বাড়ছে তুরস্কে তৈরি অস্ত্রের চাহিদা

তুরস্কে তৈরি মিলিটারি অ্যাটাক হেলিকপ্টার ‘টি-১২৯ অ্যাটাক’। - আনাদুলো

  • হাসান আব্দুল্লাহ
  • ০৭ জুলাই ২০২০, ২২:২২

একের পর এক নতুন নতুন শক্তিশালী সমরাস্ত্র তৈরি করে চলছে তুরস্ক। সর্বশেষ তারা সফল পরীক্ষা চালিয়েছে নিজস্ব উদ্ভাবিত এন্টি-শিপ মিসাইলের। সারা বিশ্বে বর্তমানে আলোচিত তুরস্কের ড্রোন প্রযুক্তি আর ড্রোন যুদ্ধ বিমান। ড্রোন বিমানসহ তুরস্কের সমরাস্ত্রের বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি এটাক হেলিকপ্টারের একটির মালিক তুরস্ক। তুরস্কের কাছ থেকে পাকিস্তান ৩০টি অ্যাটাক হেলিকপ্টার কেনার চুক্তি করেছে।

তুরস্ক সফল পরীক্ষা চালিয়েছে শক্তিশালী এন্টি- শিপ মিসাইলের। এর নাম আতমাকা। এটি তুরস্কের প্রথম নিজস্ব উদ্ভাবিত এন্টি-শিপ মিসাইল। শীঘ্র এটি যুক্ত হবে তুরস্কের রণতরীতে। আতমাকা মিসাইল ২০০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে সঠিকভাবে আঘাত করে ধ্বংস করেছে। আতমাকা একটি সারফেস টু সারফেস মিসাইল। আধুনিক এ গাইডেড মিসাইল যে কোনো আবহাওয়ায় ব্যবহারযোগ্য। এতে রয়েছে প্রতিপক্ষের বাধা ভেদ করার সিস্টেম। এমনকি নিক্ষেপ করার পর এর লক্ষ্য পরিবর্তন এবং বাতিল করা যায়। প্রতিপক্ষের ইলেকট্রনিক জ্যামিং সিস্টেমও এর হামলা প্রতিহত করতে পারে না।

এন্টি-শিপ মিসাইলের আগে বহুমুখি আরেকটি মিসাইলের সফল পরীক্ষা চালিয়েছে তুরস্ক। এর নাম সানগার। ভূমি, আকাশ এবং নৌযান থেকে নিক্ষেপযোগ্য এ মিসাইল। এটিও তুরস্কের নিজস্ব উদ্ভাবিত মিসাইল। তুরস্কের নিজস্ব উদ্ভাবিত এয়ার ডিফেন্স মিসাইল সিস্টেম সানগার সার্ভিসে যুক্ত হতে যাচ্ছে শীঘ্রই। বেশ কয়েকবার সফল পরীক্ষার পর তুর্কি আর্মিতে যুক্ত করার জন্য প্রস্তুত অবস্থায় রয়েছে।

তুরস্কের নামকরা সমরাস্ত্র প্রতিষ্ঠান রকেটসান তৈরি করেছে সানগারের নকশা। সানগার মোবাইল প্লাটফর্ম থেকে নিক্ষেপ করা যায় । আর এ প্লাটফর্ম থেকে ৩৬০ ডিগ্রি পর্যন্ত মুভ করা যায়। দিনে রাতে যে কোনো সময় লক্ষ্য বস্তু সনাক্ত করে আঘাত করতে সক্ষম এ মিসাইল। বহনযোগ্য এ মিসাইল ভ‚মি, আকাশ এবং নৌ যান থেকে ছোড়া সক্ষম। এটি নিখুতভাবে লক্ষ্যে আঘাত করতে পারে। চলমান অবস্থায়ও সাজোয়া যান থেকে ছোড় সম্ভব এ মিসাইল।

বিদেশী এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের পরিবর্তে তুরস্ক এখন ব্যবহার করবে তাদের এ মিসাইল সিস্টেম। সান্গার টিটেনিয়াম বোমা বহন করে। রাশিয়ার এস -৩০০ এবং এস-৪০০ মিসাইল সিস্টেমে যে মেথড সিস্টেম রয়েছে সানগারেও ব্যবহার করা হয়েছে সে সিস্টেম। আকাশে ৪ কিলোমিটার উচ্চতায় লক্ষ্য বস্তুতে আঘাত করতে পারে এ মিসাইল। এর আওতা ৬ কিলোমিটার। উচ্চ বিষ্ফোরক ক্ষমতাসম্পন্ন ৩ কেজি ওজনের বোমা বহন করতে পারে এ মিসাইল।

২০১৩ সালে এ মিসাইল উদ্ভাবনের কার্যক্রম গ্রহন করে তুরস্ক। সানগার সেলপ প্রপেল্ড সারফেস টু এয়ার মিসাইল সিস্টেম ক্রুজ মিসাইল, ড্রোন বিমান এবং হেলিকপ্টার ধ্বংস করতে সক্ষম। এর সাথে তুরস্ক রোবট ট্যাংক বানানোর কাজ শেষ করছে। আসুন জেনে নেই এ সর্ম্পকে কিছু তথ্য

তুরস্কের সমরাস্ত্র প্রতিষ্ঠান আসেলসান এবং কাটমারসিলার মিলে তৈরি করবে আনম্যানড গ্রাউন্ড ভিহিক্যাল । এটি মিনি ট্যাঙ্ক নামেও পরিচিত। এ মিনি ট্যাঙ্ক তৈরির জন্য ২ জুলাই ৬ লাখ ৭১ হাজার ইউএস ডলারের চুক্তি স্বাক্ষর করেছে আসেলসান ও কাটমারসিলার । চুক্তি অনুযায়ী কাটমারসিলার ২০২১ সালে মিনি ট্যাঙ্ক সরবরাহ করবে বলে জানিয়েছে। মিনি ট্যাঙ্কের রিমোট-কন্ট্রোল সিস্টেমসহ এর সমস্ত যন্ত্রাংস তৈরি করবে কাটমারসিলার। কাটমারসিলারের বিবৃতিতে বলা হয়েছে এ মিনি ট্যাঙ্ক বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম যেমন পর্যবেক্ষন, টার্গেটিং এবং উইপন সিস্টেম ব্যবস্থা স্থাপন করা যাবে। এর শুটিং রেঞ্জ হবে প্রশংসনীয়। স্যাটেলাইট ব্যবস্থার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রন করা এ ট্যাঙ্ক। আনম্যানড গ্রাউন্ড ভিহিক্যাল এ মিনি ট্যাঙ্ক প্রতিকুল আবহাওয়া এবং খারাপ রাস্তায়ও চলতে পারবে।

রোবট ট্যাংকের প্রস্তুতির মধ্যে ভূগর্ভের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে সক্ষম বোমা উদ্ভাবন করেছে তুরস্ক। এটি একই সাথে আকাশের লক্ষ্যবস্তুতেও আঘাত করতে পারে। ভূগর্ভে বিশেষ করে গুহা, রানওয়ে, হ্যাঙ্গার, বাঙ্কার এবং ড্যাম ধ্বংসে ব্যবহার করা যাবে এ বোমা । ৬ ফিট কংক্রিট ভেদ করে ভ‚গর্ভের লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করতে সক্ষম এ বোমা। প্রথম বারের মত এ ধরনের পেনিট্রেটিং বোমা তৈরি করল তুরস্ক। এতে রয়েছে মাল্টিপল ওয়ারহেড সিস্টেম। এ বোমার নাম সার্ব-৮৩। ইন্ডাস্ট্রি এন্ড টেকনোলজি মিনিস্টার মুস্তাফা ভারাঙ্ক ২৪ জুন জানান, সফলভাবে এ বোমার পরীক্ষা চালানো হয়েছে।

তুরস্ক ব্যাপকভাবে উৎপাদন করতে যাচ্ছে ড্রোন কার্গো প্লেন। তুরস্ক আর্মি পাহাড়ি এলাকায় পন্য সরবরারের জন্য ব্যবহার করবে এ কার্গো ড্রোন। প্রতিটি ড্রোন ১৫০ কেজি পর্যন্ত পন্য বহন করতে পারবে। অস্ত্র. গুলি এবং মেডিকেল সামগ্রী বহন করতে পারবে। প্রতিক‚ল আবহাওয়ায়ও এসব ড্রোন চলাচল করতে পারবে। এসব ড্রোনের ফ্লাইট ডিউরেশন এক ঘন্টা।

তার্কিশ এরোস্পেস ইন্ডাস্ট্রি টি এ আই ২০২১ সালে ব্যাপকভিত্তিক ড্রোন কার্গো প্লেন উৎপাদন শুরু করবে। তুরস্কের তৈরি বিভিন্ন ড্রোন যুদ্ধ বিমান ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাপী আলোচিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে সিরিয়ার ইদলিব যুদ্ধে সিরিয়ান ট্যাঙ্ক, সাজোয়া যান, বিভিন্ন ঘাটি, রাশিয়ান মিসাইল সিস্টেম তছনছ করার পর বিশ্বব্যাপী নজর কাড়ে তুরস্কের ড্রোন। এর আগে কোনো যুদ্ধে ড্রোন বিমানের এ ধরনের সফল ব্যবহার হয়নি। এরপর সম্প্রতি লিবিয়ায় হাফতার বাহিনীর বিরুদ্ধেও তুরস্ক সফলভাবে ব্যবহার করেছে ড্রোন বিমান।

বিশ্বের শীর্ষ ১০টি এটাক হেলিকপ্টারের একটির অধিকারী তুরস্ক। এর নাম টি-১২৯। এর নির্মাতা তার্কিস এরোস্পেস ইন্ডাস্ট্রি টিএআই । তার্কিস টি-১২৯ এটাক হেলিকপ্টার ইতালীর এ-১২৯ এটাক হেলিকপ্টারের উন্নত ভার্সন। ইতালীর লিওনার্দোর হেলিকপ্টার নির্মাতা এগেস্টা ওয়েস্ট ল্যান্ডের সহায়তায় তুরস্কের টিএআই নির্মাণ করছে এ হেলিকপ্টার।

টি-১২৯ হেলিকপ্টার এন্টি- ট্যাঙ্ক মিসাইল, রকেট এবং স্টিঙ্গার মিসাইল সিস্টেমে সজ্জিত । অনেকে একে যুক্তরাষ্ট্রের এপাচি হেলিকপ্টারের সাথে তুলনা করে থাকেন। ২০১৪ সালে তুরস্ক আর্মিতে যুক্ত হয় টি-১২৯ হেলিকপ্টার গানশিপ। এর ইঞ্জিন সংখ্যা ২টি। পাইলট ২ জন। সর্বোচ্চ গতি ঘন্টায় ১৭৩ মাইল। মেক্সিমাম টেক অফ ওয়েট ৫ টন। রকেট এবং মিসাইল বহনের জন্য এতে রয়েছে ৪টি হার্ডপয়েন্ট ।

তখন ২০১৪ সাল। এরদোগান ছিলেন তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী। তুরস্কের মিলিটারি হেলিকপ্টারের প্রদর্শনীতে পাইলটের আসনে বসেছিলেন তিনি। ছবি : এপি
তখন ২০১৪ সাল। এরদোগান ছিলেন তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী। দেশটির মিলিটারি হেলিকপ্টারের প্রদর্শনীতে পাইলটের আসনে বসেছিলেন তিনি। ছবি : এপি

 

এটি এয়ার টু এয়ার এবং এয়ার টু গ্রাউন্ড শক্তিশালী মিসাইল বহন করতে পারে। ১ টন ২০০ কেজি ওজনের অস্ত্র বহন করতে পারে এটি। এতে রয়েছে ২০ মিলিমিটার থ্রি ব্যারেল গান সিস্টেম। মিসাইল, লেজার এবং রাডার ওয়ার্নিং সিস্টেমযুক্ত টি-১২৯ হেলিকপ্টারে রয়েছে রেডিও জ্যামার।

যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি হেলফায়ার মিসাইল, হাইড্রা রকেট, ইসরাইলের তৈরি স্পাইক মিসাইল এবং তুরস্কের তৈরি আটমাস মিসাইল বহন করতে পারে টি-১২৯ হেলিকপ্টার গানশিপ। এতে রয়েছে ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সিস্টেম। তুরস্কের কাছে বর্তমানে ৫০টির অধিক টি-১২৯ হেলিকপ্টার রয়েছে। ২০০৭ সালে তুরস্ক ৫১টি হেলিকপ্টার নির্মানের জন্য ৩ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি করে এগেস্টা ওয়েস্টল্যান্ডের সাথে।

দিনে রাতে প্রতিক‚ল আবহাওয়া ও পরিবেশে অভিযান পরিচালনা করতে সক্ষম টি-১২৯। আজরাবাইজান, জর্ডান, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, সৌদি আরব, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত আগ্রহ প্রকাশ করেছে তুরস্কের টি-১২৯ হেলিকপ্টার বিষয়ে।

পাকিস্তান তুরস্কের কাছ থেকে ৩০টি টি-১২৯বি এটাক হেলিকপ্টার ক্রয়ের চুক্তি করেছে। এ ছাড়া ফিলিপাইনও ৮টি ট-১২৯ হেলিকরপ্টার ক্রয়ের চুক্তি করেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টির চেষ্টা করছে এ হেলিকপ্টার বিক্রির ক্ষেত্রে। ২০১৮ সালে সিরিয়ার আফরিনে কুর্দি বিরোধী অভিযানে তুরস্ক ব্যবহার করে টি-১২৯ হেলিকপ্টার।

এদিকে তুরস্ক পশ্চিমে গ্রীস ও বুলগেরিয়া সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার করেছে। তুরস্কের সমরাস্ত্র প্রতিষ্ঠান আসেলসান মোবাইল বর্ডার সার্ভিলেন্স সিস্টেম এর একটি ব্যাচ সরবরাহ করেছে দেশটির পশ্চিম সীমান্তে। ২০১৯ সালে প্রথম এ সিস্টেম সরবরাহ করে আসেলসান। এ সিস্টেমে ইলেকট্রিক সেন্সর এবং সফটঅয়ার ব্যবহার করা হয়। সর্বশেষ ১০টি আরমারড মোবাইল বর্ডার সার্ভিলেন্স ভেহিকেল সরবরাহের ফলে মোট ৫৭টি এ ধরনের মোবাইল বর্ডার সার্ভিন্সে সিস্টেম যুক্ত হলো।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে