লাইন অব কন্ট্রোলে শক্তি বাড়াচ্ছে চীন ও ভারত

কার্টুনটি করেছেন কার্লুস - এমজি ডটককো

  • মেহেদী হাসান
  • ০৭ জুলাই ২০২০, ১৫:২৯

ভারত ও চীন উভয় পক্ষ লাইন অব কন্ট্রোলের নিজ নিজ অংশে শক্তি বৃদ্ধি করে চলছে। উভয় দেশ ভবিষ্যতে বড় ধরনের শক্তি প্রদর্শনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে বর্তমানে ভারত ও চীন বড় ধরনের সংঘাতে লিপ্ত না হলেও ভবিষ্যতে বরফ ঘেরা হিমলায় অঞ্চল উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে। আর ভবিষ্যত এ সংঘাত ১৯৬২ সালের মত একতরফাভাবে শেষ নাও হতে পারে। ধ্বংসাত্মক পরিণত ডেকে আনতে পারে দু দেশের জন্য। কারন ভারত ও চীন কোনো দেশই ১৯৬২ সালের পর্যায়ে নেই। বিডি ভিউজ ইনফোটেইনমেন্টে স্বাগত জানাচ্ছি আমি তাসনিম হোসাইন। আজ আমরা ভারত ও চীনের সংঘাতের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করবো।

চীন-ভারত সাম্প্রতিক সংঘাত শুধু গালওয়ান ভ্যালির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং এর লক্ষ্য অনেক বিস্তৃত। চীনের বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভের বিরুদ্ধে ভারত অবস্থান নিয়েছে। ভারতের বিরুদ্ধে এজন্য প্রতিশোধ নিতে চায় চীন । চীন তার প্রতিবেশীদের এ বার্তাও দিতে চায় যে, ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলের প্রবেশ দুয়ার এখন তার নিয়ন্ত্রনে। ভারত এবং তার মিত্ররা করোনায় বিধ্বস্ত তখন চীন অনেক বেশি শক্ত অবস্থানে রয়েছে।

শুধু ভারত নয়, গোটা পশ্চিমা বিশ্ব করোনায় বিপর্যস্ত। এর মধ্যে চীন ক্রমাগত তার বাহু বিস্তৃত করে চলছে। আঞ্চলিক বিশ্লেষকদের অনেকে বিস্মিত কেন এই সময়ে চীন তার প্রতিবেশিদের ক্ষেপিয়ে তুলছে। তাদের অনেকে মনে করেন চীন কেবল হিমলায় সীমান্তে নয় বরং দক্ষিন চীন সাগর এবং তাইওয়ানের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।

চীন এটি করছে নতুন স্নায়ুযুদ্ধের লিটমাস টেস্ট এর অংশ হিসেবে। চীনা এ পদক্ষেপে কারা কারা তার প্রতি প্রকাশ্যে সমালোচনা করে এবং কারা তার প্রতি নিরব এটা দেখতে চায় চীন।

লাদাখ ঘটনা বিস্তারিত তুলে ধরা থেকে বিরত রয়েছে চীনা ভাষার গণমাধ্যম। তবে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মুখপাত্র ইংরেজি দৈনিক গেøাবাল টাইমস ভারতের প্রতি কঠোর হুশিয়ারি দিয়ে চলছে। এর মধ্যে একটি হুমকি হলো এ সংঘাতে চীনা কৌশলগত অংশীদার পাকিস্তান এবং নেপালকেও জড়ানোর বিষয়ে।

সাংহাইয়ের বিশেষজ্ঞ হু ঝিয়াং এর উদ্ধৃতি দিয়ে গ্লোবাল টাইমস পত্রিকায় লেখা হয়েছে -ভারত যদি সীমান্তে উত্তেজনা চায় তাহলে তাকে দুই এমনকি তিন ফ্রন্টে সামরিক হামলা মোকাবেলা করতে হতে পারে। চীনা এ প্রতিবেদন আর ভাষ্য বিদেশীদের উদ্দেশে। বিশেষ করে ভারতের পাঠকদের জন্য। ২২ জুন গ্লোবাল টাইমস এর সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে ‘আমরা ভারতে জ্বরে আক্রান্ত জাতীয়তাবাদীদের সতর্ক করে দিতে চাই যে, তারা যেন নয়া দিল্লিকে ভুল পথে পরিচালিত না করে। যাতে করে অতীত ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটে। এ ক্ষেত্রে অতীত ভুল মানে ১৯৬২ সালের যুদ্ধে ভারতের শোচনীয় পরাজয় স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়।

গ্লোবাল টাইমসের ২২ জুনের সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে ১৯৬২ সালের তুলনায় এ অঞ্চলে রয়েছে চীনের অনেক মিত্র। একটি শিল্পোন্নত দেশ হিসেবে চীনের জিডিপি ভারতের ৫ গুন। ভাতের তুলনায় চীনের সামরিক ব্যয় অনেক বেশি। আর চীনা উন্নত সমরাস্ত্র তারা নিজেরা তৈরি করছে। আর ভারতের কাছে যেসব আধুনিক সমরাস্ত্র রয়েছে তার প্রায় সবই আমদানিকৃত।এশিয়া টাইমসের এক প্রবন্ধে বলা হয়েছে এর অনেক কিছু হয়তো সত্য।

এটাও বাস্তবতা যে ভারতের অবস্থানও ১৯৬২ সালের মত নয়। ভারত এখন চীনের বিরুদ্ধে দাড়ানোর মত অবস্থায় রয়েছে। সিকিম এবং তিব্বতের মাঝে দুটি পাহাড়ি রাস্তা নিয়ে ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে এটা প্রমানিত হয়েছে।

তখনো চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় একটি বিবৃতি জারি করে যা বলা হয়েছিলো তা আজকের গ্লোবাল টাইমসের হুশিয়ারির সাথে হুবহু মিল রয়েছে। তখন পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের বিবৃতিতে বলা হয় ভারত যেন আমাদের বুঝতে ভুল না করে এবং ১৯৬২ সালের ভুলের পুনরাবৃত্তি না করে।

ভারতের পরিসংখ্যান উল্লেখ করে এশিয়া টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ভারতের ৮৮ সৈন্য নিহত হয় এবং ১৬৩ জন আহত হয়। অপর দিকে চীনের ৩৪০ সৈন্য নিহত হয় এবং ৪৫০ জন আহত হয়। ভারতের এ তথ্য নিয়ে তেমন বিতর্ক নেই বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রবন্ধে।

এরপর দুই দেশের মধ্যে বড় সশস্ত্র সংঘাতের ঘটনা ঘটে ১৯৭৫ সালের অক্টোবরে। অরুনাচল প্রদেশে আধা সামরিক বাহিনী আসাম রাইফেলের একটি কন্টিনজেন্টে হামলা চালায় চীনা সৈন্যরা। এতে আসাম রাইফেলের ৪ জন নিহত হয়। তবে এ অঞ্চলের সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার সীমান্তে এ সংঘাত তখন ছড়িয়ে পড়েনি।

১৯৮৬ সালের শেষে এবং ১৯৮৭ সালের শুরুতে হাজার হাজার চীনা এবং ভারতীয় সৈন্য অরুনাচল প্রদেশে মুখোমুখি হয়। তবে সেবারও সংঘাত এড়ানো সম্ভব হয়। চীন পিছু হটতে বাধ্য হয়।

বর্তমানে চীন-ভারত কোনো পক্ষই বড় সংঘাতে চড়াতে চাইবে না। তবে সহসা এ বিরোধ মেটারও নয়। এর অন্যতম কারন ঔপনিবেশিক বৃটিশদের তৈরি একাধিক মানচিত্র। ১৯৫৭ সালে ভারত প্রথম জানতে পারে যে, চীন আকসাই চীন ও জিনজিয়াং এর মধ্যে একটি রাস্তা নির্মান করেছে কিব্বতের লাসার মধ্য দিয়ে। আকসাই চীন ভারত তাদের দাবি করে। আর আজকের গালওয়ান ভ্যালিও ছিল ১৯৬২ সালে দুই দেশের যুদ্ধের অন্যতম কেন্দ্র।

ভারতের অভিযোগ চীন বারবার সীমানা পরিবর্তন করছে। হিমালায় থেকে শুরু করে দক্ষিন চীন সাগর পর্যন্ত চীন তার সীমানা পরিবর্তন করে চলছে এবং যতটা সম্ভব বাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। একই সাথে চীন এর প্রতিকৃয়াও পরিমাপ করার চেষ্টা করছে।

চীন-ভারত সর্বাত্মক যুদ্ধ এ মূহুর্তে সম্ভাবনা কম তবে অন্য কারনে দুই দেশের মধ্যে দ্ব›দ্ব সংঘাত অব্যাহত থাকবে। এর কারন চীনা বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ। ফেব্রæয়ারি থেকে সীমান্ত সংকট শুরুর পর ২০১৯ সালের একই সময়ের তুলনায় চীনে ভারতের রপ্তানি ১৪ শতাংশ কমেছে । একই সাথে হংকংয়ে ভারতের শিপমেন্ট কমেছে ৬২ শতাংশ। করোনা এবং দুই দেশের সংঘাত যদি অব্যাহত থাকে তাহলে দুই দেশের বানিজ্য আরো অবনিত ঘটবে।

এমন পরিস্থিতির মধ্যেও নিশ্চিত সত্য হলো চীন লাইন অব একচুয়াল কন্ট্রোল জুড়ে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে চলছে। মধ্য জুনের সংঘাতে চীন কাটাতারযুক্ত টোটা এবং ধারাল লোহার রড ব্যবহার করেছে। ফলে গোলাগুলি ছাড়া এ সংঘাত দ্রæত শেষ হয়েছে। কিন্তু লাইন অব একচুয়াল কন্ট্রোলের উভয় অংশে বাঙ্কার, তাবু, অবকাঠামো এবং সমরাস্ত্র মজুদের আয়োজনের যে চিত্র দেখা গেছে তাতে এটা পরিষ্কার যে, উভয় পক্ষ বড় ধরনের শো ডাউনের আয়োজনে লিপ্ত।
তবে ভারতের অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, চীন যদি ভারতকে কোনো শিক্ষা দিতে চায় এবং সেক্ষেত্রে আদিম অস্ত্রের পরিবর্তে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে তবে সেটা ১৯৬২ সালের মত একতরফাভাবে শেষ নাও হতে পারে। ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধে ভারতের শোচনীয় পরাজয় ঘটে।

আর ২০২০ সালে এ ধরনের যুদ্ধে উভয় পক্ষের ধ্বংসাত্মক পরিণতি ঘটতে পারে বলে মনে করেন ভারতের অনেক বিশ্লেষক। আবার অনেকে ভারতের বর্তমান কৌশলকে দেখছেন বাইরে থেকে শক্ত কিন্তু ভেতরে নরম।

ভারত চীনের বিরুদ্ধে দাড়িয়ে লড়াই করার শক্তি অর্জন করেছে এ বিশ্লেষণ এবং তুলনা অনেকে মানতে রাজি নন। বৈশ্বিক রাজনৈতিক কারনে হয়তো ভারতের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রসহ আরো অনেক শক্তিশালী দেশ রয়েছে কিন্তু এককভাবে ভারত চীনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে টিকে থাকার মত অবস্থায় নেই।

দীর্ঘদিন ধরে ভারত চীনের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হলেও এবং নিজেকে গ্লোবাল পাওয়ার হিসেবে তুলে ধরলেও বাস্তবে ভারতের সার্বিক চিত্র চীনের সাথে তুলনীয় নয় । অর্থনীতি, সামরিক, প্রযুক্তি, সমরাস্ত্র শিল্প সব দিক দিয়ে চীন অনেক এগিয়ে ভারতের বিপরীতে। এ অবস্থায় করোনার আঘাত ভারতকে অনেক দূরে ঠেলে দিয়েছে। অপর দিকে ভারত নিজেকে নব্য সুপার পাওয়ার হিসেবে প্রচার করলেও এমনকি দক্ষিন এশিয়ায়ও দেশটি নিজেকে ভাল কোনো পক্ষ হিসেবে প্রমান করতে পারেনি।

কোনো কোনো বিশ্লেষকের মতে বর্তমানে ভারত তার সব ডিম যুক্তরাষ্ট্রের ঝুড়িতে রেখেছে। চীনের মোকাবেলায় ভারত অতিরিক্ত যুক্তরাষ্ট্র নির্ভর হয়ে পড়েছে যা দীর্ঘ মেয়াদে তার নিরাপত্তার জন্য হুমকির কারন হয়ে দাঁড়াবে।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে