সামরিক দিক দিয়ে উত্তর কোরিয়া কতটা শক্তিশালী

লং রেঞ্জের যেসব মিসাইল রয়েছে তা একদিন আমেরিকা আক্রমণ করতে পারবে বলে সামরিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন - সংগ্রহ

  • সাকিব ফারহান
  • ০৯ মে ২০২০, ১৯:২৫

পূর্ব এশিয়ার কমিউনিস্টশাসিত দেশ উত্তর কোরিয়া। পুরো নাম ডেমোক্র্যাটিক পিপলস রিপাবলিক অব কোরিয়া। দীর্ঘ দিন ধরেই হয়তো দেশটি প্রস্তুতি নিয়েছে সামরিক শক্তি বৃদ্ধির। গোপনে সমৃদ্ধ করেছে অস্ত্রের ভান্ডার। ২০১৬ সালের মে মাসে কিম জং উন সর্বোচ্চ নেতার পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পরই শুরু হয়েছে সামরিক শক্তি প্রদর্শনের। তবে এই বছরে এসে যেন রীতিমতো বিস্ফোরণ ঘটেছে এসবের।

প্রায় প্রতি মাসেই নতুন অস্ত্রের পরীক্ষা চালাচ্ছে দেশটি। কোনো কোনো মাসে একাধিকবারও। বেশির ভাগই মাঝারি ও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র। শীর্ষ সারির দেশ না হয়েও যুক্তরাষ্ট্রের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে এভাবে সামরিক শক্তি প্রদর্শন এক সময় ছিল অভাবনীয়। বেশ কয়েকবার দেশটি হুমকি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে হামলার। নিষেধাজ্ঞা, অবরোধ কোনো কিছুকেই পরোয়া করেনি পিয়ংইয়ং। প্রতিবেশী দুই মার্কিন মিত্র জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া তো রীতিমতো তটস্থ উত্তর কোরিয়ার হামলার ভয়ে। এর মধ্যে একবার জাপানের ভূখন্ডের ওপর দিয়েও বিভিন্ন সময় ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে দেশটি।

বিশ্ব থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন একটি দেশ এত সামরিক উন্নতি কিভাবে করেছে সেটি একটি রহস্য। অনেকেই মনে করেন, চীন ও রাশিয়ার প্রত্যক্ষ সহযোগিতা রয়েছে দেশটির প্রতি। গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের ২০২০ সালের র‌্যাংকিংয়ে সামরিক শক্তির দিক থেকে দেশটির অবস্থান বিশ্বে ২৫ নম্বরে। পারমাণবিক এমনটি হাইড্রোজেন বোমাও দেশটির রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।

উত্তর কোরিয়ায় বেশির ভাগই মাঝারি ও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র। ছবিটি ইন্টারনেট থেকে নেওয়া
উত্তর কোরিয়ায় বেশির ভাগই মাঝারি ও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র। ছবিটি ইন্টারনেট থেকে নেওয়া

২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ উত্তর কোরিয়াকে শয়তান চক্রের অংশ বলেছিলেন। বর্তমানে উত্তর কোরিয়া উদীয়মান সামরিক শক্তির একটি দেশ। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো বড় সামরিক শক্তির হুমকি মোকাবেলা করতে হয় একে। আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সামরিক উত্তেজনার চেয়ে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক উত্তেজনা কোনো অংশেই কম নয়। যদিও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ক্ষমতায় আসার পর পরিস্থিতি অনেকটা বদলে গেছে। উত্তর কোরিয়ান নেতা কিম জং উনের সাথে বৈঠক করেন ট্রাম্প। উত্তর কোরিয়া আর দক্ষিন কোরিয়ারন নেতারও বৈঠকে বসেন। তবে কোরীয় উপদ্বীপে উত্তেজনা কমেছে তা নয়। উত্তর কোরিয়ার পেছনে রয়েছে চীনের নীরব সমর্থন। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন উত্তর কোরিয়া হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চীন-রাশিয়ার শক্তি প্রদর্শনের একটি বাহু।

২০১২ সালের হিসাব অনুযায়ী উত্তর কোরিয়ার মোট জনসংখ্যা ২ কোটি ৪৫ লাখ। দেশটির আয়তন এক লাখ ২২ হাজার ৭৬২ বর্গকিলোমিটার। উত্তর কোরিয়ার বেশির ভাগ মানুষের ধর্মীয় কোনো বিশ্বাস নেই। উত্তর কোরিয়ার ওপর এক দশক ধরে অবরোধ আরোপ করে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু তাতে দেশটির সামরিক শক্তি অর্জনের সক্ষমতা কমেনি। সেটি একটি বিস্ময়কর ঘটনা। যদিও মনে করা হয় চীনা সামরিক সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি উত্তর কোরিয়ার শক্তি। রাশিয়ার সামরিক সহযোগিতা পেয়ে থাকি দেশটি। আসুন জেনে নেই উত্তর কোরিয়ার সামরিক কাঠামো সর্ম্পকে কিছু দিক

দ্য কোরিয়ান পিপলস আর্মি (কেপিএ) উত্তর কোরিয়া মিলিটারির অফিসিয়াল নাম। পাঁচটি শাখার সমন্বয়ে গঠিত এই পিপলস আর্মি। নিয়ন্ত্রণ করে দেশটির ন্যাশনাল ডিফেন্স কমিশন। কমিশনের চেয়ারম্যান ও কেপিএ’র সুপ্রিম কমান্ডার দেশটির সর্বোচ্চ নেতা কিম জং- উন। শাখা পাঁচটি হচ্ছে- আর্মি গ্রাউন্ড ফোর্স, নেভি, এয়ারফোর্স, আর্টিলারি গাইডেন্স ব্যুরো ও স্পেশাল অপারেশন ফোর্স। বার্ষিক বাজেট প্রায় ছয় বিলিয়ন মার্কিন ডলার। দেশটির কাছে ২০টি পারমাণবিক বোমা আছে বলে মনে করা হয়।

উত্তর কোরিয়ার সামরিক শক্তি সর্ম্পকে সঠিক তথ্য পাওয়া দুস্কর। উত্তর কোরিয়া বৃহৎ সামরিক শক্তির দেশগুলোর একটি হিসাবে বিবেচনা করা হয়। বিভিন্ন সময় প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে ধারনা করা হয় উত্তর কোরিয়ার সৈন্য সংখ্যা ১১ লাখ ৯০ হাজার। ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র দেশটির সামরিক সক্ষমতার যে প্রতিবেদন প্রকাশ করে তাতে বলা হয় উত্তর কোরিয়ার কাছে, ৪ হাজার ২০০ ট্যাংক। ২ হাজার ২শ আর্মাড ভেহিক্যাল, ৮ হাজার ৬০০ আর্টিলারি গান। জিডিপির ২০ শতাংশ সামরিক খাতে ব্যয় করে। যার পরিমান আনুমানিক ৪০ বিলিয়ন ডলার।

যেকোনো সামরিক পদক্ষেপে কোরিয়ান পিপলস আর্মিকে মিলিটারি অব সাউথ কোরিয়া ও ইউনাইটেড স্টেটস ফোর্সেস কোরিয়ার মুখোমুখি হতে হয়। ১৯৫৩ সালে কোরিয়ান যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকে কোরিয়ান বেসামরিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য অবস্থান করছে। কোরিয়ান ভলান্টিয়ার আর্মি থেকে দ্য কোরিয়ান পিপলস আর্মি প্রতিষ্ঠা করা হয়। গঠন করা হয় ১৯৩৯ সালে।

উত্তর কোরিয়ার সামরিক সক্ষমতার দিক দিয়ে সবচেয়ে বড় হুমকি হিসাবে দেখা হয় দেশটির ব্যালাস্টিক মিসাইল। বিভিন্ন মাত্রার মিসাইল সক্ষমতা দক্ষিন কোরিয়া, জাপান এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হুমকি হিসাবে বিবেচনা করা হয়।

উত্তর কোরিয়ার বিভিন্ন ধরনের আট শতাধিক ব্যালাস্টিক মিসাইল রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এর মধ্যে লং রেঞ্জের যেসব মিসাইল রয়েছে তা একদিন আমেরিকা আক্রমণ করতে পারবে বলে সামরিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। সম্প্রতি করোনা সঙ্কটের মধ্যেও উত্তর কোরিয়া মিসাইল পরীক্ষা চালিয়েছে। তবে দক্ষিন কোরিয়া বরছে এগুলো স্বল্প পাল্লার মিসাইল। উত্তর কোরিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্র যে পারমানবিক নিরস্ত্রীকরন বিষয়ে আলোচনা করছে তাতে পরমানু অস্ত্র ও মিসাইল প্রযুক্তি পরীক্ষা পরিত্যাগের প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু উত্তর কোরিয়ার মিসাইল প্রযুক্তির পরিকল্পনা অনেক পুরানো ধারনা করা হয়। দেশটি গোপনে মিসাইল প্রযুক্তিতে বড় ধরনের সাফল্য অর্জন করেছে। কমিউনিস্ট শাসিত উত্তর কোরিয়া ১৯৬৯ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে মিসাইল ক্ষেপণাস্ত্র পেয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৬ সালে দেশটিতে মিসর হয়ে স্কাড মিসাইল আসে বলে অফিসিয়ালি বলা হয়েছে। এর নাম ছিল স্কাড-বি। এই মিসাইলটির ডিজাইন তৈরি করা হয়েছিল ইসরাইলের বিরুদ্ধে ইয়ুম কাপুর যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য। ১৯৮৪ সালে উত্তর কোরিয়া তার নিজস্ব প্রযুক্তির মাধ্যমে স্কাড-বি মিসাইলের উন্নয়ন করে। নাম দেয়া হয় স্কাড-সি। এ ছাড়া একই সময়ে তৈরি করা হয় নুডং নামে মধ্যম রেঞ্জের মিসাইল। একই প্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করে পরে লং রেঞ্জের মিসাইল তৈরি করা হয়। নাম দেয়া হয় দ্য টায়পোডং। এর দু’টি সংস্করণ। টায়পোডং-১ ও টায়পোডং-২। টায়পোডং-১ আঘাত হানতে পারে দুই হাজার ৯০০ কিলোমিটার দূরত্বে। আর টায়পোডং-২ আঘাত হানতে পারে চার হাজার থেকে ১০ হাজার কিলোমিটার দূরত্বে। এ ধারাবাহিকতায় উত্তর কোরিয়া মিসাইল প্রযুক্তির আরো আধুনিকায়ন হয়েছে। যে সর্ম্পকে প্রকৃত তথ্য জানা অসম্ভব। উত্তর কোরিয়ার এসব ক্ষেপনাস্ত্র দক্ষিন কোরিয়া, জাপান ও গুয়াম দ্বীপে যে কোনো সময় আঘাত হানতে পারে।

উত্তর কোরিয়ার পারমানবিক সক্ষমতার বিষয়টি এখন আর গোপনীয় বিষয় নয়। কারন দেশটি সফল পারমানবিক পরীক্ষা চালিয়েছে। ২০০৯ সালে পারমানবিক অস্ত্র তৈরির সক্ষমতার কথা জানায় উত্তর কোরিয়া। এরপর অবরোধের সম্মুখীন হয়েছে। কিম জং উন বলেছেন পারমানবিক বোমার চাবি তার হাতে। এটা কোনো অলীক কল্পনা নয়। পারমানবিক নিরস্ত্রীকরেন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আলোচনা হলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি। পারমানবিক প্রকল্প থেকে সরে আসার ব্যাপারে উত্তর কোরিয়া সরে আসবে এখনও এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। আসুন আমরা জেনে নেই উত্তর কোরিয়ার নৌ ও বিমান বাহিনী সর্ম্পকে কিছু তথ্য

উত্তর কোরিয়ার নৌশক্তি সর্ম্পকে রহস্য রয়েছে। দেশটির রয়েছে ৬০ হাজারের মতো নৌ সেনা। উত্তর কোরিয়ার নৌবাহিনী মুল শক্তি হচ্ছে সাবমেরিন কেন্দ্রিক। ৭০টির মতো সাবমেরিন রয়েছে। এরমধ্যে ১০টি মিটগেট সাবমেরিন। ৮০০ টির মতো বিভিন্ন ধরনের নৌযুদ্ধ যান রয়েছে।

উত্তর কোরিয়ার নৌবাহিনীর চেয়ে বিমান বাহিনীতে জনবল বেশি। বিমান বাহিনীর জনবল প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার। উত্তর কোরিয়ার কাছে বিভিন্ন ধরনের ৯৪০টি যুদ্ধ বিমান রয়েছে যার অধিকাংশ সোভিয়েত আমলের ও চীনের নির্মিত। উত্তর কোরিয়া প্রতিনিয়ত সামরিক সক্ষমতা বাড়াচ্ছে। বিমান বাহিনীতে কতটা পরিবর্তন আনা হয়েছে সে সর্ম্পকে সঠিক চিত্র পাওয়া যায় না। তবে চীন ও রাশিয়া থেকে যে কোনো ধরনের যুদ্ধ বিমান কেনার কৌশল নিতে পারে উত্তর কোরিয়া।

এই প্রতিবেদনের ভিডিও দেখতে নীচে ক্লিক করুন