মার্কিন সৈন্য হত্যায় তালেবানদের অর্থ দিয়েছে রাশিয়া

তালেবান - ইন্টারনেট

  • মেহেদী হাসান
  • ০৫ জুলাই ২০২০, ১৪:০০

আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র এবং কোয়ালিশন ফোর্সের সৈন্যদের হত্যার জন্য তালেবান যোদ্ধাদের গোপনে অর্থ দিয়েছে রাশিয়ান সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা। রাশিয়ান সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার একটি ইউনিট গত বছর এ অর্থ দিয়েছে । রাশিয়ান অর্থে পরিচালিত এ গোপন হামলায় বেশ কয়েকজন আমেরিকান সৈন্য নিহতের ঘটনা ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার বরাত দিয়ে এই খবর প্রকাশ করে নিউইয়র্ক টাইমস। আসলে কী রাশিয়া আফগানিস্তানে আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে। কী আছে এই খবরে আর এর প্রভাবই বা কী তা নিয়ে আজ আমরা আলোচনা করব।

নিউ ইয়র্ক টাইমস এবং ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত খবর নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে হৈচৈ চলছে। খবরে বলা হয়েছে এ গোয়েন্দা প্রতিবেদন বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পসহ প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে অবহিত করা হয়েছে। আফগানিস্তান মিশনে জড়িত বৃটেনকেও সম্প্রতি এ বিষয়ে অবহিত করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। কিন্ত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পসহ হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারা এ ধরনের তথ্যর কথা অস্বীকার করেছেন।

অভিযোগ উঠেছে ২০১৬ সালের নির্বাচনে রাশিয়া ট্রাম্পের পক্ষে ভূমিকা পালন করায় মস্কোর বিরুদ্ধে এ বিষয়ে কঠোর অবস্থান নেয়ার ক্ষেত্রে ট্রাম্প প্রশাসন অনীহা দেখিয়েছে। স্পিকার ন্যান্সি পেলোসিসহ কংগ্রেসের উভয় দলের সদস্যরা এ ঘটনার জবাব চেয়েছেন হোয়াইট হাউসের কাছে। কংগ্রেসে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দাবি করেছেন তারা।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দাবি করেছেন তাকে এ ঘটনা জানানো হয়নি। হোয়াইট হাউজও বলেছে, এ ঘটনা প্রেসিডেন্ট বা ভাইস প্রেসিডেন্টকে জানানো হয়নি। তবে এ ঘটনা না জানার কথা বললেও ট্রাম্প প্রশাসন প্রতিবেদনের অস্তিত্বকে অস্বীকার করেনি। তারা বলেছে প্রতিবেদনটি এখনো ভাল করে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়নি এবং এ অভিযোগের সত্যতা এখনো প্রমানিত হয়নি।

তবে নিউ ইয়র্ক টাইমস এবং ওয়াশিংটন পোস্ট উভয় প্রতিবেদনে বেশ কয়েকজন গোয়েন্দা কর্মকর্তার বরাতে উল্লেখ করা হয়েছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পসহ শীর্ষ মহলকে জানানো হয়েছে এ ঘটনা এবং এ বিষয়ে তারা আলোচনাও করেছেন।

নিউ ইয়র্ক টাইমসের খবরে বলা হয়েছে ২০১৯ সালে আফগানিস্তানে ২০ জন আমেরিকান সৈন্য নিহত হয়েছে। তাদের মধ্যে কয়জন রাশিয়ান অর্থে পরিচালিত হত্যাকান্ড তা নিশ্চিত নয়। গোয়েন্দা কর্মকর্তার বরাত দিয়ে এই প্রতিবেদনে আরো বলা হয় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে এ গোয়েন্দা প্রতিবেদন বিষয়ে জানানো হয়েছে।

আফগানিস্তানে রাশিয়ার অর্থে সৈন্য নিহত হওয়া নিয়ে ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলে আলোচনা হয়েছে। মস্কোকে এ কাজ বন্ধ করতে বলা হবে সিদ্ধান্ত হয়। পাশপাশি রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবরোধ এবং অন্যান্য পদক্ষেপের বিষয়ে আলোচনায় হয়। নিউ ইয়র্ক টাইমসে অভিযোগ করা হয়েছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং তার ঘনিষ্টরা রাশিয়ার বিরুদ্ধে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহনের ক্ষেত্রে নমনীয় অবস্থায় রয়েছে।

এর কারন হিসেবে গত নির্বাচনে রাশিয়ার ট্রাম্পের পক্ষে ভ‚মিকা পালনের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে। আমেরিকান গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন ২০১৬ সালের নির্বাচনে রাশিয়ান হস্তক্ষেপের মূলে ছিল সামরিক গোয়েন্দা ইউনিট জি আর ইউ। জি আর ইউর দুটি সাইবার ইউনিট ডেমোক্রেটিক পার্টির সার্ভার হ্যাক করে এবং পরে হ্যাক করা তথ্য উইকিলিকসের মাধ্যমে প্রকাশ করে । রাশিয়ার এ পদক্ষেপ ট্রাম্পের পক্ষে যায়।

নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে রাশিয়ান যে সামরিক গোয়েন্দা ইউনিট যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যদের হত্যার জন্য তালেবান সংশ্লিষ্ট যোদ্ধাদের গোপনে অর্থ দিয়েছে, সে ইউনিটটি পশ্চিমা দেশে বিশেষ করে ইউরোপে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি এবং গোপন হত্যা মিশন পরিচালনায় যুক্ত। ২০১৮ সালের মার্চে এ ইউনিটের সাবেক একজন কর্মকর্তা সার্গেই স্ত্রিপাল এবং তার কন্যাকে বৃটেনে নার্ভ এজেন্ট প্রয়োগ করে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। এ ইউনিটির নাম প্রতিবেদনে জি আর ইউ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে এ ঘটনাকে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রাশিয়ার হাইব্রিড যুদ্ধ পরিচালনা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। রাশিয়া এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। এই প্রতিবেদনে বলা হয় ২০২০ সালের শুরুতে এক হামলায় চার আমেরিকান সৈন্য নিহত হয়েছে। তবে ফেব্রæয়ারিতে তালেবানদের সাথে চুক্তির পর আমেরিকান সৈন্যদের ওপর হামলা বন্ধ করেছে।

নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনেকে মনে করেন এরমধ্য দিয়ে সিরিয়া যুদ্ধের প্রতিশোধ নিয়েছে রাশিয়া। ২০১৮ সালে সিরিয়ায় আমেরিকান সৈন্যরা কয়েকশ রাশিয়ান পন্থী সৈন্যদের হত্যা করে। এ ছাড়া তালেবান-যুক্তরাষ্ট্র শান্তি চুক্তি নস্যাতের চেষ্টা এবং যুক্তরাষ্ট্রকে আরো দীর্ঘ সময় আফগানিস্তানে অবস্থানে বাধ্য করার জন্যও রাশিয়া এটা করে থাকতে পারে।

আফগানিস্তানে মার্কিন সেনা। - নিউইয়র্ক টাইমস
আফগানিস্তানে মার্কিন সেনা। - নিউইয়র্ক টাইমস

 

ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো জোটের ঠিক কতজন সৈন্য রাশিয়ান পরিকল্পনায় নিহত হয়েছে তা স্পষ্ট নয়। গোয়েন্দা প্রতিবেদনটি নিয়ে হোয়াইট হাইজে আলোচনা হয়। সিআইএ এ প্রতিবেদন পর্যালোচনা করেছে। হোয়াইট হাউজ উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকের পর এ বিষয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে করণীয় নিয়ে আলোচনা হয়।
আফগানিস্তান বিষয়ক বিশেষ দূত জালমে খালিজদাদ রাশিয়াকে সরাসরি মোকাবেলার পরামর্শ দেন। তবে রাশিয়া বিষয়ক ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল রাশিয়ার বিরুদ্ধে তাৎক্ষনিক পদক্ষেপ গ্রহনে অনীহা প্রকশা করে। এরপর বিষয়টি বৃটেনকে অবহিত করা হয়।

এ নিয়ে এক টুইট বার্তায় ট্রাম্প বলেন, গোয়েন্দা কর্মকর্তারা তাকে এ বিষয়ে জানায়নি কারন এ অভিযোগ তাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হিসেবে প্রমানিত হয়নি। ট্রাম্প লিখেছেন মনে হয় এটা রাশিয়ান আরেকটি ভাওতাবাজি। হোয়াইট হাউজ প্রেস সেক্রেটারি কেলি ম্যাকফেনি বলেছেন, প্রেসিডেন্ট বা ভাইস প্রেসিডেন্ট কাউকেই এ প্রতিবেদন বিষয়ে জানানো হয়নি। আর প্রতিবেদনটি এখনো যাচাই করা হয়নি। এ প্রতিবেদন বিষয়ে ভিন্নমত রয়েছে গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের মধ্যে। তবে কংগ্রেসের উভয় দলের সদস্যরা এ প্রতিবেদন বিষয়ে জবাব চেয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি কংগ্রেসে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দাবি করেছেন এবিসি নিউজের সাক্ষাতকারে। তিনি বলেন আগেই এ বিষয়ে আমাদের ব্রিফ করা উচিত ছিল। পেলোসি বলেন, প্রেসিডেন্ট একে অস্বীকার করতে চাচ্ছেন।

রাশিয়ার বিরুদ্ধে ক্রিমিয়া দখল, ইউক্রেনে অভিযান এবং ২০১৬ সালের নির্বাচনে হস্তপেক্ষেপের বিষয় উল্লেখ করে পেলোসি বলেন, এ বিষয়ে আমাদের গোয়েন্দা সংস্থার দলিল প্রমান থাকার পরও প্রেসিডেন্ট তাদেরকে জি-৮ সম্মেলনে আনতে চাচ্ছেন। পেলোসি বলেন, প্রশাসনের নিরবতা বিরক্তিকর পর্যায়ে পৌছেছে এবং তাদের নির্লিপ্ততা আমাদের সৈন্যদের জীবন বিপন্ন করেছে।

হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ সদস্য লিজ চেনি হোয়াটহাউজের কাছে জবাব চেয়েছেন কেন প্রেসিডেন্ট এবং ভাইস প্রেসিডেন্টকে এ বিষয়ে জানানো হয়নি। এ ছাড়া আমেরিকান সৈন্যদের জীবন রক্ষা বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে সে বিষয়েও জবাব চাওয়া হয়েছে। আর প্রতিবেদন সত্য হলে রাশিয়ার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়ার আহবান জানানো হয়েছে। লিজ চেনি বলেছেন হোয়াইট হাউজকে অবশ্যই ব্যাখ্যা দিতে হবে।

সিনেট মাইনরিটি লিডার চাক শুমার এ বিষয়ে ব্রিফিং দাবি করেছেন হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভদের সব সদস্যদের প্রতি। ট্রাম্পের ঘণিষ্ঠ ও সিনেট জুড়িশিয়ারি কমিটির চেয়ারম্যান লিন্ডসে গ্রাহামও এ বিষয়ে কংগ্রেসকে অবিলম্বে অবহিত করার দাবি জানিয়েছেন।

রাশিয়ার পাশাপাশি তালেবান এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তালেবান মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ বলেছেন এমন অভিযোগ তালেবানদের সুনাম নষ্টের চেষ্টা। তিনি বলেন, অনেক বছর ধরে আমরা টর্গেট কিলিং করছি । তবে তা আমাদের নিজস্ব পরিকল্পনা এবং নিজস্ব শক্তিতে করছি। আর আমেরিকার সাথে চুক্তির পর আমরা এটা বন্ধ করেছি। চুক্তির পর আমেরিকান সৈন্যদের জীবন আমাদের কাছে নিরাপদ এবং আমরা আর তাদের ওপর কোনো গোপন হামলা করছি না।

যুক্তরাষ্ট্র অনেক দিন ধরে অভিযোগ করে আসছে রাশিয়া তালেবানদের অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে আসছে। তবে এই প্রথম আমেরিকান ও কোয়ালিশন সৈন্যদের হত্যার জন্য অর্থ দেয়ার খবর বের হলো।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে