আমেরিকার সাথে প্রতিযোগিতায় চীনের সেনাবাহিনীর নানা কৌশল

চায়না মিলিটারি অনলাইনে প্রকাশিত পিএলএ’র নিউ জেনারেশন নিয়ে তৈরি করা একটি কার্টুন সিরিজ থেকে নেওয়া - চায়না মিলিটারি অনলাইন

  • মেহেদী হাসান
  • ০৮ মে ২০২০, ১৭:১৮

গত কয়েক দশকে চীনা পিপলস লিবারেশন আর্মি বা পিএলএ ব্যাপক শক্তি অর্জন করেছে । চীনের অর্থনৈতিক উত্থানের সাথে সাথে আলোচনায় যুক্ত হয়েছে চীনা আর্মি বা পিএলএ’র নাম। সামরিক ও অর্থনৈতিক উত্থানের কারণে চীন এখন বিশ্বে শক্তি প্রদর্শনের ভূমিকায় অবর্তীণ হতে যাচ্ছে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করনে । আবার অনেকের মতে ইসলামের পর পশ্চিমা বিশ্বের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ ও নতুন শত্রু হচ্ছে চীন। রাশিয়ার সাথে ঠান্ডা লড়াই অবসানের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের নতুন ঠান্ডা লড়াই দৃশ্যমান হচ্ছে। এমন বাস্তবতায় চীন কিভাবে তার সামরিক সংস্কার ও কৌশল নির্ধারণ করছে তা নিয়ে আজ আমরা আলোচনা করবো।

চীনা প্রাচীন সমর কৌশলবিদ সান জু’র একটি বিখ্যাত উক্তি হলো, তুমি যখন শক্তিশালী থাক তখন দুর্বল অবস্থা প্রকাশ করো আর যখন দুর্বল অবস্থায় থাকবে তখন নিজেকে শক্তিশালী হিসেবে দেখাবে। বর্তমানে চীনা পিপলস লিবারেশন আর্মি বা পিএলএ এর কোন কৌশল অনসুরণ করছে তা অনেকের কাছে পরিষ্কার নয়।

এর সঠিক উত্তর পাওয়ার ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের ভবিষ্যতেন অনেক কিছ‚ নির্ভর করছে। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র এখন বেশ সমস্যায় রয়েছে। পিএলএ’র শক্তি খাটো করে দেখা হলে সে ক্ষেত্রে মাকিন যুক্তরাষ্ট্রকে অনেক মূল্য দিতে হতে পারে। আবার চীনা আর্মিকে বড় করে দেখলে নিতে হয় অনেক পদক্ষেপ। যা হতে পারে অযৌক্তিক এবং অনেক ব্যয়বহুল।

একইভাবে সমরশক্তি বিষয়ে ভুল ধারণা চীনা নেতৃত্বের জন্যও বিপজ্জনক হতে পারে। সে হিসেবে চীনা সামরিক বাহিনীর যে কোনো গুরুতর মূল্যায়ন করতে হলে এর অগ্রগতি এবং সমস্যা দুটিকেই সামনে রাখতে হবে।

তবে সব বিবেচনায় চীনা আর্মি গত কয়েক দশকে ব্যাপক শক্তি অর্জন করেছে। গত বছর পিপলস রিপাবলিক অব চায়নার ৭০ বছর প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে জৌলসপূর্ণ প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয় । এতে চীনা আর্মির ৭ শতাধিক আধুনিক সমরাস্ত্র প্রদর্শন করা হয়। এতে প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে আনা হয় ডিএফ-৪১। পরমানু বোমা বহনকারী চীনের সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যালিস্টিক মিসাইল হলো ডিএফ-৪১। যুক্তরাষ্ট্রের যে কোনো স্থানে আঘাত পরিচালনা করতে সক্ষম ভয়ানক এ মিসাইল।

প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের নেতৃত্বে চীনা আর্মি পা বাড়িয়েছে দক্ষিণ চীন সাগরে। সামরিক বিশ্লেষকদের মতে করোনা ভাইরাসে বিশ্ব যখন বিপর্যস্ত চীন তখন এ অঞ্চলে তার অবস্থান আরো কয়েক ধাপ বাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। এর ফলে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে প্রতিবেশি দেশগুলোর মধ্যে। যুক্তরাষ্ট্র এবং অস্ট্রেলিয়া দক্ষিণ চীন সাগরে নতুন করে রণতরী মোতায়েন করায় উত্তেজনার পারদ আরো কয়েক ধাপ উপরে উঠেছে। এমনকি আশঙ্কা দেখা দিয়েছে চীন এ সুযোগে দখল করে নিতে পারে তাইওয়ান। হামলা চালাতে পারি মার্কিন সামরিক ঘাটি গুয়াম দ্বীপে।

গত কয়েক বছর ধরে চীন তাইওয়ান এবং জাপানের কাছে বিতর্কিত সমুদ্র সীমায় মহড়া পরিচালনা করেছে চীনের নৌবাহিনী। শানডং নামে দ্বিতীয় বিমানবাহি রণতরী নৌ বাহিনীতে যুক্ত হয়েছে গত ডিসেম্বরে।


চীনা আর্মি বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সদর দপ্তর পেন্টাগনের সর্বশেষ বার্ষিক মূল্যায়ন প্রতিবেদনে স্বীকার করা হয়েছে, চীনা আর্মি ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলে বড় আকারে হস্তক্ষেপের জন্য তৃতীয় পক্ষ যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পরাস্ত করার শক্তি অর্জন করছে। পেন্টাগনের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে প্যাসিফিক অঞ্চলের বাইরেও ধীরে ধীরে চীন শক্তি প্রদর্শনের ক্ষমতা অর্জন করছে।

মার্কিন কংগ্রেসের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে চীনা আর্মি সম্পর্কে আরো উদ্বেগজনক তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয় চীনের লক্ষ্য হলো যুক্তরাষ্ট্রের আর্মির সুবিধাজনক জটিল সিস্টেমগুলিকে ব্যহত, অক্ষম বা ধ্বংস করে দেয়া। কংগ্রেসের এ প্রতিবেদনে দেশটির নিরাপত্তার জন্য যুদ্ধের নতুন পন্থা উদ্ভাবনের আহবান জানানো হয়েছে। চীনের এ উত্থান ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও প্রতিবেশি দেশগুলোর জন্য বড় ধরনের হুমকি সৃষ্টি করেছে।

তবে চীনা আর্মির অনেক দুর্বলতা রয়েছে । সেগুলো প্রায়ই চীনা ভাষার গণমাধ্যমে তারা খোলাখুলি প্রকাশ করে। কিন্তু বিদেশীরা জানতে পারে এমন ভাষার গণমাধ্যমে এসব দুর্বলতা স্বীকার করে না তারা। কী ধরনের দুর্বলতা রয়েছে চীনের সেনাবাহিনীর আসুন জেনে নেই সে সর্ম্পকে কিছু দিক

চীনা আর্মির একটি বড় দুর্বলতা হলো আধুনিক যুদ্ধের জন্য চীনা আর্মি যথেষ্ট দক্ষ নয়। আর বর্তমান আর্মি কমান্ডাররাও সর্বোচ্চ দক্ষ নয়। তারা এটার নাম দিয়েছে ‘টু ইনএবিলিটিস’। অপর যে দুর্বলতার কথা চীন প্রকাশ্যে স্বীকার করে সেটা হলো- পিস ডিজিস, পিস টাইম হ্যাবিটস এবং লং স্ট্যান্ডিং পিস প্রবলেমস।
চীনা আর্মির সাম্প্রতিক বড় ধরনের কোনো যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নেই। চীন সর্বশেষ বড় ধরনের যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলো ৩৫ বছর আগে ১৯৮০ এর দশকের মাঝামাঝি । বর্তমান চীনা আর্মির যুদ্ধের কোনো অভিজ্ঞতা নেই।

এ দুর্বলতা সামনে রেখেই ২০১৫ সালে প্রেসিডেন্ট শি সুদুরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়ে চীনা আর্মির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সংস্কার কর্মসূচী গ্রহণ করেন। এর চূড়ান্ত লক্ষ্য চীনের আর্মিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমপর্যায়ে আনা। এ জন্য দুর্নীতিগ্রস্ত, অবনমিত আর সৈন্য সংখ্যা নির্ভর আর্মিকে তিনি আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য নির্ধারণ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর প্রযুক্তিকে মোকাবেলা করে যে কোনো যুদ্ধে জয়ী হওয়া এ সংস্কারে লক্ষ্য। তবে এ লক্ষ্যে পৌছা অত্যন্ত কঠিন। সে কারনে চীনা রাজনৈতিক এবং সামরিক নেতৃত্ব কয়েক দশকব্যাপী দীর্ঘ মেয়াদী লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।

প্রথম দফায় ২০২০ সালের মধ্যে যান্ত্রিকীকরণ অর্জন করা তাদের লক্ষ্য। আর ২০৩৫ সালের মধ্যে ব্যাপক কৌশলগত দক্ষতা অর্জন করা। এ সময়ের মধ্যে সমস্ত আধুনিকায়ন কর্মসূচী সম্পন্ন হবে। আর ২০৫০ সালের মধ্যে চীনা আর্মি হবে একটি ওয়ার্ল্ড ক্লাস মিলিটারি যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে টেক্কা দিতে সক্ষম।

যৌথ অপারেশন, প্রশিক্ষণ, নেতৃত্ব শক্তিশালী করণ এবং সর্বস্তরে সমন্বিত যোগাযোগ স্থাপনের কাজ চলছে। চীনা আমির্র আধুনিকায়নের জন্য দরকার উন্নত প্রযুক্তি, মানব সম্পদ উন্নয়ন, নতুন যুদ্ধ কৌশল ধারনা, সাংগঠনিক রুপান্তর। নতুন অস্ত্রের চেয়ে এ ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নতুন সফটয়্যার । সংস্কারের ক্ষেত্রে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে চবে চীনকে। পিএলএ’র ব্যাপক সংস্কার কর্মসূচী গ্রহনের মানে হলো, চীনা নেতৃত্ব মনে করছেন, বড় ধরনের কোনো শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভের উপযুক্ত হয়নি চীনা আর্মি।

দুর্বলতা যতই থাকুক চীনা আর্মিকে কাগুজে বাঘ বলে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। কার্টুনটি করেছেন গিডিওন র‌্যাচম্যান
দুর্বলতা যতই থাকুক চীনা আর্মিকে কাগুজে বাঘ বলে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। কার্টুনটি করেছেন গিডিওন র‌্যাচম্যান

 

তবে দুর্বলতা যতই থাকুক চীনা আর্মিকে কাগুজে বাঘ বলে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। ২০১৭ সালে চীনা আর্মির যুক্তরাষ্ট্রের ইকুইফ্যাক্স হ্যাকিংয়ের ঘটনা সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে প্রযুক্তি ক্ষেত্রে তাদের দাপটের বিষয়। মার্কিন ইকুইফ্যাক্স হ্যাকিং, ট্রেড সিক্রেটস এবং সাড়ে ১৪ কোটি আমেরিকানদের তথ্য চুরির অভিযোগে গত ফেব্রুয়ারি মাসে চীনা আর্মির চার কর্মকর্তাকে অভিযুক্ত করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ইকুইফ্যাক্স হলো আমেরিকার অন্যতম বড় একটি ক্রেডিট রিপোটিং এজেন্সি। হ্যাকাররা প্রায় অর্ধেক আমেরিকানদের নাম, জন্ম তারিখ এবং সোশাল সিকিউরিটি নাম্বার চুরি করতে সক্ষম হয়। এসব তথ্যের মাধ্যমে এসব ব্যক্তিদের মেডিকেল হিস্টরি এবং ব্যাংক একাউন্টও বের করা সম্ভব।

২০১৭ সালের চীনা এ সাইবার অ্যাটাকের পর এটা প্রমান হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বড় অতি গোপনীয় প্রতিষ্ঠানের তথ্যও চীনের আক্রমন থেকে নিরাপদ নয়। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক প্রতিষ্ঠান এখন ইকুইফ্যাক্সের মত হ্যাকিংয়ের ভয়ে রয়েছে।

চীনা চার আর্মি সদস্যকে অভিযুক্ত ঘোষণার সময় মার্কিন এটর্নি জেনারেল উইলিয়াম পি. বার বলেন, চীনা আর্মি এবং চীনা গোয়েন্দা সংস্থার ধারাবাহিক আমেরিকান তথ্য চুরির সর্বশেষ ঘটনা হলো ইকুইফ্যাক্স হ্যাকিংয়ের ঘটনা। তিনি বলেন আমেরিকান গোয়েন্দা এবং অন্যান্য কর্মকর্তাদের টার্গেট করার দক্ষতা অর্জন করেছে চীন।

কোনো কোনো বিশ্লেষকের মতে চীন বর্তমানে সান জুর পরামের্শর দ্বিতীয়টি মেনে চলছে। অর্থাৎ যখন দুর্বল থাকবে তখন নিজেকে শক্তিশালী হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা। বর্তমানে চীনের বিভিন্ন তৎপরতার মধ্যে চীন এ নীতি প্রয়োগের দিকটি ফুটে উঠেছে। তবে চীনের এই দূর্বলতা যে বেশি দিন থাকবে না তা নিশ্চিত করে বলা যায়।

চীনা প্রাচীন সমরবিদ সান জু’র আরেকটি উক্তি হলো তুমি যদি শত্রু সম্পর্কে এবং নিজেদের সম্পর্কে জানতে পার তাহলে একশ যুদ্ধের ফলাফল নিয়ে তোমাকে আর ভাবতে হবে না। আর যদি তুমি তোমার শত্রু ও নিজেদের সম্পর্কে জানা না থাকে তাহলে প্রত্যেক যুদ্ধে তোমার পরাজয় অনিবার্য।

চীনা নেতৃত্ব চীনা আর্মির অভ্যন্তরীন সমস্যা চিহ্নিত করে কতটা দূর করতে পারছে তার ওপর নির্ভর করছে তাদের সুদূরপ্রসারী সংস্কার কর্মসূচীর সফলতা।

এই প্রতিবেদনের ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন