মালাক্কা প্রণালীর কেন এতো গুরুত্ব

মালাক্কা - ইন্টারনেট

  • মেহেদী হাসান
  • ০৫ জুলাই ২০২০, ০০:০৫

মালয়েশিয়া উপদ্বীপ এবং ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত সরু জলপথের নাম মালাক্কা প্রণালী। ভারত মহাসাগর আর প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যে মূল শিপিং চ্যানেল এ মালাক্কা প্রণালী। মালাক্কা প্রণালী বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর দ্বিতীয় ব্যস্ততম শিপিং চ্যানেল। বিশ্বে সমুদ্র পথে যত পন্য পরিবহন করা হয় তার ৬০ ভাগেরও বেশি আনা নেয়া করা হয় এ প্রণালী দিয়ে। কৌশলগত কারনে মালাক্কা প্রণালী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। যে কোনো সামরিক অভিযান পরিচালনায় মালাক্কা প্রনালী বদলে দিতে পারে যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি । বিডি ভিউজ ইনফোটেইনমেন্টে আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি আমি সাবরিনা কাজী। আজ আমরা মালাক্কা প্রনালীর গুরুত্বের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করবো।

মালাক্কা প্রনালী শুধুমাত্র গুরুত্বপূর্ণ একটি শিপিং চ্যানেল নয় বরং ভ‚-রাজনৈতিক কারনে এটি হয়ে উঠেছে বিশ্বের আলোচিত একটি জলপথ । এশিয়া- প্যাসেফিক অঞ্চলে আধিপত্য কেন্দ্রিক রাজনীতির অন্যতম হট স্পটে পরিণত হয়েছে মালাক্কা প্রণালী। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত বনাম চীনের মধ্যে ভবিষ্যত যে কোনো বড় ধরনের দ্ব›দ্ব আর সংঘাতের প্রেক্ষিতে এ প্রণালীর নিয়ন্ত্রন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

চীন ও ভারতের ভবিষ্যত শক্তির ভারসাম্য পরিমাপের থার্মোমিটার বলা হয় মালাক্কা প্রনালীকে। মালাক্কা প্রণালীর পশ্চিম প্রান্তে রয়েছে ভারতের আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। ফলে মালাক্কা প্রনালীর এ প্রবেশ মুখে রয়েছে ভারতের ন্যাচারাল আধিপত্য। আর চীনা সমুদ্র বানিজ্যের মূল রুট এ মালাক্কা প্রণালী।

মালাক্কা প্রণালী ঘিরে যেমন রয়েছে ভারতের স্বাভাবিক আধিপত্য তেমনি চীন এগিয়ে রয়েছে তার নৌ শক্তিসহ সাার্বিক সামরিক শক্তিতে। ফলে মালাক্কা প্রনালী ঘিরে চলছে এশিয়া-প্যাসেফিক অঞ্চলে বড় ধরনের লড়াই প্রস্তুতি। চীন ও ভারত মধ্যে এ লড়াইয়ের সাথে সরাসরি জড়িত রয়েছে বর্তমান বিশ্বের সুপার পাওয়ার যুক্তরাষ্ট্র। ফলে দিন দিন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে মালাক্কা প্রণালী।

মালাক্কা প্রণালী মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং সিঙ্গাপুরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। ইউরোপ, আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের সাথে এশিয়া প্যাসেফিক অঞ্চলের সংক্ষিপ্ততম সমুদ্র রুট হলো এই প্রনালী । প্রশান্ত মহাসাগর এবং ভারত মহাসাগারকে যুক্ত করেছে সরু এ প্রনালী। প্রশান্ত মহাসাগর মালাক্কা প্রণালীর সাথে যুক্ত করেছে দক্ষিন চীন সাগরের মাধ্যমে । ভারত মহাসাগর মালাক্কা প্রনালীর সাথে যুক্ত করেছে আন্দামান সাগর, বার্মা সাগার ও বঙ্গোপসাগরের মাধ্যমে।

মালাক্কা প্রণলী অববাহিকার দেশগুলো মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড এবং সিঙ্গাপুর। সিঙ্গাপুরের নিকট মালাক্কা প্রণালী মাত্র ১ দশমিক ৭ মাইল প্রশস্ত। প্রনালীর মোট দৈর্ঘ্য ৫৫০ মাইল। বিশ্বে সমুদ্র পথে যত পন্য পরিবহন করা হয় তার ৬০ ভাগ বহন করা হয় মালাক্কা প্রনালী দিয়ে । অপর দিকে সমুদ্র পথে বিশ্বে যত তেল বহন করা হয় তার চার ভাগের এক ভাগ বহন করা হয় মালাক্কা প্রণালী দিয়ে। ২০১৬ সালে মালাক্কা প্রণালী দিয়ে দৈনিক ১ কোটি ৬০ লাখ ব্যারেল তেল পরিবহন করা হয়। এ ছাড়া অন্যান্য অনেক পন্য তো রয়েছেই।

২০০৮ সালে মালাক্কা প্রণালী বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ত শিপিং চ্যানেলে পরিণত হয়। ওই বছর এ চ্যানেল দিয়ে ৯৪ হাজার জাহাজ চলাচল করে। বর্তমানে বছরে ৮৩ হাজারের বেশি জাহাজ চলাচল করে এ প্রণালী দিয়ে।

বিশ্বে শীর্ষ জ্বালানি তেল আমদানিকারক দেশ হলো চীন আর চতুর্থ জাপান। আরব দেশ থেকে চীন ও জাপানের আমদানিকৃত জ্বালানি তেল বহন করা হয় মালাক্কা প্রনালী দিয়ে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমদানী করা জ্বালানি তেলের ৮০ ভাগ চীন পরিবহন করে এ প্রণালী দিয়ে।

এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ দেশ তথা চীন, ভারত, জাপান, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিন কোরিয়া, থাইল্যান্ড, তাইওয়ান এ প্রণালীর সাথে যুক্ত। এশিয়ার সাথে আফ্রিকা এবং পারস্য উপসগারীয় দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম দূরত্বের রুট হলো মালাক্কা প্রণালী। সুয়েজ ক্যনালের চেয়ে ৪ গুন বেশি পন্য পরিবহন করা হয় মালাক্কা প্রনালী দিয়ে।
মালাক্কা প্রণালী দিয়ে মূলত পূর্ব এশিয়ার আমদানীকৃত জ্বালানি তেল, চীনে উৎপাদিত পন্য, পাম অয়েল এবং ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার পন্য পরিবহন করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি পন্য আমদানি করে চীন থেকে। সারা বিশ্ব থেকে যুক্তরাষ্ট্র যত পন্য আমদানি করে তার ২১ ভাগেরও বেশি আমদানি করে থাকে চীন থেকে। চীনা এসব পন্য যুক্তরাষ্ট্রে যায় মালাক্কা প্রনালী দিয়ে। একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন পন্যও চীনসহ এ অঞ্চলে আনা হয় এ প্রনালী দিয়ে। এ ছাড়াও আরা বিভিন্ন কারনে সুদুর যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি জড়িত এ মালাক্কা প্রনালী কেন্দ্রিক আধিপত্য বিস্তারের রাজনীতির সাথে।

প্রাচীন কাল থেকে রোমান, গ্রীক, আরব, আফ্রিকা, পারস্য, চীন ও ভারতের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি বানিজ্য রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে মালাক্কা প্রণালী। ১৭ শতক থেকেই ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যে প্রধান শিপিং চ্যানেল হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে মালাক্কা প্রণালী।

ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তি নিয়ন্ত্রন করে এ প্রণালী। ১৯ শতকের শুরুতে ডাচ এবং বৃটিশ সা¤্রাজ্য তাদের ইচ্ছামত এখানে সীমান রেখা আঁকে তাদের নিজ নিজ নিয়ন্ত্রিত এলাকায় জলদস্যু নিয়ন্ত্রন করার জন্য। এ সীমানাই আজকের মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার সীমানা ।

ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে লিপ্ত রয়েছে চীন ও ভারত। চীন চেষ্টা করছে ভারত মহাসাগারে তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠায়।ভৌগোলিক কারনে চীনা এ আধিপত্য ঠেকাতে ভারত অনেক সুবিধা জনক অবস্থায় রয়েছে । মালাক্কা প্রনালীর পশ্চিমে প্রবেশ মুখে অবস্থান ভারতের আন্দামান নিকোবার দ্বীপপ্ঞ্জু। এখানে সামরিক উপস্থিতি ও শক্তি বৃদ্ধির পদক্ষেপ নিয়েছে ভারত। বাড়িয়েছে টহল কার্যক্রম।

ভবিষ্যত যে কোনো বড় সংঘাতে ভারত মালাক্কা প্রনালীল পশ্চিম প্রান্ত ব্লক দেয়ার অবস্থানে রয়েছে। আর এ বিষয়ে চিন্তিত চীন। ফলে মালাক্কা প্রনালীর নিরাপদ সমুদ্র বানিজ্য রক্ষাসহ এ অঞ্চলে তার সার্বিক আধিপত্য বিস্তারে ব্যাপকভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহন করেছে চীন। ফলে গত কয়েক বছর ধরে ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র-চীন-ভারত ব্যাপক সমরসজ্জার প্রতিযোগিতা চলছে। এ প্রতিযোগিতারয় চীনের বিপরীতে যুক্তরাষ্ট, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, দক্ষিন কোরিয়াসহ এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের আরো কিছু মিত্র দেশ। চীনকে মোকাবেলায় এসব দেশ অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি করে চলছে এ অঞ্চলে সামরিক শক্তি ।

মানচিত্রে মালাক্কা
মানচিত্রে মালাক্কা

 

কৌশলগত গুরুত্বের কারনে ১৫ শতক থেকে মালাক্কা নিয়ে বিভিন্ন শক্তির মধ্যে দ্ব›দ্ব চলছে। ১৮৬৯ সালে সুয়োজ ক্যানেল চালুর পর মালাক্কা প্রনালীর গুরুত্ব আরো বেড়ে যায়। ইউরোপ এবং দূর প্রাচ্যের মধ্যে দূরত্ব তিন ভাগের এক ভাগ কমে যায়।

ভবিষ্যৎ যে কোনো বড় ধরনের সংঘাতের পরিনতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত মিলে চীনের জন্য বন্ধ করে দিতে পারে মালাক্কা প্রণালী। এ কারনে চীন ইতোমধ্যে বানিজ্যর বিকল্প পথ করেছে। সেটা হলো পাকিস্তানের গোয়াদর বন্দর। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের মাধ্যমে গোয়াদর বন্দর থেকে সরাসরি চীনের সংযোগ তৈরি করা হয়েছে রেল ও সড়কের মাধ্যমে। অপর দিকে মিয়ানমারের মধ্য দিয়ে চীন তৈরি করেছে তেল ও গ্যাস পাইপ লাইন। রাখাইনের কিয়া-উক-পিউতে নির্মান করছে গভীর সমুদ্র বন্দর।

মালাক্কা বর্তমানে মালয়েশিয়ার একটি রাজ্যের নাম। মালয়েশিয়ায় প্রাচীন যেসব রাজবংশ রযেছে তার মধ্যে অন্যতম হলো মালাক্কা সুলতানাত। মালাক্কার রাজা ইসকান্দার শাহ নামেও পরিচিত। মালয় পেনিন সুলার অধিকাংশ এলাকা এবং ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল তাদের রাজ্য।

দীর্ঘ সময় মালাক্কা ছিল ইসলামী শিক্ষার অন্যতম কেন্দ্র। ১৫১১ সালে পর্তুগীজদের আগমনের ফলে বিলুপ্ত হয় প্রাচীন মালাক্কা বা মালয় রাজবংশ। মালাক্কা সুলতানাত বা মালাক্কা রাজবংশের নাম অনুসারে নাম রাখা হয়েছে মালাক্কা প্রণালীর নাম। মালাক্কা চ্যানেলের তীরে অবস্থিত ছিল প্রাচীন মালাক্কা রাজবংশ ।

বর্তমানে মালাক্কার রাজধানী মালাক্কা সিটিরও অবস্থান এ চ্যানেলের তীরে। বর্তমানে মালাক্কা রাজ্য মালয়েশিয়ার অন্যতম একটি পর্যটন কেন্দ্র। মালাক্কার রয়েছে ব্যতিক্রমী ইতিহাস। প্রাচীন কাল থেকে মালাক্কা একটি গুরুত্বপূর্ণ নৌ বানিজ্য কেন্দ্র হিসেবে সু পরিচিতি। মালাক্কা রাজ্যের আয়তন ৬৪২ বর্গমাইল। মালাক্কা প্রণালী ঘিরে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুরে রয়েছে ব্যাপক অর্থনৈতিক কর্মতৎপরতা।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে