বাংলাদেশ কিনছে সি-১৩০ জে সুপার হারকিউলিস বিমান

সি-১৩০ জে সুপার হারকিউলিস বিমান - ইন্টারনেট

  • মেহেদী হাসান
  • ২৭ মে ২০২০, ০০:৫৯

বাংলাদেশ যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে ৫টি শক্তিশালী সামরিক পরিবহন বিমান কিনেছে। এর নাম সি-১৩০ জে সুপার হারকিউলিস। ২০১৯ সালের আগস্টে বাংলাদেশ প্রথম দফায় একটি সি-১৩০ জে সামরিক বিমান বুঝে পায় যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে।

সি-১৩০ জে সুপার হারকিউলিস সামরিক পরিবহন বিমানের নির্মাতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত সমরাস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান লকহিড মার্টিন। বাংলাদেশ যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে যে বিমানগুলো ক্রয় করছে তা লকহিড মার্টিন নির্মান করেছিল বৃটিশ রয়াল এয়ারফোর্সের জন্য। বাংলাদেশ সরকার বৃটিশ সরকারের সাথে তাদের এ বিমান ক্রয় চুক্তি করে ২০১৮ সালে। বিমানগুলো বাংলাদেশের কাজে ব্যবহারের উপযুক্ত করার জন্য বিভিন্ন ধরনের মোডিফিকেশন করা হয়েছে।

সি-১৩০ জে সুপার হারকিউলিস সামরিক পরিবহন বিমান বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে যুক্ত হওয়ায় বিমান বাহিনীর বর্তমান এয়ারলিফট সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে । একই সাথে শক্তি বাড়বে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর। দেশের অভ্যন্তরে এবং বিদেশী শান্তি মিশন পরিচালনায় ভ‚মিকা পালন করবে এ বিমান। সি-১৩০ জে সুপার হারকিউলিস সামরিক পরিবাহন বিমান হলেও এটি শক্তিশালী যুদ্ধ বিমানের ভ‚মিকাও পালন করতে পারে। গানশিপ নামেও পরিচিত এ বিমান। ভারী গানশিপে সজ্জিত এ বিমান ব্যাপকভাবে ভ‚মিতে আক্রমন পরিচালনা করতে পারে।

এ বিমান বোমারু বিমানের ভ‚মিকা পালন করতে পারে । প্যারাসুটের মাধ্যমে য্দ্ধুক্ষেত্রে তড়িত সৈন্য নামাতে পারে সি-১৩০ জে বিমান। এ ছাড়া বিশেষ অপারেশন, উদ্ধার অভিযান, ত্রান তৎপরতা, বৈজ্ঞানিক গবেষণা, আকাশে রিফুয়েলিং, সমুদ্র টহল এবং আকাশ যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করতে পারে সি-১৩০ সুপার হারকিউলিস। প্রশিক্ষনের কাজেও ব্যবহার করা হবে এ বিমান।

আকাশে টানা আট ঘন্টা উড়তে পারে সি-১৩০ জে বিমান। লকহিড মার্টিন সি-১৩০ জে সুপার হারকিউলিস হলো চার ইঞ্জিন বিশিষ্ট সামরিক পরিবহন বিমান। এটি সি-১৩০ হারকিউলিস পরিবারের আধুনিক সংস্কারন।

সি-১৩০ হারকিউলিস পরিবারের বিমানের ৪০টিরও বেশি মডেল রয়েছে। এর মধ্যে শক্তিশালী কয়েকটি বিমানের মডেল হলো এসি ১৩০, কেসি ১৩০ জে, সিসি, এসি, ইসি, এইচসি, এমসি, ডব্লিউসি, এসসি, এম এল। এগুলো সবই অত্যন্ত শক্তিশালী যুদ্ধ বিমান এবং ভারী গানশিপ।

মার্কিন এয়ারফোর্সের কাছে হারকিউলিস পরিবারের সি-১৩০ বিভিন্ন মডেলের ৪০০ এর বেশি বিমান সক্রিয় রয়েছে। এছাড়া মার্কিন মেরিনের কাছে ৬৪টি সি ১৩০ বিভিন্ন মডেলের বিমান রয়েছে।

বিশ্বে দীর্ঘদিন ধরে যেসব সামরিক বিমান উৎপাদন অব্যাহত রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো হারকিউলিস পরিবারের সি-১৩০ পরিবহন বিমান। ৬০ বছরের অধিক সময় ধরে সামরিক বেসামরিক এবং মানবিক ত্রান তৎপরতাসহ বহুমুখী কাজে অংশ নিচ্ছে এ বিমান।

বিশ্বের ৭০টির অধিক দেশের কাছে রয়েছে হারকিউলিস পরিবারের বিভিন্ন মডেলের সি-১৩০ বিমান। আর শুধুমাত্রা সি-১৩০ জে মডেলের সামরিক পরিবহন বিমান রয়েছে ১৭টি দেশের কাছে। ১৭টি দেশে চার শতাধিক সি-১৩০ জে সুপার হারকিউলিস বিমান বিক্রি করেছে লকহিড মার্টিন।

১৯৯৬ সালের ৫ এপ্রিল প্রথম আকাশে ওড়ে সি-১৩০ জে সুপার হারকিউলিস। এর প্রাথমিক ব্যবহারকারী হলো মার্কিন এয়ারফোর্স, মার্কিন মেরিন কর্পস, মার্কিন নেভি, বৃটিশ রয়াল এয়ার ফোর্স এবং ভারতীয় বিমান বাহিনী।

এ ছাড়া কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্ক, নরওয়ে, ইতালী, ফ্রান্স, জামানি, দক্ষিন কোরিয়া এবং ইসরাইলের এয়ারফোর্স ব্যবহার করে সি-১৩০ জে সুপার হারকিউলিস। সৌদি আরব, ইরাক, কাতার, ওমান, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশর, বাহরাইন, লিবিয়, তিউনিশিয়া, মেক্সিকো, পেরুর কাছেও রয়েছে একই মডেলের বিমান।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক এবং আফগনিস্তান অভিযানে মার্কিন এয়ার ফোর্স, নেভি এবং মেরিন কর্পস ব্যপকভিত্তিক ব্যবহার করে সি-১৩০ জে সুপার হারকিউলিস। কানাডাও আফগানিস্তানে ব্যবহার করেছে এ বিমান।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে লিবিয়ায় অপারেশন ওডিসি ডনে বিভিন্ন দেশ প্রেরণ করে সি-১৩০ জে সুপার হারকিউলিস। ২০১১ সালে লিবিয়ায় ন্যাটোর অপারেশনেও ব্যবহার করা হয় এ বিমান।

সি-১৩০ জে সুপার হারকিউলিস ৯২ জন যাত্রী বহন করতে পারে। সর্বোচ্চ ওজন বহন করতে পারে ৭০ টন। পে লোড ক্ষমতা ১৯ টন। বিমানটির দৈর্ঘ্য ৯৭ ফিট। উচ্চতা ৩৮ ফিট। দুই ডানার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তের দূরত্ব ১৩২ ফিট। শুধু বিমানটির ওজন ৩৪ টন ২৭৪ কেজি। সর্বোচ্চ গতি ঘন্টায় ৪১৭ মাইল।

সি-১৩০ সামরিক পরিবহন বিমানের মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী হলো এসি-১৩০ গানশিপ। ভ‚মিতে আক্রমন পরিচালনায় খুবই কার্যকর এ হেভি গানশিপ।

হারকিউলিস পরিবারের সি-১৩০ সামরিক বিমান প্রথম আকাশে ওড়ে আজ থেকে ৬৫ বছর আগে ১৯৫৪ সালের ২৩ আগস্ট। মার্কিন এয়ারফোর্সে এটি যুক্ত হয় ১৯৫৬ সালে। এরপর দ্বিতীয় দেশ হিসেবে অস্ট্রেলিয়ান আর্মিতে যুক্ত হয় এ বিমান।

২০০৭ সালে সি-১৩০ হারকিউলিস বিমান বিশ্বের ৫ম বিমানে পরিণত হয় যা ৫০ বছরের অধিক সময় ধরে উৎপাদনে সক্রিয় রয়েছে। ২০১৫ সাল পর্যন্ত ২ হাজার ৫শ সি-১৩০ বিভিন্ন মডেলের বিমান তৈরি করে লকহিড মার্টিন। সি-১৩০ হারকিউলিসের রয়েছে একটি বেসামরিক মডেল তথা এল ১০০ হারকিউলিস। সৌদি আরবসহ আরো কয়েকটি দেশের কাছে রয়েছে এ বিমান।

সি-১৩০ বিমান প্রথমে তৈরি করা হয় শুধুমাত্র সৈন্য পরিবহন, মেডিকেল ইভাকুয়েশন এবং পন্য পরিবহনের জন্য। কিন্তু বর্তমানে সি-১৩০ বিভিন্ন মডেলের বিমান শক্তিশালী গানশিপসহ বহুমুখী কার্যক্রম পরিচালনা করে। ১৯৬৩ সালে প্রথম একটি সি-১৩০ বিমান অবতরণ করে মার্কিন বিমানবাহী রণতরীতে। আর এটিই এখন পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে ভারী বিমান যা বিমানবাহী রণতরীতে অবতরণ করতে সক্ষম হয়।

সি-১৩০ বিমান মার্কিন এয়ারফোর্সে যুক্ত হবার পর থেকে মার্কিন সকল বৈশ্বিক অপারেশনের অপরিহার্য সঙ্গী হলো সি-১৩০ মডেলের বিভিন্ন বিমান। রাশিয়ার সাথে দীর্ঘ ঠান্ডা লড়াই চলাকলে টহল দান থেকে শুরু করে, ভিয়েত নাম যুদ্ধ, ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া অপারেশনের অবিচ্ছেদ্য অংশ সি-১৩০ বিভিন্ন মডেলের বিমান।

সারা বিশ্বে আজ যে মার্কিন আধিপত্য তার অন্যতম বাহন সি-১৩০ হারিকিউলিস পরিবারের বিমান। বিশ্বের সকল বড় বড় যুদ্ধে আকাশে রিফুয়েলিংয়ের কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিক পালন করেছে সি-১৩০ মডেলের ফুয়েল ট্যাঙ্কার। ১৯৬৬ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত চীনের পারমানবিক কার্যক্রমের ওপর নজরদারি পরিচালনার কাজেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যবহার করে সি-১৩০ বিমান।

১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধে মার্কিন এয়ারফোর্স, নেভি, ও মেরিনসহ অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, সৌদি আরব ও দক্ষিন কোরিয়া ব্যবহার করে সি-১৩০ বিমান। এসময় ইরাকের ওপর ব্যাপক মোমা বর্ষনের কাজে নিয়োগ করা হয় এ বিমান।

২০০১ সালে আফগানিস্তান অভিযানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মিত্র ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো সি-১৩০ মডেলের পরিবহন বিমান ব্যবহার করে। বিশ্বের প্রায় ৭০টি দেশের কাছে রয়েছে সি-১৩০ বিভিন্ন মডেলের বিমান। একারনে অর্ধশতাব্দিরও বেশি সময় ধরে বিশ্বের প্রায় সকল যুদ্ধ সংঘাতে অংশ নেয়ার রেকর্ড রয়েছে সি-১৩০ বিমানের।

১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের সময় পাকিস্তান তাদের কাছে থাকা সি-১৩০ বি বিমানকে বোমারু বিমানে রুপান্তর করে। এসময় ভারতের বিভিন্ন ব্রিজ, সামরিক অবকাঠামোর ওপর ব্যাপক বোমা বর্ষনের কাজে ব্যবহার করা হয় এ বিমান। এ ছাড়া এ বিমানের সাহায্যে ভ‚-পাতিত করা হয় তখন ১৭টি বিমান। ৭ হাজার ফিট নিচ দিয়ে এ বিমান উড়তে সক্ষম হওয়ায় সঠিক লক্ষ্যবস্তুতে বোমা বর্ষন করতে পারে সি-১৩০। ১৯৮২ সালে বৃটেনের বিরুদ্ধে ফকল্যান্ড যুদ্ধে আর্জেনটিনার পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সি-১৩০ বিমান।

বাংলাদেশের কাছে আগে থেকেই লকহিড মার্টিনের সি-১৩০ মডেলের বিমান রয়েছে এবং কঙ্গো শান্তি মিশনে নিযুক্ত রয়েছে এ বিমান। পুরনো এ বিমানের স্থলে এখন যুক্ত হবে হারকিউলিস পরিবারের নতুন মডেলের সি-১৩০ জে বিমান।

প্রতিবেদনটির ভিডিও দেখুন

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে