দোনেশিয়ার সাথেও সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্যোগ নিয়েছে দেশটি। অস্ট্রেলিয়া চেষ্টা করছে ফিজি এবং সলোমন আইল্যান্ডে চীনের প্রভাব ঠেকানোর। এ ক্ষেত্রে পাপুয়া নিউি গিনিকে অস্ট্রেলিয়া ভবিষ্যত কৌশলগত মিত্র হিসেবে পেতে চায়।

অস্ট্রেলিয়ার কৌশলবিদদের বিশ্বাস চীন দক্ষিণ প্যাসেফিক অঞ্চলে কমপক্ষে একটি সামরিক স্থাপনা তৈরি করতে চাচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ান ডিফেন্স ফোর্সকে উত্তর-পূর্ব ভারত মহাসাগর, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে পাপুয়া নিউগিনি এবং দক্ষিন পশ্চিম প্যাসেফিক পর্যন্ত মনোনিবেশ করার কৌশল নেয়া হয়েছে।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে