হাইপারসনিক মিসাইল যুক্ত রাশিয়ার এসইউ-৫৭

রাশিয়ার এসইউ-৫৭ -সংগৃহীত -

  • মেহেদী হাসান
  • ১০ মার্চ ২০২০, ১২:৫০

এখন পর্যন্ত আকাশে আধিপত্য বিস্তারে শ্রেষ্ঠ রুদ্ধ বিমান বিবেচনা করা হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফিফথ জেনারেশন স্টেলথ ফাইটার এফ-২২ র‌্যাপটর। তবে খুব শীঘ্রই মার্কিন এ আধিপত্য খর্ব হতে যাচ্ছে রাশিয়ার এসইউ-৫৭ সুপারসনিক বিমানের কাছে। কারন এসইউ-৫৭ বিমানের সাথে যুক্ত হতে যাচ্ছে পারমানবিক বোমা বহনে সক্ষম হাইপারসনিক মিসাইল।
রাশিয়ার এসইউ-৫৭ যুদ্ধ বিমান ফিফথ জেনারেশন ফাইটার জেট। এ যুদ্ধ বিমানেরও রয়েছে স্টেলথ বৈশিষ্ট্য। ইতোমধ্যে রাশিয়ার এসইউ-৫৭ কে যুক্তরাষ্ট্রের এফ-২২ র‌্যাপটরের সমান ক্ষমতার বিবেচনা করা হচ্ছে। এখন সুপারসনিক এ যুদ্ধ বিমানের সাথে হাইপারসনিক মিসাইল যুক্ত হলে আকাশে আধিপত্য বিস্তারে শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে এ বিমান হয়ে উঠবে অপ্রতিরোধ্য আর ভয়ঙ্কর এক যুদ্ধ বিমান। কারন এখন পর্যন্ত বিশ্বে রাশিয়া হলো একমাত্র হাইপারসনিক মিসাইলের দেশ যার গতি শব্দের চেয়ে ২৭ গুন বেশি।

রাশিয়ার টেকটিক্যাল মিসাইল করপোরেশনের জেনারেল ডাইরেক্টর বরিস অবনোসভ ভবিষ্যতে এসইউ-৫৭ বিমানে হাইপারসনিক মিসাইল যুক্ত করার কথা জানান ।
রাশিয়ার রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বার্তা সংস্থা তাস জানিয়েছে, এসইউ-৫৭ বিমানে হাইপারসনিক মিসাইল যুক্ত করার কথা। তাসের খবরে বলা হয় কিনজহাল মিসাইলের মত মিসাইল যুক্ত করা হবে এতে। কিনজহাল হলো হাইপারসনিক মিসাইল এবং এটি পারমানবিক বোমা বহনে সক্ষম। বার্তা সংস্থা তাস জানায় রাশিয়ার কিনজহাল হলো বিশ্বে একমাত্র এয়ারবর্ণ হাইপাসনিক মিসাইল সিস্টেম । ইতোমধ্যে এ মিসাইল বসানো হয়েছে মিগ-৩১ যুদ্ধ বিমানে। কিনজহাল হাইপারসনিক মিসাইলের কথা ২০১৮ সালে প্রকাশ করেন স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন। তিনি নিজে এর বিবরণ দিয়ে বলেন, হাইপারসনিক এ মিসাইল শব্দের চেয়ে দশগুন বেশি গতিসম্পন্ন। এটি এন্টি এয়ারক্রাফট এবং এন্টি মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম । পারমানবিক এবং প্রচলিত উভয় ধরনের বোমা বহনে সক্ষম এ মিসাইল এর লক্ষ্যমাত্রা ২ হাজার কিলোমিটার।

আকাশে আধিপত্য বিস্তারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাধুনিক জঙ্গি বিমান এফ-২২ র‌্যাপটর কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে রাশিয়া তৈরি করে এসইউ-৫৭। নির্মানের পর থেকে আকাশে আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্রে বর্তমান অন্যতম আলোচিত এ জঙ্গি বিমানের নাম । বর্তমানে দুই ইঞ্জিন বিশিষ্ট এ বিমান ব্যাপক বিধ্বংসী সমরাস্ত্র বহনে সক্ষম। রাশিয়া এখন পর্যন্ত ১০টি এসইউ-৫৭ বিমান তৈরি করেছে। ২০১০ সালের ২৯ জানুয়ারি প্রথম আকাশে ওড়ে এ বিমান। উদ্ভাবনের পর থেকে বহুমুখী এ যুদ্ধ বিমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লকহিড মার্টিন এর এফ-২২ র‌্যাপটর বিমানের জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচনা করা হয় সমরাস্ত্র অঙ্গনে।

রাশিয়া ২০০২ সালে এ যুদ্ধ বিমান উদ্ভাবন প্রকল্প হাতে নেয়। এটি নির্মান করেছে রাশিয়ার সুখোই। বিমানটির পুরো নাম সুখোই এসইউ-৫৭। ন্যাটো এ বিমানের নাম দিয়েছে ফেলন। এ বিমান রাশিয়ার প্রথম স্টেলথ টেকনোলজি যুদ্ধ বিমান। এর ডিজাইন সুপারক্রুজ। অর্থাৎ এতে সুপারসনিক কার্গো এবং সুপারসনিক প্যাসেঞ্জার বিমানের সমন্বয় রয়েছে। এত রয়েছে সুপারম্যানুভারাবিলিটি। এটি আকাশ থেকে আকাশে, আকাশ থেকে ভূমিতে এবং আকাশ থেকে সমুদ্রে মিসাইল ছুড়তে পারে। আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য চারটি মিসাইল বহন করতে পারে এই বিমান। আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপ করা মিসাইল ৩৭ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্য বস্তুতে আঘাত করতে পারে। এর প্রধান ইজেকশন লঞ্চারে ৩০০ কেজি ওজনের মিসাইল এবং ৭০০ কোজি ওজনের বোমা বহন করতে পারে। এ ছাড়া এটি আকাশ থেকে ভূমিতে নিক্ষেপের জন্য দূর পাল্লার ক্ষেপনাস্ত্র ও ৫০০ কেজি ওজনের গাইডেড বোমা বহন করতে সক্ষম। এতে রয়েছে এন্টি শিপ ও এন্টি রাডার মিসাইল। এ বিমানে রযেছে অতি হালকা ৫০ কেজি ওজনের কামান যা প্রতি মিনিটে ১ হাজার ৮০০ রাউন্ড গোলা ছড়তে পারে। রাশিয়ার এসইউ -৫৭ যুদ্ধ বিমানে রয়েছে সর্বশেষ এভিয়েশন টেকনোলজি। এর রয়েছে রাডার ফাঁকি দেয়ার এবং ত্বরিত বাক নেয়ার ক্ষমতা। তবে এ বিমানের ক্ষমতার অনেক তথ্য এখনো গোপন রাখা হয়েছে।

এসইউ-৫৭ যুদ্ধ বিমান রাশিয়া প্রথম ব্যবহার করে সিরিয়া যুদ্ধে। ২০১৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সিরিয়ার আকাশে দুটি এসইউ-৫৭ বিমান ওড়ে। আর এসইউ-৫৭ বিমানের এটিই হলো রাশিয়ার বাইরে প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ফ্লাইট পরিচালনা করা। সিরিয়ায় রাশিয়ার হামিমিম বিমান ঘাটি থেকে এ বিমান ফ্লাইট পরিচালনা করে। এ বিমান ঘাটিতে রাশিয়ার চারটি এসইউ-৩৫, চারটি এসইউ-২৫ এবং একটি বারিভ এ-৫০ বিমানের সাথে মোতায়েন করা হয় দুটি এসইউ-৫৭। প্রথম দুটি এসইউ-৫৭ মোতায়েনের পর সিরিয়ার আরো দুটি এসইউ-৫৭ বিমান মোতায়েনের খবর বের হয়। দামেস্কের পূর্ব গৌতা অভিযানে অংশ নেয় এসব যুদ্ধ বিমান। তবে রাশিয়ার বিমান ঘাটিতে বিদ্রোহীদের ড্রোন হামলার কারনে সমালোচনার মুখে পড়ে ।

২০১৮ সালের ১ মার্চ রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী সার্গেই সয়গু নিশ্চিত করেন যে, সিরিয়ার তাদের দুটি এসইউ-৫৭ দুই দিন অবস্থান করে এবং সফল পরীক্ষামূলক অভিযান পরিচালনা করে। ২৫ মার্চ তিনি জানান, এসইউ-৫৭ থেকে ক্রুজ মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়েছে সিরিয়ায় অভিযান পরিচালনার সময়। ১৮ নভেম্বর রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয় এসইউ-৫৭ এর সিরিয়া অভিযানের ভিডিও প্রকাশ করে জানায় সেখানে ১০টি ফ্লাইট পরিচালনা করে এ বিমান। রাশিয়ান সেনা প্রধান ভ্যালেরি গারাসিমভ ২০১৯ সালের ১৮ নভেম্বর জানান, তাদের এসইউ-৫৭ আরো একবার সিরিয়ায় সফল অভিযান পরীক্ষা চালিয়েছে। আগামী বছর থেকে এ বিমান বাজারে আসবে। এ বিমান অন্যান্য দেশে বিক্রি করবে রাশিয়া। গত বছর মস্কোতে অনুষ্ঠিত ম্যাক্স এয়ারশোতে রপ্তানিযোগ্য এসইউ-৫৭ বিমানের মডেল প্রদর্শন করা হয়। এর সার্ভিস লাইফ ৩৫ বছর। এ বিমানের প্রাথমিক ব্যবহারকারী হলো রাশিয়ান এয়ারফোর্স ও রাশিয়ান নেভি। গত বছর মে মাসে পুতিন তাদের নিজেদের জন্য এ ধরনের ৭৬টি বিমান তৈরির আদেশ দিয়েছেন। ২০১৯ সালের ৩০ আগস্ট মস্কো এয়ার শোতে এসইউ-৫৭ বিমান পরিদর্শন করেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান। তিনি এসময় নিশ্চিত করেন যে, তারা এ বিমান কেনার বিষয়ে রাশিয়ার সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।

২০০৯ সাল পর্যন্ত এসইউ-৫৭ বিমান কর্মসূচির হিসেব ধরা হয় ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ৮৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। বিশ্বে প্রথম ফিফথ জেনারেশন যুদ্ধ বিমানের অধিকারী হয় যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া বর্তমানে রাশিয়া এবং চীন ফিফথ জেনারেশন যুদ্ধ বিমানের অধিকারী । তবে স্টেলথ বা রাডার ফাঁকি দেয়ার দিক দিয়ে রাশিয়ার চেয়ে মার্কিন যুদ্ধ বিমান এগিয়ে রয়েছে । অপর দিকে গতির তুলনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফিফথ জেনারেশন যুদ্ধ বিমানের চেয়ে এগিয়ে আছে রাশিয়ার যুদ্ধ বিমান ।
২০০৭ সালে ভারত এবং রাশিয়া ফিফথ জেনারেশন ফাইটার এয়ারক্রাফট প্রোগাম বা এফজিএফএ হাতে নেয়। এর উদ্দেশ্য ছিল ভারতের জন্য ফিফথ জেনারেশনের যুদ্ধ বিমান তৈরি করা। এ কর্মসূচী থেকে ভারতের ২১৪টি বিমান কেনার কথা ছিল। কিন্তু ২০১৮ সালে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর বের হয় ভারত এ কর্মসূচি থেকে সরে এসেছে। কারণ ভারতের বিশ্বাস তাদের চাহিদা অনুযায়ী এই যুদ্ধ বিমানে স্টেলথ, কমব্যাট অ্যাভয়নিক্স, রাডার এবং সেন্সর ব্যবস্থা থাকবে না। তবে গত বছর আগস্টে রাশিয়ার একজন কর্মকর্তা জানান ভারতের কারনে এ কর্মসুচি বাস্তবায়নে বিলম্ব হচ্ছে। রাশিয়া ভারতের সাথে করা চুক্তি বাতিল করেনি।