চীনকে মোকাবিলায় ভারতের নৌবাহিনী

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের নৌবাহিনীকে সাব-হান্টিং হেলিকপ্টার সরবরাহ দেয়ার জন্য তড়িঘড়ি শুরু করেছে - ইন্টারনেট

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ২৬ মে ২০২০, ০৪:১০

একটা প্রাচীন প্রবাদ আছে, 'শত্রূর শত্রূ আমার বন্ধু'। ব্যক্তিগত থেকে শুরু করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রবাদটি সত্যতা প্রমান করে চলেছে। হালে এটি আবারও প্রমানিত হতে চলেছে চীন-মার্কিন-ভারত সম্পর্কের বেলায়ও। জানা গেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চীনভীতির সুফল পেতে চলেছে ভারতের নৌবাহিনী।

চীনের সামরিক সম্প্রসারণে উদ্বিগ্ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের নৌবাহিনীকে সাব-হান্টিং হেলিকপ্টার সরবরাহ দেয়ার জন্য তড়িঘড়ি শুরু করেছে। ভারতীয় নৌবাহিনী অবশ্য বলেছে, চীনের সামরিক সম্প্রপ্রসারণ দেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাগল হয়ে গেছে - ব্যাপারটি এমন নয়। কিন্তু অন্যরা বলছেন, ব্যাপারটি অনেকটা এরকমই। প্রতিরক্ষা বিষয়ক বিখ্যাত সাময়িকী 'ব্রেকিং ডিফেন্স'-এ একজন বিশেষজ্ঞ লিখেছেন, ভারতের নৌবাহিনীকে সাব-হান্টিং হেলিকপ্টার সরবরাহ দেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এমন ব্যস্ত হয়ে ওঠে যে, তারা নিজেদের কিছু হেলিকপ্টারের ডেলিভারিও পিছিয়ে দিয়েছে। আগামী বছরের গোড়ার দিকে এসব হেলিকপ্টার ডেলিভারি পাওয়ার কথা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের।

যুক্তরাষ্ট্রের এ তড়িঘড়ির কথা স্বীকার করে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের একজন পরিচালক সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেন, ভারতের নৌবাহিনী আসলেই এক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাচ্ছে। আমরা দ্রুত ওই হেলিকপ্টারগুলো নির্মাণ সম্পন্ন করতে বলেছি। কারণ, আমরা মনে করি এর জরুরি প্রয়োজন রয়েছে।

প্রশ্ন হলো, এ 'জরুরিয়তটা' কিভাবে তৈরি হলো? নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারত মহাসাগরজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে চীনের নৌবাহিনীর জাহাজ, আন্ডারওয়াটার ড্রোন এবং তথাকথিত অসামরিক পতাকাবাহী মাছ ধরার নৌকা, যা আসলে তাদের মেরিটাইম মিলিশিয়া বা আধা-সামরিক নৌরক্ষী। চীনের এ অপ্রতিহত অগ্রযাত্রা থেকেই সৃষ্টি হয়েছে ভারতীয় নৌবাহিনীর আদ্যিকালের ব্রিটিশ-নির্মিত নেভাল হেলিকপ্টারের বহর বদলানোর প্রয়োজনীয়তা।

এ নিয়ে তাড়াহুড়া তাই দু'পক্ষেরই। ভারতের যেমন এসব স্টেট-অব-দ্য-আর্ট বা সর্বাধুনিক প্রাগ্রসর প্রযুক্তির হেলিকপ্টার ব্যবহারের তাড়া রয়েছে, তেমনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও চাচ্ছে চীনের ক্রমবর্ধমান নৌশক্তির সামনে প্রতিবন্ধকরূপে ভারতকে দাঁড় করিয়ে দিতে। তাই মার্কিন নৌবাহিনী একদম নতুন তিনটি এমএইচ-৬০আর সী হকস হেলিকপ্টার ভারতীয় নৌবাহিনীকে দেয়ার জন্য নির্মাতা কর্তৃপক্ষকে অনুমতি দিয়েছে। আগামী বসন্তে এগুলো সরবরাহ পাবে ভারতীয় নৌবাহিনী। এখন এগুলোকে ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী মোডিফাই বা রদবদল করা হচ্ছে।

'দ্য ইকনমিক টাইমস' পত্রিকার খবরে বলা হয়, ২৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দামের এসব 'রোমিও' সী হক হেলিকপ্টারে রয়েছে অত্যাধুনিক সব যুদ্ধসরঞ্জাম। যেমন, সেন্সর, মিসাইল এবং শত্রূর নৌযান ও সাবমেরিন শনাক্ত ও ধ্বংস করতে পারার মতো টর্পেডো, যা কিনা যে কোনো সাবমেরিন ক্যাপ্টেনের বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।

'ব্রেকিং ডিফেন্স' সাময়িকী জানাচ্ছে, আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই নতুন তিনটি এমএইচ-৬০আর সী হকস হেলিকপ্টার হাতে পাবে ভারতীয় নৌবাহিনী। বাকি ২১টি হেলিকপ্টার সরবরাহ দেয়া হবে ২০২৩ ও ২০২৪ সালে। এসব 'কপ্টার সজ্জিত থাকবে মাল্টি-মোড রেডার, হেলফায়ার মিসাইল, মার্ক ৫৪ টর্পেডো এবং প্রেসিশন-কিল রকেট দিয়ে। এগুলোতে আরো থাকবে গভীর জলতলের শব্দ শনাক্তকরণের ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে এসব হেলিকপ্টার মূলত সাবমেরিনবিরোধী যুদ্ধের আকাশযান হিসেবে ব্যবহৃত হবে।

সাময়িকীটি আরো জানায়, এসব হেলিকপ্টার সীমিত আকারে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, নজরদারি এবং অনুসন্ধান ও উদ্ধার কার্যক্রমেও ব্যবহার করা হবে। ভারত সরকারের সাথে নির্মাতা কোম্পানিটির সম্পাদিত চুক্তিগুলোর মধ্যে এটাই সর্ববৃহৎ। কৌতুহলোদ্দীপক হলো, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির 'মেক ইন ইন্ডিয়া' নীতি এক্ষেত্রে কাজে আসছে না।

হেলিকপ্টারটি নিয়ে অনুশীলন। ছবিটি এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া
হেলিকপ্টার নিয়ে অনুশীলন। ছবিটি এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া

 

আগেই বলা হয়েছে যে হেলিকপ্টারগুলোকে ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী মোডিফাই বা রদবদল করা হচ্ছে। এ রদবদলের বেশিরভাগই হচ্ছে আকাশযানটির কমিউনিকেশন ও ডেটা শেয়ারিং সিস্টেমে। কেননা, ভারতীয়রা চায় তাদের স্যাটেলাইটের সাথে কথা বলার সক্ষমতা। তাই তাদের দেশীয় উপগ্রহ স্যাটকম-এর সাথে একটা ডেটা লিঙ্ক দিয়ে দেয়া হয়েছে। তারা তাদের শিপগুলোর সাথেও কথা বলার ব্যবস্থা চায়। সে-ব্যবস্থাও করা হচ্ছে। এছাড়া আরো কিছু রদবদলের কাজ চলছে।

'ব্রেকিং ডিফেন্স' সাময়িকী জানাচ্ছে, এমএইচ-৬০আর সী হকস হেলিকপ্টারের জন্ম হয়েছিল মূলত সাবমেরিন শিকারি হিসেবে। হেলিকপ্টারগুলোকে ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী মোডিফাই করার বেলায়ও ওই বৈশিষ্ট্য বজায় রাখা হবে। ভারতের হাতে আসার পর এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের কাজে দেশীয় সমরশিল্প প্রতিষ্টানগুলোও অংশ নেবে। ভারতকে দিয়ে চীনকে ঠেকানোর এ মার্কিন তোড়জোড় এবং মার্কিনীদের কাঁধে সওয়ার হয়ে চীনের সাথে পাল্লা দেয়ার ভারতীয় ব্যগ্রতার বিপরীতে চীন কি করছে, দেখা যাক।

২০১৫ সালে প্রকাশিত চীনের গণমুক্তি ফৌজ বা পিএলএ-র প্রতিরক্ষা খাত বিষয়ক শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কৌশলগত প্রতিযোগিতা নিয়ে কঠিন শব্দ ব্যবহার করায় শ্বেতপত্রটি সে-সময় সংবাদ শিরোনাম হয়েছিল। তবে সংবাদ শিরোনাম হওয়াটাই কথা নয়, মনোযোগ দিয়ে অধ্যয়ন করলে এর মাঝেই যে-কেউ দেখতে পেতো চীনা গণমুক্তি ফৌজের দূরপ্রসারী আকাঙ্খা - তারা আঞ্চলিক বৃত্ত ছাড়িয়ে বৈশ্বিক অঙ্গনে পায়ের ছাপ রাখতে চায়।
এমনিতে নিজ নৌসীমানার বাইরে ক্ষমতা প্রদর্শনের বেলায় আমেরিকার চাইতে অনেক-অনেক দূর পিছিয়ে আছে চীন, কিন্তু আপন চৌহদ্দির মধ্যে, বিশেষ করে দক্ষিণ চীন সাগরে দেশটি ক্রমাগত সক্ষমতা বাড়িয়ে চলেছে। বিতর্কিত জলসীমাটিতে তারা একের পর সেনাঘাঁটি, উড়োজাহাজ অবতরণক্ষেত্র এবং কৃত্রিম দ্বীপ বানিয়ে চললেও কোনো দিক থেকে কোনো রকম বাধা আসছে না।

পত্রপত্রিকার খবরে বলা হয়, ২০১৪ সাল থেকে চীন যত যুদ্ধজাহাজ ও সাবমেরিন চালু করেছে, তা ব্রিটেনের মোট জাহাজবহরের সমান। ২০১৫ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে দেশটি চালু করেছে চার লাখ টন ক্ষমতার জলযান, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিগুণ। ২০৩০ সাল নাগাদ চীনা নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ ও সাবমেরিনের সংখ্যা পৌঁছাতে পারে ৫৩০-এ, যা এখন ৪০০।

চীনের এ সক্ষমতা স¤প্রসারণের পেছনে রয়েছে আপন উপকূল ছাড়িয়ে বহু দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ার স্বপ্ন। তাদের এ তৎপরতা কমার কোনো লক্ষণ নেই, বরং গণমুক্তি ফৌজের শ্বেতপত্রে সেটা আরো স্পষ্ট। এতে আছে ''চীনের বৈদেশিক স্বার্থ সংরক্ষণ'' শীর্ষক একটি অধ্যায়। এর তৃতীয় অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে ২০১৭ সালে জিবুতিতে চীনের সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্টার কথা, যা 'পিএলএ জিবুতি সহায়তা ঘাঁটি' নামে পরিচিত। বহির্বিশ্বে চীনের ওটাই প্রথম সামরিক ঘাঁটি। এর মাধ্যমে দেশটি তাদের বহু দিনের একটি নীতি থেকে সরে আসে। নীতিটি হলো, চীন কখনও দেশের বাইরে কোনো সামরিক কর্মকান্ড পরিচালনা করবে না।

শ্বেতপত্রে আভাস দেয়া হয় যে দেশের বাইরে চীনের আরো সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠার কাজ এগিয়ে চলছে। 'ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল' আভাসটিকে আরো খোলাসা করেছে গত সপ্তাহে প্রকাশিত এক খবরে। এতে বলা হয়, চীন কম্বোডিয়ায় তার দ্বিতীয় বৈদেশিক সামরিক ঘাঁটি গড়তে চলেছে। এ লক্ষ্যে তারা দেশটির সাথে নীরবে একটি চুক্তিও করে ফেলেছে।

কম্বোডিয়ার সাথে সামরিক সহযোগিতার মাধ্যমে ইন্দো-প্যাসিফিক রিজিয়নের প্রানকেন্দ্রে অবস্থিত থাইল্যান্ড উপসাগরে সরাসরি চলে আসতে পারবে। যেখান দিয়ে ভারতের বাণিজ্যপথ ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে। এ পথের ওপর চীনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্টা হলে ভারতের অবস্থা কেমন হবে, সেটা ভাববার মতো বিষয়ই বটে!

শ্বেতপত্রে চীনের প্রেসিডেন্ট সি জিন পিং-এর নেতৃত্বে দেশের সামরিক ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তনের রূপরেখাও তুলে ধরা হয়। এতে জানানো হয়, সামরিক বাহিনীর লোকবল তিন লাখ কমানো হয়েছে। বিমান বাহিনীর লোকবল যেমন ছিল তেমনই রাখা হয়েছে আর কিছুটা বাড়ানো হয়েছে নৌবাহিনীতে। স্পষ্ট যে, চীন এখন সমুদ্র নিরাপত্তার দিকে পূর্ণ নজর দিয়েছে।

তাদের দেশে তৈরি প্রথম বিমানবাহী রণতরী এখন পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে পরীক্ষামূলক টহলে আছে। দ্বিতীয় রণতরীটির নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে, এটি এখন হস্তান্তরের অপেক্ষায় আছে। আর নির্মাণকাজ চলছে তৃতীয় ও বৃহত্তম রণতরীটির। পর্যবেক্ষকদের ধারণা, হাতে এলে এটিই ভারত মহাসাগরে মোতায়েন করবে চীন।

প্রতিবেদনটির ভিডিও দেখুন

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে