মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে যুদ্ধের শঙ্কা

মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি নিয়ে একটি কার্টুন - আফ্রিকা কার্টুন ডটকম

  • মেহেদী হাসান
  • ২৫ মে ২০২০, ০০:১০

মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে আবার নতুন করে যুদ্ধের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ যুদ্ধ পরিস্থিতির পেছনে রয়েছে ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর আর জর্ডান উপত্যকা ইসরাইলের সাথে যুক্ত করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা। ইসরাইলের দখলে থাকা পশ্চিম তীরের অধিকাংশ এলাকা ইসরাইলের সাথে যুক্ত করে সেখানে ইহুদী বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে ইসরাইল। ইসরাইলের এ পরিকল্পনার বিরুদ্ধে বড় ধরনের যুদ্ধের হুমকি দিয়েছেন জর্ডানের বাদশা আব্দুল্লাহ। ফলে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে দীর্ঘ মেয়াদী সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার বড় ধরনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। অপরদিকে মধ্যপ্রাচ্য যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের সাথে ওয়াশিংটনের দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। শুরু হতে যাচ্ছে নতুন করে অস্ত্র প্রতিযোগিতা।

মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি কিছুদিন থেকে নতুন রুপ নিয়েছে। আঞ্চলিক রাজনীতি ও সামরিক দিক দিয়ে ইসরাইল একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হয়ে পড়ছে। অপরদিকে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অন্য মিত্রদেশগুলোর সাথে ওয়াশিংটনের সর্ম্পকে রুপান্তর ঘটছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান মিত্র দেশগুলোর একটি সৌদি আরব। দেশটি থেকে প্যাট্রিয়ট ক্ষেপনাস্ত্র সরিয়ে নেয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আস্থাহীনতা বেড়েছে সৌদি আরবের। গত বছর সৌদি তেল ক্ষেত্রে হামলার পর থেকে প্রতিরক্ষা সর্ম্পক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এক ধরনের দূরত্ব তৈরি হয় রিয়াদের। প্যাট্রিয়ট ক্ষেপনাস্ত্র সরিয়ে নেয়ায় সৌদি আরব ইরানের মোকাবেলায় নিজেকে নিরাপদ মনে করছে না। ফলে ইরানকে মোকাবেলায় নতুন করে সৌদি আরবের অস্ত্র প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেক বিশ্লেষক।

করোনার কারনে পঙ্গু হতে চলেছে তেল নির্ভর মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতি। এ অবস্থায় দেশগুলো নতুন করে অস্ত্র প্রতিযোগিতা আর যুদ্ধ সংঘাতে লিপ্ত হলে তা আরবের দেশগুলোর জন্য বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। উপসাগরীয় দেশগুলোর জন্য এর প্রভাব হতে পারে অনেক সুদুরপ্রসারী। সৌদি দুটি তেল ক্ষেত্রে গত বছর হামলার পর নিরাপত্তার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দুটি প্যাট্রিয়ট ক্ষেপনাস্ত্র সিস্টেম মোতায়েন করেছিল। এ ক্ষেপনাস্ত্র মোতায়েনে ইরানের বিরুদ্ধে সৌদি প্রতিরক্ষা অনেক শক্তিশালী হয় বলে মনে করা হয়।

পেন্টাগন থেকে বলা হয়েছে সৌদি আরবের প্রতি ইরানের হুমকি এখন কমে এসেছে। বাস্তবতা হচ্ছে সৌদি আরব থেকে প্যাট্রিয়ট ক্ষেপনাস্ত্র সরিয়ে নেয়ায় ঘটনায় একটি বিষয় স্পষ্ট দেশটি প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করতে পারছে না।

যুক্তরাষ্ট্রের এ অস্ত্র প্রত্যাহার এমন এক সময় হলো যখন ইরান সফলভাবে কক্ষপথে সামরিক স্যাটেলাইট উৎক্ষেপন করেছে। বিশ্বের ১২টির মত দেশের মহাকাশের কক্ষপথে নিজস্ব স্যাটেলাইট উৎক্ষেপন ক্ষমতা রয়েছে। ইরান তার একটি । ইরানের এ প্রচেষ্টা এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতাকে নতুন মাত্রায় নিতে পারে।

মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি নিয়ে একটি কার্টুন। ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ
মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি নিয়ে একটি কার্টুন। ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ

 

ইরানের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাসহ বিভিন্ন ধরনের কঠোর নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও এ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপন দেশটির সক্ষমতার নতুন প্রমান হিসেবে দেখা হচ্ছে। ইরানের রেভুলশনারি গার্ড স্পেস ডিভিশন কমান্ডার জেনারেল আলি জাফরাবাদি বলেন, নতুন এ স্যাটেলাইট ইরানি আর্মিকে আইডেনটিফিকেশন, কমিউনিকেশন এবং নেভিগেশন মিশনের ক্ষেত্রে কৌশলগত সহায়তা করবে ।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের আশঙ্কা নতুন এ স্যাটেলাইট ইরানের ব্যালেস্টিক মিসাইল সক্ষমতা বৃদ্ধি করবে। ব্যালেস্টিক মিসাইল হলো ইরানের প্রতিরক্ষার মূল ভিত্তি। একই সাথে এ স্যাটেলাইট লেবানের ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহকে শক্তিশালী করতে পারে। তাদের কাছে রয়েছে ব্যাপক রকেট এবং জিপিএস গাইডেড অস্ত্র। এগুলোকে আরো সক্ষম করতে ব্যবহৃত হতে পারে এ স্যাটেলাইট।

২০১৮ সালে সৌদি ক্রাউন প্রিন্স বিন সালমান হুমকি দিয়ে বলেন, কোনো সন্দেহ নাই ইরান পরমানু বোমা বানানোর সাথে সাথে আমরাও এটি অর্জনের চেষ্টা করবো যত দ্রুত সম্ভব। প্রিন্স সালামানের এ হুমকির মাঝে ছিল নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতার ঝুকি। ট্রাম্প প্রশাসন ইরানের সাথে পারমানবিক চুক্তি থেকে সরে আসার প্রস্তুতি নেয়ার সময় প্রিন্স সালমান এ হুমকি দেন।

সৌদি আরবে বেসামরিক পরমানু কর্মসূচীতে মার্কিন সহয়াত বিষয়ক আলোচনা এরপর থেমে যায়। কারন পরমানু সমৃদ্ধকরণ এবং পুন:প্রক্রিয়া বিধিনিষেধের কারনে সৌদি আরব তাতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এ বিষয়ক মার্কিন এক প্রতিবেদনে বলা হয় ইন্টারন্যশনাল এটমিক এনার্জি এজেন্সির সাথে অতিরিক্ত একটি প্রটোকল সাক্ষরেও সৌদি আরব প্রত্যাখ্যান করে। এ চুক্তির ফলে আন্তর্জাতিক এ সংস্থাকে সৌদি পরমানু কর্মসূচীর যাবতীয় তথ্য প্রদান করতে হবে এবং এ বিষয়ক যে কোনো কার্যক্রম পর্যবেক্ষনে তাদের অধিকার থাকবে।

ক্রাউন প্রিন্স বিন সালমানের ২০৩০ ভিশন পরিকল্পনার অন্যতম ভিত্তি হলো স্থানীয় সমরাস্ত্র শিল্প গড়ে তোলা। সৌদি অর্থনীতিতে বৈচিত্র আনার মহা পরিকল্পনা বিষয়ক এ ব্লু প্রিন্ট এখন অকার্যকরের পথে করোনার ফলে বৈশ্বিক মন্দার কারনে। সৌদি আরব বিক্রয় পন্যের ক্ষেত্রে ট্যাক্স তিন গুন বাড়িয়ে ৫ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ ঘোষণা করেছে এবং সরকারি কর্মচারিদের ভাতা সুবিধা বন্ধ করেছে।

ওয়াশিংটনভিত্তিক গালফ মিলিটারি বিশ্লেষক এন্থনি করডেসম্যান সতর্ক করে বলেছেন, সৌদি আরবে সমরশিল্প গড়ে তোলা দেশটির অর্থনীতির বৈচিত্রকরনের সবচেয়ে ভাল উপায় নয়। তিনি বলেন, সৌদি সমর শিল্পে উৎপাদিত অস্ত্র তারা আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করতে পারবে না।

গভীর মরুভ‚মিতে সৌদি আরব ব্যালিস্টিক মিসাইল তৈরি এবং পরীক্ষার কেন্দ্র নির্মান করেছে এরকম একটি স্যালেটাইট চিত্র প্রকাশিত হয়েছে গত বছর। অনেকে মনে করে সৌদি আরব পরমানু বোমা বহনে সক্ষম ক্ষেপনাস্ত্র উৎপাদনের চেষ্টা করছে। আর এটা তারা করছে ইরানকে মোকাবেলায়।

এশিয়া টাইমসের এক বিশ্লেষনে বলা হয়েছে সৌদি আরব আগামী বছর থেকে সামরিক ড্রোন বিমান তৈরি করতে যাচ্ছে যা ইরানের ড্রোন বিমানের সমান অস্ত্র বহন করতে পারবে। আর এটি তারা করছে চীনের সহায়তায়। ২০১৭ সালে সৌদিতে ড্রোন বিমান তৈরি কেন্দ্র নির্মানে রাজি হয় চীন । চীনের বাইরে এটি হচ্ছে তাদের প্রথম বিদেশী অস্ত্র কারখানা। আসলে মধ্য প্রাচ্য হয়ে উঠেছে বিশ্বের ড্রোন যুদ্ধের ক্ষেত্র। দেখা যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের আরব মিত্রদের সাথে দূরত্ব তৈরি হলে সে শুন্যতা দ্রুত পূরন হচ্ছে। চীন ও রাশিয়া মধ্যপ্রাচ্যের সমরাস্ত্রের বাজারে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করছে।

মধ্যপ্রাচ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতার মধ্যে জর্ডানের বাদশা দ্বিতীয় আব্দুল্লাহ পশ্চিম তীরে ইসরাইলের দখলদারিত্বর বিরুদ্ধে কঠোর কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেন, ইসরাইল যদি দখলীকৃত পশ্চিম তীরের অধিকাংশ এলাকা তার নিজের সাথে যুক্ত করার পরিকল্পনা করে তাহলে বড় ধরনের যুদ্ধ হবে। এ ক্ষেত্রে জর্ডান সব রকম ব্যবস্থা নেয়ার কথা বিবেচনা করবে । অপর দিকে ইসরাইলের পশ্চিম তীর স্থায়ীভাবে দখল পরিকল্পনায় পূর্ণ সমর্থন রয়েছে ট্রাম্প প্রশাসনের। ফলে ইসরাইলের এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ইউরোপীয় ইউনিয়ন আপত্তি জানালেও তা কতটা আমলে নেবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

এক বছর ধরে চলমান রাজনৈতিক বিরোধ অবসানের পর বিরোধী দলের সাথে কোয়ালিশন সরকার গঠন করেছে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। কোয়ালিশন সরকার তাকে অনুমতি দিয়েছে আগামী ১ জুলাইয়ের মধ্যে দখলীকৃত পশ্চিম তীর ইসরাইলের সাথে যুক্ত করার পরিকল্পনা পেশ করার জন্য। ইসরাইল ইতোমধ্যে পশ্চিম তীর স্থায়ীভাবে দখলের কার্যক্রম শুরু করেছে।

পশ্চিম তীরের তিন ভাগের এক ভাগ ইসরাইলের সাথে যুক্ত করার পরিকল্পনাকে ট্রাম্প প্রশাসন পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে । পশ্চিম তীর দখল করার পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনার জন্য মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী মাইক পম্পেও ইসরাইল সফর করেছেন। পশ্চিম তীর ও জর্ডান উপত্যকা ইসরাইল নিজের সাথে যুক্ত করলে সেখানকার ফিলিস্তিন বসতি এলাকাগুলো হয়ে যাবে বিচ্ছিন্ন কিছু ছিটমহল। পশ্চিম তীর ইসরাইলের সাথে যুক্ত করার বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসন ছাড়া আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন নেই ইসরাইলের প্রতি।

পশ্চিম তীর দখল বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এক বিবৃতিতে এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহন থেকে বিরত থাকার আহবান জানিয়েছে। এর পরিনতি বিপজ্জনক বলে উল্লেখ করেছে। কিন্তু ইসরাইলের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে কিছু বলেনি। এসব দেশ চেষ্টা করছে ক‚টনৈতিকভাবে বিয়য়টি সমাধানের। মিডল ইস্ট ইন্সটিটিউটের সিনিয়র ফেলো খালেদ ইলগিনডি বলেছেন, ইসরাইলের বসতি স¤প্রসারণ পরিকল্পনা জর্ডানের রাজতন্ত্রের জন্য বড় হহুমকি হয়ে দেখা দেবে।

মধ্যপ্রাচ্যের মিশর ও জর্ডানের সাথে রয়েছে ইসরাইলের শান্তি চুক্তি। পশ্চিম তীর আর জর্ডান উপত্যাকা ইসরাইলের দখলের ফলে এ শান্তি চুক্তির কোনো কার্যকারিতা থাকবে না। এর ফলে রুপ নিতে পারে বড় রকমের দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ সংঘাতে। দুই রাষ্ট্র সমাধানের মাধ্যমে ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানের যে উদ্যোগ অনেক দিন ধরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাস্তবায়নের চেষ্ট করছে তাও অচল হয়ে পড়বে।

জর্ডানের বাদশা আব্দুল্লাহ বলেছেন, পশ্চিম তীর ইসরাইলের সাথে যুক্ত করার প্রভাব হবে বুহমুখী। এ অঞ্চলে ফিলিস্তিনিরে মুক্তিকামি সংগঠনগুলোর তৎপরতা বেড়ে যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে ইরানও নিশ্চুপ থাকবে না। যদি ইসরাইল পশ্চিমতীরে বসতি স¤প্রসারণ করে তাহলে, জর্ডানের সাথে বড় আকারের সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে হবে ইসরাইলকে।

প্রতিবেদনটির ভিডিও দেখুন

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে