চীন - রাশিয়া থেকে অত্যাধুনিক মিসাইল ও যুদ্ধ বিমান কিনছে মিয়ানমার

ছবি - সংগৃহীত -

  • মেহেদী হাসান
  • ২৫ এপ্রিল ২০২০, ১৩:২২

মিয়ানমার চীন থেকে সংগ্রহ করছে ব্যালিস্টিক মিসাইল। স্বল্প পাল্লার এ ব্যালিস্টিক মিসাইলের নাম এসওয়াই-৪০০ মিসাইল সিস্টেম। বহুমুখী ক্ষমতা সম্পন্ন এ মিসাইল বহন করতে পারে বিভিন্ন ধরনের ভারী আর শক্তিশালী বোমা। গাইডেড এ মিসাইলের লক্ষ্যমাত্রা ৪০০ কিলোমিটার হলেও এর আওতা বাড়ানো এবং কমানো যায়। মিসাইলের প্রথম ব্যাচ আগামী কয়েক মাসের মধ্যে মিয়ানমার সংগ্রহ করতে যাচ্ছে মর্মে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে । দীর্ঘ কয়েক বছর আলোচনার পর মিয়ানমার চীনের কাছ থেকে পেতে যাচ্ছে এ মিসাইল।

মিয়ানমারের এ মিসাইল নিশ্চিতভাবে বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের হুমকি। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে মায়ানমার এগুলো ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করবে না। তার দেশের বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধেও ব্যবহার করবে না। একমাত্র বাংলাদেশকে লক্ষ্য করেই মিয়ানমার এসব মিসাইল সংগ্রহ করতে যাচ্ছে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন বাংলাদেশ ছাড়া থাইল্যান্ডও এ মিসাইলের লক্ষ্য।

মিয়ানমার এর আগে রাশিয়ার কাছ থেকে শক্তিশালী ৬টি এসইউ-৩০ যুদ্ধ বিমান ক্রয় চুক্তি এবং চীনের কাছ থেকে জে-১৭বি যুদ্ধ বিমান সংগ্রহ করে। এর ধারাবাহিকতায় দেশটি বর্তমানে অধিকারী হতে যাচ্ছে শক্তিশালী ব্যালিস্টিক মিসাইলের। আর মিয়ানমারের কাছে বিভিন্ন দেশের এসব অস্ত্র কেনা বেচা চলছে জাতিসংঘের আহবান এবং কনভেনশন লঙ্ঘন করে।

রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিপীড়নের কারনে পশ্চিমা অনেক দেশেরও নিষেধাজ্ঞা এবং আপত্তি রয়েছে মিয়ানমারের কাছে সমরাস্ত্র বিক্রির বিষয়ে। কিন্তু এসব উপেক্ষা করে বিভিন্ন দেশ মিয়ানমারের কাছে অস্ত্র বিক্রি অব্যাহত রয়েছে। এসওয়াই-৪০০ মিসাইল সিস্টেম পরিচালনার জন্য মিয়ানমারে কাছে প্রযুক্তি হস্তান্তর করবে চীন। এ এছাড়া এসব মিসাইল সিস্টেম কেনার জন্য চীন থেকে ঋনও পাবে মিয়ানমার।
এসওয়াই-৪০০ মিসাইল ব্যালিস্টিক মিসাইল সিস্টেম মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে নতুনভাবে শক্তিশালী করবে। অনেক দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার সক্ষমতা বৃদ্ধি করবে। এসওয়াই -৪০০ একটি নিউ জেনারেশন ব্যালিস্টিক মিসাইল সিস্টেম। চায়না অ্যারোস্পেস সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি করপোরেশন এটি তৈরি করেছে।

চীনা সামরিক বিশ্লেষক জিয়াও ফেজহু বলেন, এসওয়াই- ৪০০ মিসাইল সিস্টেমের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো ভার্টিক্যাল লঞ্চ সিস্টেম যা বিশ্বের প্রথম লকেট লঞ্চার সিস্টেম। এ পদ্ধতির কারনে যে কোনো সময় সব দিকে হামলা পরিচালনা করা যায়। এজন্য নতুন কোনো পদ্ধতি ইনস্টল করতে হয় না। সর্বোচ্চ ৩০০ কেজি ওজনের বোমা এটি ১৫০ কিলোমিটার দূরে নিক্ষেপ করতে পারে। বোমা যত কম ওজনের হবে লক্ষ্যমাত্রা তত বেশি। লক্ষ্য বস্তুতে আঘাত হানার ক্ষমতাও অতি নিখুত।

টেকটিক্যাল মিসাইল সিস্টেম হওয়ার কারনে এটি বিভিন্ন ধরনের মিসাইল ও রকেট নিক্ষেপ করতে পারে। এসওয়াই-৪০০ মিসাইল সিস্টেম বিপি১২এ স্বল্প পাল্লার টেকটিক্যাল ব্যালিস্টিক মিসাইল সংযোজন করতে পারে। ফলে মায়ানমার কম খরচে ব্যালিস্টিক মিসাইল আক্রমনের সক্ষমতা অর্জন করবে এর সাহায্যে।
দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে এডভান্সড এয়ার ডিফেন্স এবং এন্টি মিসাইল সিস্টেম নেই। ফলে এসওয়াই-৪০০ এবং বিপি১২এ মিসাইল আক্রমন প্রতিহত করার সক্ষমতাও নেই এ দেশগুলোর। অপর দিকে এসওয়াই-৪০০ মিসাইলের রয়েছে শক্তিশালী প্রতিরোধ ক্ষমতা। এসব কারনে এ মিসাইল সিস্টেম মায়ানমার সেনাবাহিনীকে দক্ষিন পূর্ব এশিয়ায় বিপজ্জনক শক্তির অধিকারী করতে যাচ্ছে।
২০১৮ সালের নভেম্বরে এয়ারশো চায়নায় এসব স্বল্প পাল্লার এসওয়াই-৪০০ ব্যালিস্টিক ক্ষেপনাস্ত্র প্রদর্শন করা হয়। এ মিসাইলের আরেক নাম ডিএফ-১২এ। এর স্টান্ডার্ড কনফিগারেশনে আটটি কনটেইনারে সলিড-ফুয়েল মিসাইল থাকে। কারখানাতেই এসব কনটেইনারে মিসাইল স্থাপন করে দেয়া হয় এবং কোনরকম রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়া অনেক বছর এগুলো সংরক্ষণ করা যায়।

এসওয়াই-৪০০ ক্ষেপনাস্ত্র জিপিএস বা আইএনএস গাইডেন্স সিস্টেম সজ্জিত। চারটি কন্ট্রোল সারফেস ও স্টাবিলাইজিং ডানার সাহায্যে এটি লক্ষ্যবস্তুর দিকে উড়ে চলে। একই সাথে বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে একাধিক ক্ষেপনাস্ত্র নিক্ষেপ করা যায় এসওয়াই-৪০০ মিসাইল সিস্টেমের সাহায্যে।
মিসাইল লঞ্চার ইউনিটগুলো ১৬ চাকার দ্রুত গতি সম্পন্ন ওয়ানশান মিলিটারি ট্রাক চেসিসের উপর বসানো। ট্রাককগুলো চলে ৫১৭ হর্স পাওয়ারের দিউজ ডিজেল ইঞ্জিনে। সড়ক পথে এর সর্বোচ্চ গতি ঘন্টায় ৭৫ কিলোমিটার। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে কাতারের সশস্ত্র বাহিনী চীনের কাছ থেকে এসওয়াই-৪০০ ক্ষেপনাস্ত্র সংগ্রহ করে। একই বছর কাতার ন্যাশনাল ডে প্যারেডে এই ক্ষেপনাস্ত্র ব্যবস্থা প্রদর্শিত হয়। চীনের বাইরে মিয়ানমার হবে এ মিসাইলের দ্বিতীয় অধিকারী দেশ।
মিয়ানমার যখন চীনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে সমরাস্ত্র কিনছে জাতিসংঘের তথ্য অনুুসন্ধানী মিশনের এক প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে কিভাবে রোহিঙ্গাদের উপর নৃশংস দমন অভিযান পরিচালনার জন্য মিয়ানমার সেনাবাহিনী তার ব্যবসা, বিদেশী কোম্পানি ও অস্ত্র চুক্তিকে ব্যবহার করেছে।
রোহিঙ্গাদের ওপর ওই নিধন অভিযানের কারনে সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। জাতিসংঘ তথ্য অনুসন্ধানী মিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ‘জাতিগত নির্মূল’ অভিযান শুরুর পরের সপ্তাহগুলোতে মায়ানমার সেনাবাহিনীকে ৪৫টির মতো কোম্পানি ও সংস্থা ১০ মিলিয়ন ডলারের বেশি চাঁদা দিয়েছে।

এতে আরো বলা হয়েছে শীর্ষস্থানীয় দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কেবিজেড গ্রুপস ও ম্যাক্স মায়ানমার বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্তে বেড়া নির্মাণে আর্থিক সহায়তা দিয়েছে।মায়ানমার আর্মি নিয়ন্ত্রিত দুটি প্রতিষ্ঠানের অন্তত ১২০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রায় ৬০টি বিদেশী কোম্পানির লেনদেন রয়েছে।
জাতিসংঘ দল মায়ানমারে সমরাস্ত্র বিক্রির উপর পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা আরোপেরও আহ্বান জানিয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়, দেশটির সংখ্যালঘু গ্রুুপগুলো যখন মানবিক সঙ্কটে নিপতিত তখনও সাতটি দেশের বেশ কিছু কোম্পানি মায়ানমার সেনাবাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রাখে।

২০১৬ সাল থেকে চীন, উত্তর কোরিয়া, ভারত, ইসরাইল, ফিলিপাইন, রাশিয়া ও ইউক্রেনের ১৪টি কোম্পানি মায়ানমারকে জঙ্গিবিমান, আর্মড ফাইটিং ভেহিকেল, যুদ্ধজাহাজ, ক্ষেপনাস্ত্র ও ক্ষেপনাস্ত্র উৎক্ষেপক সরবরাহ করছে।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই অস্ত্র বিক্রি ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটসের পরিপন্থী। এর রাষ্ট্রীয় পক্ষ হলো উত্তর কোরিয়া, ইসরাইল, রাশিয়া ও ইউক্রেন এবং চীন হলো এর স্বাক্ষরকারী দেশ।এসব দেশ কার্যকরভাবে মানবাধিকার বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী রোহিঙ্গারা হলো বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত জনগোষ্ঠী।
ডিফেন্স নিউজের ২০১৮ সালের ২৩ জানুয়ারির খবরে বলা হয় মায়ানমার রাশিয়ার কাছ থেকে ৬টি এসইউ-৩০ ভারী যুদ্ধ বিমান সংগ্রহ করছে। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে ডেপুটি প্রতিরক্ষা মন্ত্রী লেফটেন্যান্ট জেনারেল আলেকজান্ডার ফোমিন ঘোষণা দিয়েছেন মায়ানমার ৬টি এসইউ-৩০ যুদ্ধ বিমান পাবে।
এসইউ-৩০ হবে মিয়ানমার বিমানবাহিনীর মূল যুদ্ধ বিমান। এ ছাড়া মায়ানমার আর্মি আরো বিভিন্ন ধরনের মিলিটারি হার্ডয়্যার সংগ্রহ করবে রাশিয়ার কাছ থেকে। ইরাবাতীর খবরে বলা হয় ২০১৯ সালে মিয়ানমার সেনা প্রধান জেনারেল মিন অং মস্কো সফরের সময় এসব বিমান প্রস্তুত কারাখানা পরির্দশন করেন।
অপর দিকে ২০১৯ সালে মিয়ানমার সংগ্রহ করে এক ডজনের ওপর জে-১৭বি জঙ্গী বিমান। রোহিঙ্গা ইস্যুতে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ ও মায়ানমারের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার আর্মি ও স্থানীয় সহযোগী নিপীড়নের কারনে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে আসে বাংলাদেশে।
একসময় সামরিকসহ বিভিন্ন দিক দিয়ে বাংলাদেশের তুলনায় মায়ানমার ছিল অনেক দুর্বল একটি দেশ। কিন্তু সেই দুর্বল প্রতিবেশি মায়ানামার আজ বিভিন্ন কারনে বাংলাদেশের জন্য বড় রকমের দুর্ভাবনা আর বিপদের কারন হয়ে দাড়িয়েছে। প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশের নিরঙ্কুশ সমর্থনের কারনে দিনে দিনে বেপরোয়া আর আগ্রাসী হয়ে ওঠা মায়ানমার এখন বাংলাদেশের জন্য বড় মাত্রার হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশকে প্রতিবেশী কোনো দেশের সাথে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে সমরসজ্জা বা সমরাস্ত্র গড়ে তোলার প্রয়োজন হয়নি বলা চলে। কিন্তু মিয়ানমারের কারনে বাংলাদেশের জন্য সে সুযোগ সম্ভবত আর বেশি দিন থাকছে না।