করোনা দুর্যোগের মধ্যে আমেরিকানরা এত বন্দুক কিনছে কেন

যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা- সংগৃহীত

  • মেহেদী হাসান
  • ১৭ এপ্রিল ২০২০, ১১:৫৩

করোনা দুর্যোগে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশের সমাজে চলছে অস্থিরতা। বিশ্বের এক নম্বর সুপার পাওয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে করোনা হানা দেয়ার পর বন্দুকসহ বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র কেনার হিড়িক পড়েছে । গত কয়েক সপ্তাহে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রেকর্ড পরিমান আগ্নেয়াস্ত্র বিক্রি হয়েছে। এর কারন আমেরিকনারা মনে করছে করোনার কারনে সমাজে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙ্গে পড়বে। দেখা দেবে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা। সমাজে ছড়িয়ে পড়বে সংঘাত। ফলে আমেরিকানরা তাদের নিজ ও পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। কেন তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।

করোনার কারনে অনেক আমেরিকান যেমন খাদ্যের দোকানে ছুটেছে। তেমনি ছুটছে বন্দুকের দোকানে জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। গত কয়েক সপ্তাহে যারা আগ্নেয়াস্ত্র কিনেছে তাদের অধিকাংশ প্রথমবারের মত এসব অস্ত্র সংগ্রহ করেছে। এফবিআই মার্চ মাসে ৩৭ লাখ ব্যক্তিগত বন্দুক কেনার বিষয় পরীক্ষা করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একজন নাগরিক একাধিক বন্দুক কিনতে পারে। বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের কাছে সবচেযে বেশি বন্দুক রয়েছে। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের কাছে ৩০ কোটি ৯০ লাখ বন্দুকসহ বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যা হলো ৩২ কোটি ৮২ লাখ। সে হিসেবে প্রায় প্রত্যেক আমেরিকানদের কাছে একটি করে আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। নিরাপত্তার কারনে বিশ্বে যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরদের কাছে সবচেয়ে বেশি আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে তেমনি ম্যাস শুটিংয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি আমেরিকান নিহত হচ্ছে।

এ ধরনের ঘটনা ঘটার পর যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন মহল থেকে দাবি তোলা হয় ব্যক্তিগত অস্ত্র রাখার বিষয়ে কড়াকড়ি আরোপের জন্য। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে ব্যক্তিগত অস্ত্র রাখার হার ক্রমে বেড়ে চলেছে। বিশেষ করে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর তীব্র আতঙ্ক পেয়ে বসেছে আমেরিকনারদের । সমাজে বড় ধরনের বিশঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থেকে সবাই ব্যক্তিগত এবং পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে ভীষন চিন্তিত হয়ে পড়েছে।

আমেরিকায় যখন স্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করে তখনও ম্যাস শুটিংয়ে প্রায়ই ব্যাপকসংখ্যক মানুষ হত্যার ঘটনা ঘটে। তার প্রেক্ষিতে করোনা ভাইরাসের কারনে সৃষ্ট অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে মানুষ যখন প্রচন্ডভাবে হতাশ ও আতঙ্কগ্রস্ত তখন ম্যাস শুটিং আর আত্মহনন পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাড়াতে পারে তা ভেবে অনেকে উদ্বিগ্ন।

সরকারী তথ্য অনুযায়ী প্রতি বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১১ হাজার মানুষ হত্যার ঘটনা ঘটে এসব ব্যক্তিগত আগ্নেয়াস্ত্রের মাধ্যমে। আর ব্যক্তিগত বন্দুকের মাধ্যমে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে এর প্রায় দ্বিগুন। সব মিলিয়ে আগ্নেয়াস্ত্রজনিত সহিংসতার কারনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বছরে ৩০ হাজার মানুষ মারা যায়।

এ প্রতিবেদন তৈরি পর্যন্ত করোনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মারা গেছে ১১ হাজারের বেশি । আর আক্রান্ত হয়েছে সাড়ে তিন লাখের বেশি। হোয়াইট হাউজ থেকে বলা হয়েছে সমস্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা সত্ত্বেও করোনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১ লাখ থেকে ২ লাখ ৪০ হাজার মানুষ মারা যেতে পারে। আর পরিস্থিতি যদি নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায় তাহলে লাখ লাখ মানুষ মারা যেতে পারে। সরাসরি মার্কিন প্রেসিডেন্টের ব্রিফিং থেকে যখন এ ধরনের ভয়াবহ আশঙ্কার কথা প্রকাশ করা হয় তখন সে দেশের সাধারণ মানুষের ওপর এর প্রভাব কত গভীর হতে পারে তা খুব সহজে অনুমান করা যায়।

মার্কিন চিকিৎসা ব্যবস্থার যে চিত্র বর্তমানে করোনার কারনে প্রকাশ হয়ে পড়েছে তাতে আরো আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে আমেরিকানরা। করোনায় আক্রান্ত হলেও অনেকের পক্ষে চিকিৎসা গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। কারন হাসপাতালে বর্তমানে বেড সঙ্কটের কারনে একান্ত মুমূর্ষু রোগী ছাড়া ভর্তি করার কোনো সুযোগ নেই। আর হাসপাতালে ভর্তি হতে পারলেও উপযুক্ত সেবা পাওয়ারও কোনো নিশ্চয়তা নেই । হাসপাতালে রয়েছে করোনা চিকিৎসা সামগ্রীর তীব্র সঙ্কট।

মার্কিন চিকিৎসা ব্যবস্থার এ বিপর্যয়কর চিত্র এখন সর্বত্র আলোচিত বিষয়। ফলে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে হতাশা আর তীব্র ক্ষোভ। সরকারের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছে অনেক আমেরিকান। সবাই এখন ব্যস্ত যার যার চিন্তায়। জীবন বাঁচাতে হলে যা করার নিজেদেরই করতে হবে। পরিস্থিতির অবনতি হলে সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে পারে নৈরাজ্য। নিরাপত্তাহীনতাসহ বিভিন্ন ধরনের অগণিত দুশ্চিন্তা ঘিরে ধরেছে মার্কিনীদের। এসব দুশ্চিন্তা থেকে প্রথম যে পদক্ষেপ তারা নেয়ার চেষ্টা করছে তা হলো খাদ্য নিরাপত্তা আর জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

হোয়াইট হাউজের আশঙ্কা অনুযায়ী করোনা পরিস্থিতির যদি আরো অবণতি ঘটে তাহলে আমেরিকানদের কাছে থাকা ৩০ কোটি ৯০ লাখ আগ্নেয়াস্ত্রের ভূমিকা কী হবে তা নিয়ে অনেকে চিন্তিত। গত মাসে ট্রাম্প বলেছেন, ব্যবসা বানিজ্য যত বেশি দিন বন্ধ থাকবে তত বেশি বিপদজনক ঘটনা ঘটবে। ট্রাম্পের এ বক্তব্যের মাঝে সামাজিক অস্থিরতার আশঙ্কার আভাস পাওয়া যায়। ট্রাম্প বলেছেন, মার্কিন অর্থনীতি অনির্দিষ্টকাল এভাবে চলতে পারে না। কাজ ছাড়া বেতন দেয়া দীর্ঘদিন সম্ভব নয়।

ট্রাম্প চান না আমেরিকা এখন অর্থনৈতিক দুর্দাশায় পড়–ক। এতে তার পুননির্বাচিত হওয়ার আশা ভন্ডুল হয়ে যেতে পারে। তা ছাড়া ট্রাম্প এবং করপোরেট শ্রেণী জানে যে, পুজিবাদী অর্থনীতি হলো একটি বাইসাইকেলের মত। একবার এটি চলা বন্ধ হয়ে গেলে আর দাড়িয়ে থাকতে পারে না। ধপাস করে পড়ে যায়। সুতরাং পুঁিজবাদী অর্থনীতির চাকা ঠিক রাখতে হলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালু করতে হবে আর শ্রমিকদের কাজে ফেরাতে হবে।

এমন পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের কাজে ফেরা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে লাখ লাখ শ্রমিক কাজে নাও ফিরতে পারে। কারন যতদিন পর্যন্ত করোনা ভাইরাস থেকে তারা পুরোপুরি নিরাপদ বোধ না করবে ততদিন তারা কাজে ফিরতে চাইবে না। জীবনের ঝুকি নিয়ে তাদের অনেকেই কাজে ফিরতে চাইবে না এটা পরিষ্কার।

সমাজের সর্বত্র চেইন অব কমান্ড ঠিক থাকছে না। এমনকি সেনাবাহিনীতেও এর প্রভাব পড়ছে। প্রশান্ত মহাসাগরে মার্কিন বিমানবাহী রণতরী থিওডর রুজভেল্টের ঘটনা এর প্রমান। এই রনতরীতে যা হয়েছে তাকে প্রায় বিদ্রোহের ঘটনার সাথে তুলনা করা যায়। মার্কিন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে এটি একটি সতর্ক বার্তা। চেইন অব কমান্ড ভঙ্গ করে ২০ জন উর্দ্ধতন কর্মকর্তার কাছে চিঠি লিখে জাহাজে থাকা ৪ হাজার নৌ সেনাদের জীবন রক্ষার বিষয়ে চিঠি লিখেছিলেন কমান্ডার ক্যাপ্টেন ব্রেট। তার এ চিঠি চলে যায় গণমাধ্যমের হাতে। এসব অভিযোগে পেন্টাগন কর্মকর্তারা তাকে বরখাস্ত করে। কিন্তু জাহাজ থেকে বিদায়ের সময় নৌ সেনারা তার নামে স্লোগান দেয়। তাদের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা এবং জীবন রক্ষায় ভূমিকা পালনের জন্য ক্যাপ্টেনকে তারা হিরো বা বীর হিসেবে আখ্যায়িত করেন ।

করোনা মোকাবেলায় মার্কিন স্বাস্থ্য কর্মীদের দুরবস্থার চিত্র আরো ভয়াবহ। নার্সরা অত্যাবশ্যকীয় চিকিৎসা সামগ্রী চেয়ে বিভিন্ন হাসপাতালের সামনে দাড়িয়েছে প্লাকার্ড হাতে নিয়ে। সুপার পাওয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ চিত্র সত্যিই অভাবনীয়। তারা স্বাস্থ্যকর্মীদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ কর্তৃপক্ষ যদি শ্রমিকদের কাজে ফেরাতে বাধ্য করে তাহলে সেক্ষেত্রে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বড় ধরনের বিক্ষোভ, বিদ্রোহ আর বিশৃঙ্খলার ঘটনা ঘটতে পারে।

আরেকটি আশঙ্কা হলো কল্যান ভাতার ফান্ড ফুরিয়ে গেলে নির্ভরশীল পরিবারগুলো কিভাবে তাদের পরিবার চালাবে। আর ট্রাম্প ইতোমধ্যে ইঙ্গিত দিয়েছেন এ ফান্ড শেষ হয়ে যাবার বিষয়ে। করোনা ভাইরাসের কারনে ইতোমধ্যে ১ কোটি আমেরিকান কাজ হারিয়েছেন। চাকরিহারা লোকের সংখ্যা ৪ কোটি ৭০ লাখে পৌছতে পারে।

বিভিন্ন মহল থেকে ইতোমধ্যে প্রশ্ন উঠতে শূরু করেছে আমেরিকা প্রতি বছর সামরিক খাতে শত শত বিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে পারে কিন্তু কর্মজীবী আর চাকরিহারা লোকজনের পরিবারকে বিশেষ সহায়তার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র সাড়া দিতে পারছে না।

বাস্তবতা হচ্ছে কর্মহীন হয়ে পড়া কয়েক কোটি মানুষকে দীর্ঘদিন সহায়তা করবে না সরকার। তখন পরিস্থিতি আরো জটিল রুপ ধারন করতে পারে। সম্ভাব্য দুরবস্থা আর বিশঙ্খলা ছড়িয়ে পড়া বিষয়ে শুধু মার্কিন নাগরিকরাই উদ্বিগ্ন নয় বরং ট্রাম্প প্রশাসনও এ বিষয়ে আতঙ্কিত। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যাবার আশঙ্কা থেকে ইতোমধ্যে তারা ন্যাশনাল গার্ডে থাকা ২১ হাজার সেনা মাঠে মোতায়েন করেছে।
এ ছাড়া সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হয়েছে সামরিক শাসন জারির। করোনার কারনে ট্রাম্প প্রশাসন যদি ভেঙ্গে পড়ে সে ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জারি করা হবে সামরিক শাসন। এ বিষয়ে স্ট্যান্ডবাই অর্ডার জারি করা হয়েছে এক মাসেরও বেশি আগে।

আমেরিকানরা মনে করছে শুধূমাত্র সরকারের অবহেলা আর অব্যবস্থাপনার কারনে করোনা সেখানে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। সরকারের অদুরদর্শিতার কারনে কোটি কোটি আমেরিকানদের জীবন ও জীবিকা আজ নিরাপত্তাহীনতায়। ট্রাম্প যখন বলেন, পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে তখন হয়তো আসলে তিনি নিজেও জানেন না এ খারাপের মাত্রা আসলে কতটা।