মালদ্বীপের দ্বীপে চীনের ঘাটি : ভয়ে ভারত

এই দ্বীপ চীনের কাছে লিজ দিয়েছে মালদ্বীপ সরকার - মালদ্বীপস ইনডিপেনডেন্ট ডটকম

  • মেহেদী হাসান
  • ২৪ মে ২০২০, ০০:২১

এবার ভারতের মূল ভূখন্ড থেকে মাত্র ৬শ মাইল দূরে শক্তিশালী সামরিক ঘাটি নির্মাণ করতে যাচ্ছে চীন। চীনের নতুন এ ঘাটি হবে মালদ্বীপে । এ জন্য মালদ্বীপের কাছ থেকে একটি দ্বীপ লিজ নিয়েছে চীন। দ্বীপটির নাম ফিধো ফিনোলহু। ২০১৬ সাল পর্যন্ত এ দ্বীপ চীনের কাছে লিজ দিয়েছে মালদ্বীপ সরকার। লিজ নেয়ার পর চীন ইতোমধ্যে দ্বীপের আয়তন প্রায় তিনগুন বৃদ্ধি করেছে কৃত্রিম উপায়ে। দ্রুত নির্মাণ করছে বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো।

মালদ্বীপের ফিধো দ্বীপে চীনের কার্যক্রম বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিভিন্ন আর্ন্তজাতিক গণমাধ্যম। এসব প্রতিবেদনে বিশ্লেষক নিতুন জে টিকুর উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে চীন এই দ্বীপে যেসব কার্যক্রম চালাচ্ছে তাতে এটি স্পষ্ট যে, চীন সেখানে সামরিক ঘাটি নির্মাণ কার্যক্রম শুরু করছে।

মালদ্বীপের ফিধো দ্বীপে চীনের সামরিক স্থাপনা যদি গড়ে উঠে তাহলে ভারত মহাসাগর কেন্দ্রীক প্রতিযোগিতা নতুন মাত্রা পেতে যাচ্ছে। এটি হলে উত্তরে হিমালয় অঞ্চলের লাদাখ এবং সিকিমের পর এবার দক্ষিনের ভারত মহাসাগরের মালদ্বীপ হতে পারে চীন-ভারত সংঘাতের নতুন কেন্দ্রস্থল।

চীনা একটি প্রতিষ্ঠান ৪০ লাখ মার্কিন ডলারে ২০১৬ সালে ফিধো ফিনোলহু দ্বীপ ৫০ বছরের জন্য লিজ নেয়। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে মালদ্বীপের পর্যটন মন্ত্রী মুসা জামির এ লিজ দেয়ার ঘোষনা দেন। চীনকে এ দ্বীপ লিজ দেয়া বিষয়ে তখন মনে করা হয়েছিলো, চীনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এ উদ্যোগ নিয়েছে বেইজিং। বর্তমানে বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ উঠেছে চীন সেখানে সামরিক ঘাটি নির্মানের চেষ্টা করছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে সর্বশেষ স্যাটেলাইট ইমেজের ছবিতে দেখা গেছে মালদ্বীপের ফিধো ফিনোলহু দ্বীপে ব্যাপক পরিবর্তন করা হয়েছে। ছবিতে দেখা যায় দ্বীপটির আয়তন ৩৮ হাজার বর্গমিটার থেকে বেড়ে ১ লাখ বর্গমিটারে পরিণত হয়েছে। আর এখানে দ্রুত নির্মাণ করা হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা।

চীনের আর্থিক সহায়তায় মালদ্বীপের রাজধানী মালের সাথে আরেকটি দ্বীপ হুলহুলের মধ্যে একটি ব্রিজ নির্মান করা হয়েছে। দ্ইু কিলোমিটারের বেশি দীর্ঘ এই ব্রিজের চীন-মালদ্বীপ ফ্রেন্ডশিপ ব্রিজ হিসাবে পরিচিত। এটি চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের অংশ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ২১০ মিলিয়ন ডলার ব্যায়ে নির্মান করা এই ব্রিজে ১২৬ মিলিয়ন ডলার অনুদান ও ঋন হিসাবে প্রদান করে চীন সরকার।

ভারত মহাসাগর অঞ্চল এবং মালদ্বীপসহ এ অঞ্চলের দেশগুলো কৌশলগত কারনে ভারতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নয়া দিল্লী এ অঞ্চলকে তার প্রভাব বলয়ের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে। কিন্তু এখন ভারতের জন্য একটি বড় ধরনের হুমকি হিসাবে দেখা হচ্ছে মালদ্বীপে চীনা ঘাটি নির্মাণ তৎপরতা।

দক্ষিন চীন সাগরের স্পর্টলি দ্বীপ চীন যেমন পরিবর্তন করে অবকাঠামো নির্মান করেছে এখানেও চীন তেমন কার্যক্রম চালাচ্ছে। এ দ্বীপ নিয়ে চীনের কোনো সামরিক উচ্চাভিলাষ নেই বলে জানিয়েছে চীনা কর্তৃপক্ষ। কিন্তু চীনের এই বক্তব্যর সাথে একমত হতে পারছে না ভারতের সামরিক বিশ্লেষকরা। তারা মনে করছেন যে বাস্তবে চীন এই দ্বীপে সামরিক ঘাটি নির্মাণ করছে।

মালদ্বীপের সর্ব দক্ষিনের দ্বীপমালা হলো আব্দু এটল বা আব্দু দ্বীপমালা। ফিধো ফিনোলহু দ্বীপ আব্দু দ্বীপমালার একটি দ্বীপ। মালদ্বীপের রাজধানী মালে থেকে ৩৩৫ মাইল দক্ষিনে এর অবস্থান। সিধোর অবস্থান মালদ্বীপ বিমান বন্দরের নিকটে । ফিধো দ্বীপে রয়েছে প্রায় ৪ হাজার জনবসতি। দ্বীপের প্রধানের নাম হাসান লতিফ।

লিজ নেয়ার পর চীন  ইতোমধ্যে দ্বীপের আয়তন প্রায় তিনগুন বৃদ্ধি করেছে আভারস ডট এমভি
লিজ নেয়ার পর চীন ইতোমধ্যে দ্বীপের আয়তন প্রায় তিনগুন বৃদ্ধি করেছে -আভারস ডট এমভি

 

ফিধো দ্বীপের পূর্বপুরুষরা পার্শ্ববর্তী গান দ্বীপ থেকে আগত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পর্যন্ত গান দ্বীপের লোকজন স্বচ্ছল স্বাবলম্বী ছিল। ব্রিটিশ রয়াল নেভি ১৯৪১ সালে গান দ্বীপে ঘাটি নির্মান করে। এরপর রয়াল এয়ারফোর্স ১৯৫৬- ৫৭ সালে গান দ্বীপকে ভাড়া দেয় গান রয়াল এয়ারফোর্স স্টেশন নির্মানের জন্য। এসময় গানের অধিবাসীদের জোর করে প্রতিবেশি ফিধো দ্বীপে পাঠানো হয়। আর ফিধোর স্থানীয় অধিবাসীদের তখন পাঠানো হয় পূর্ব দিকে মারাধো এলাকায়। আব্দু দ্বীপমালার দ্বিতীয় বৃহৎ দ্বীপ হলো গান। বর্তমানে গান ও ফিধো দ্বীপসহ আব্দু দ্বীপ মালা মালদ্বীপের অংশ।

বিশ্লেষক নিতুন জে টিকুর মতে ফিধো দ্বীপে চীন যদি ঘাটি নির্মান করে তাহলে ভারতের জন্য এ ঘাটি দুই ধরনের হুমকি সৃষ্টি করছে। প্রথমত ভৌগোলিক নৈকট্যের কারনে এটা ভারতের নিরাপত্তার জন্য সরাসরি হুমকি। ভারত মহাসাগরে ভারতের স্বাধীন নৌ চলাচলের ক্ষেত্রেও হুমকি। এ ঘাটি নির্মিত হলে তা ইউনিয়ন অব টেরিটরির মিনিকয় আইল্যান্ড থেকে মাত্র ৫শ মাইল দূরে থাকবে। আর ভারতের মূল ভ‚খন্ড থেকে এ ঘাটির দূরত্ব হবে মাত্র ৬শ মাইল।

চীন যদি এখানে সত্যিই সামরিক ঘাটি নির্মান মকে তাহলে এ ঘাটিতে পারমানবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন মোতায়েন করার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। এ অঞ্চলে ভারতের সাব-সারফেস অপারেশন সনাক্ত করনের জন্য হাইড্রোলজিক্যাল তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে চীন। স্বাভাবিকভাবে এ ঘাটিতে মোতায়েন থাকবে চীনের বিভিন্ন ধরনের রণতরী যা ভারতের সাথে দ্ব›দ্ব তৈরির ক্ষেত্রে ভ‚মিকা পালন করবে। ভারতের স্বাধীন চলাচলের ক্ষেত্রকে সঙ্কুচিত এবং নিয়ন্ত্রন করতে পারবে চীন।

মালদ্বীপে চীনের সামরিক ঘাটি নির্মানের অর্থ হচ্ছে এ অঞ্চলে কৌশলগত ভারসাম্য চীনের দিকে ঝুকে পড়বে। বর্তমানে এ অঞ্চলে ভারতের কোনো সামরিক ঘাটি নেই। সিসিলিস, মাদাগাসকার এবং মরিশাসে ভারত কেবলমাত্র রাডার পোস্ট বা পর্যবক্ষেন সিস্টেম স্থাপন করেছে।

চীন আগে থেকেই এ অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে যা ভারতের সাথে দ্ব›দ্ব তৈরি করছে। রণতরীর মাধ্যমে চীন আন্দামান এলাকাসহ ভারত মহাসাগর অঞ্চলে নানা ধরনের জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সর্বশেষ ভারত মহাসাগরে চীনের এক ডজনেরও বেশি জলজ ড্রোনের কার্যক্রম সনাক্ত করেছে ভারত । আর এ অঞ্চলে চীনের ৩৫ তম নৌ বহরের উপস্থিতি আগে থেকেই ভারতের জন্য দুশ্চিন্তার কারন হয়ে আছে ।

মালদ্বীপসহ এ অঞ্চলকে ভারত তার প্রভাব বলয়ের অংশ মনে করে। সে কারনে ভারত চেষ্টা করছে এ অঞ্চলের দেশগুলোর সাথে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে। চীনের এ ঘাটি নির্মান কার্যক্রম ভারতকে এ অবস্থানে আর থাকতে দেবে না।

মালদ্বীপে চীনের সামরিক ঘাটি নির্মান পরিকল্পনাকে স্ট্রিং অব পার্লস তত্বের আওতায় ব্যাখ্যা করা যায়। এ তত্ব্রে আওতায় ভারতকে চীন মুক্তার দানার মত এক এক করে বিভিন্ন দিক দিয়ে ঘিরে ফেলতে চায়। এ লক্ষ্যে চীনের মূল ভ‚খন্ড থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত ভারত মহাসাগর অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে সামরিক ও বানিজ্যক বিভিন্ন অবকাঠামো ও সুবিধা তৈরির মাধ্যমে বিশাল নেটওয়ার্ক তৈরি করছে চীন। যা হবে বিশাল চীনা বেষ্টনি । ইতোমধ্যে শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, পাকিস্তান এবং জিবুতিতে চীন তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করেছে।

মায়ানমারের কিয়াউকপিউ বন্দর রয়েছে চীনের নিয়ন্ত্রনে। গুরুত্বপূর্ণ এ বন্দর চীন যেকোনো সংঘাতের সময় শক্তিশালী সামরিক ঘাটি হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে। ভারতের আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের ইউটির নিকট রয়েছে চীনের একটি নৌ গোয়েন্দা শাখা। শ্রীলঙ্কায় হাম্বানটোটা বন্দর ৯৯ বছরের জন্য লিজ নিয়েছে চীনা একটি প্রতিষ্ঠান। ভারতের আশঙ্কা এ বন্দর চীন ব্যবহার করতে পারে সামবেরিন মোতায়েনের জন্য। একই আশঙ্কা রয়েছে পাকিস্তানের গোয়াদর বন্দর নিয়েও। এ তিনটি দেশে চীনা উপস্থিতির সাথে এখন মালদ্বীপে সামরিক ঘাটি নির্মান সম্পন্ন হলে ভারতকে তিন দিক দিয়ে ঘিরে ফেলতে সক্ষম হবে চীন।

মালদ্বীপে ২০১৮ সালের নির্বাচনের ঘটনার পর চীন আবার মালদ্বীপের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের পদক্ষেপ নিয়েছে। ২০১৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মালদ্বীপে পরাজিত হয় চীন সমর্থিত প্রার্থী আব্দুল্লাহ ইয়ামিন। জয়ী হয় ভারত সমর্থিত প্রার্থী ইবরাহীম মোহাম্মদ সালেহ। কিন্তু এরপরও মালদ্বীপে যথেষ্ট চীনা প্রভাব রয়েছে। ২০১৮ সালে মালদ্বীপকে ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋন দেয় চীন । ভারতের গণমাধ্যমে অভিযোগ করা হয়েছে চীন অস্বচ্ছ লিজ প্রক্রিয়ায় মাধ্যমে মালদ্বীপের ১৭টি দ্বীপ নিয়ন্ত্রনে নিয়েছে।

মালদ্বীপ এভাবে ধীরে ধীরে চীনা পক্ষপুটে চলে যাওয়ায় করোনা দুর্যোগের মধ্যেও ভারত ঘোষনা দিয়েছে তাদের নেভি যেকোনো সংঘাত মোকাবেলায় প্রস্তুত। আটকে পড়া ভারতীয়তের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য ভারত ব্যবহার করেছে তাদের ডেস্ট্রয়ার গাইডেড রণতরী। এর মাধ্যমে চীনকে ভারত সু² বার্তা দিয়েছে বলে মনে করেন অনেকে।

ভারত চেষ্টা করছে ভারত মহাসাগরের দ্বীপদেশ মালদ্বীপ, মাদাগাসকার, মরিশাস, কমোরোস, সিসিলিসহ বিভিন্ন ছোট দেশগুলোকে পক্ষে রাখার। একই চেষ্টা করে যাচ্ছে চীন। বেইজিংয়ের সাখে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা দিল্লির জন্য কঠিন হয়ে পড়ছে।

প্রতিবেদনটির ভিডিও দেখুন

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে