পশ্চিম এশিয়ায় যেসব দেশে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি আছে

যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি- সংগৃহীত -

  • মেহেদী হাসান
  • ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১২:০৮

পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যরা অবস্থান করছে। ইরানের চারদিকে যুক্তরাষ্ট্র আগে থেকেই সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়ে রেখেছে। দেশটির পশ্চিম প্রান্তে উত্তর থেকে দক্ষিণ বরাবর কমপক্ষে ১০টি দেশে যুক্তরাষ্ট্র দাবার ঘুঁটির মতো সেনাদের সাজিয়ে রেখেছে। এসব দেশ হলো ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, সৌদি আরব, বাহরাইন, কুয়েত, জর্ডান, ইরাক, সিরিয়া ও তুরস্ক।

আর পূর্বদিকে রয়েছে আফগানিস্তান। সব মিলিয়ে ইরানকে একেবারে ঘিরে ফেলেছে যুক্তরাষ্ট্র। তার ওপর শুক্রবার পেন্টাগন ঘোষণা দিয়েছে তারা মধ্যপ্রাচ্যে আরো সাড়ে তিন হাজার সেনা সদস্য মোতায়েন করছে। ইতালিতে সেনাদেরকে রাখা হয়েছে স্ট্যান্ডবাই বা প্রস্তুত ।
ওয়াশিংটন পোস্টের রিপোর্টে বলা হয়েছে , মধ্যপ্রাচ্যে বিভিন্ন ঘাঁটিতে এবং যুদ্ধজাহাজে অবস্থান করছে মার্কিন কয়েক হাজার সেনা সদস্য। অনেক দেশে যে সেনা সদস্য রয়েছেন তাদেরকে রাখা হয়েছে প্রস্তুত। যুক্তরাষ্ট্রকে এসব স্থাপনায় আক্রমণ চালাতে পারে ইরান। আবার ইরানের বিরুদ্ধেও এসব স্থান থেকে হামলা চালাতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। ইরান সমর্থিত লেবাননের হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহ মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের যে কোনো স্থানে ও স্থাপনায় আঘাত হানার কথা বলেছেন।

মধ্যপ্রাচ্য ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৬০ হাজারের মতো সৈন্য রয়েছে। রয়েছে বেশ কয়েকটি ড্রোন ঘাটি। যেগুলো থেকে যে কোনো স্থানে আঘাত করা সম্ভব।  ইরাকে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৬০০০ সেনা সদস্য। মার্কিন কর্মকর্তারা সঠিক করে বলেন না যে, ইরাকে তাদের কি পরিমাণ সেনা সদস্য রয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে গ্রিন জোন, আল আসাদ বিমান ঘাঁটি। ইতোমধ্যে ইরাক থেকে সৈন্য সরানোর একটি প্রস্তাব দেশটির পার্লামেন্টে পাস হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র এ প্রস্তাব আমলে নেবে না তা স্পষ্ট। বরং নতুন করে সেখানে আরো সেনা সমাবেশ করা হতে পারে।
সিরিয়ায় মোতায়েন রয়েছে প্রায় ৮০০ মার্কিন সেনা। তবে কি পরিমাণে সেনা সেখানে রয়েছে সে বিষয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছেন মার্কিন কর্মকর্তারা। অক্টোবরে প্রেসিডেস্ট ট্রাম্প আকস্মিকভাবে সেনা প্রত্যাহার করে নেয়ার পরও সেখানে ৮০০ সেনা রয়েছেন। অক্টোবরে সেনা সংখ্যা ছিল ২০০০। সিরিয়া-জর্ডান সীমান্তে তানফ গ্যারিসন হলো যুক্তরাষ্ট্রের এখন একমাত্র অবস্থানস্থল। ব্রাসেলসভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ সতর্ক করেছে এটা হতে পারে আক্রমণের বড় কেন্দ্র। কারণ, এর কাছাকাছি মোতায়েন রয়েছে ইরানি অথবা ইরান সমর্থিত বাহিনী।

আফগানিস্তানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ১৪০০০ সেনা সদস্য। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের সতর্কতা, এই স্থানটি যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র হতে পারে। নভেম্বরে আফগানিস্তানের বাগরাম বিমান ঘাঁটি আকস্মিক সফরে এসেছিলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। যদিও তালেবানদের সাথে ইরানের সর্ম্পক তেমন ভালো নয়। তবে দেশটিতে ইরানের পক্ষে কাজ করার মতো জনবল রয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্যের কৌশলগত গুরুত্বপূর্ন দেশ জর্ডানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ৩ হাজার সেনা সদস্য। জর্ডানকে ঘিরে রেখেছে ইরাক, সিরিয়া, ইসরাইল, দখলীকৃত ফিলিস্তিনি ভূখন্ড এবং সৌদি আরব। এই দেশটিকে যুক্তরাষ্ট্রের বড় একটি মিত্র হিসেবে দেখা হয়। যুক্তরাষ্ট্র এেখানকার মুওয়াফফাক সালতি বিমান ঘাঁটি ব্যবহার করে থাকে। এখন এই বিমানঘাটি আরো আধুনিকায়নের পরিকল্পনা চলছে। ২০১৬ সালের নভেম্বরে জর্ডানের বিমান বাহিনীর একজন সার্জেন্ট কিং ফয়সাল বিমান ঘাঁটিতে গুলি করে হত্যা করেন যুক্তরাষ্ট্রের তিন সেনা সদস্যকে। এ ঘটনাটি বিরল।

যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ট মিত্রদেশ সৌদি আরবে মোতায়েন রয়েছে ৩ হাজার সৈন্য। গত অক্টোবরে সৌদি আরবের তেল স্থাপনায় ড্রোন হামলা চালানের পর ইরানের সঙ্গে সৌদি আরবের উত্তেজনা তুঙ্গে ওঠে। সে সময় দেশটিতে অতিরিক্ত সেনা পাঠায় যুক্তরাষ্ট্র। সৌদি আরব ও ইরান দীর্ঘদিন আঞ্চলিক প্রতিপক্ষ। এ দুটি দেশ ইয়েমেনে প্রক্্ির যুদ্ধে লিপ্ত। সৌদি আরবে তেল ও গ্যাস স্থাপনায় হামলার জন্য ইরানকে দায়ী করে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু এ অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে ইরান।

কুয়েতে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ১৩০০০ সেনা। কংগ্রেশনাল রিসার্স সার্ভিসের মতে, কুয়েতের বিভিন্ন ঘাঁটিতে মোতায়েন রয়েছে তারা। ১৯৯১ সালের পারস্য উপসাগরীয় যুদ্ধের পর থেকে এই দুটি দেশের মধ্যে রয়েছে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বিষয়ক চুক্তি।

বাহরাইনে মোতায়েন আছে যুক্তরাষ্ট্রের ৭০০০ সেনা সদস্য। বাহরাইনে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চম নৌবহরন ও নৌ সেন্ট্রাল কমান্ড। সেখানে কয়েক হাজার সেনা সদস্য অবস্থান করছেন অথবা আসা যাওয়া করে। এই দ্বীপরাষ্ট্রটি সৌদি আরবের ঘনিষ্ঠ মিত্র। ইরানের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের কট্টর অবস্থানের সমর্থক দেশের শাসকরা। কারন দেশটির সংখ্যাগরিষ্ট মানুষ শিয়া। ২০১১ সালে শিয়ারা ব্যাপক বিক্ষোভ করলে কঠোরভাবে দমন করা হয়। এর ফলে ইরান সরকারের সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্ব আরো প্রকট হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের আরেক ঘনিষ্ট মিত্র সংযুক্ত আরব আমিরাত। ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে সংযুক্ত আরব আমিরাতের রয়েছে প্রবল আগ্রহ। দেশটিতে আছে যুক্তরাষ্ট্রের ৫ হাজার সেনা সদস্য। এ দেশটির অবস্থান হরমুজ প্রনালীর উপকূলে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কৌশলগত কারনে দেশটির অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ । সাম্প্রতিক সময়ে এ দেশে ৫ হাজার মার্কিন সেনা অবস্থানের অনুমতি পেয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি মিত্র দেশ ওমান। এখানে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৬শ সেনা সদস্য। এ দেশটি মাত্র কয়েক শত মার্কিন সেনাকে অবস্থানের অনুমতি দিযেছে। ওমানের কয়েকটি বিমান ও স্থল বন্দর ব্যবহারে মার্কিন বিমান ও যুদ্ধজাহাজকে অনুমতি দিয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে ওমান। আরব উপদ্বীপ অঞ্চলে ওমানের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ স্থানে। বিশ্বের জ্বালানী সরবরাহের প্রধান সমুদ্রপথ হরমুজ প্রনালীর পাশেই এ দেশের অবস্থান। ফলে কোনো কারণে ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ বেধে গেলে প্রথমেই ইরান হরমুজ প্রণালীতে পশ্চিমা স্বার্থে আঘাত করার চেষ্টা করবে। ইরানের সেই চেষ্টাকে প্রতিহত করতে ওমান যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ও কৌশলগত একটি অংশীদার। গত কয়েক মাসে তেলের ট্যাঙ্কার নিয়ে এই হরমুজ প্রণালীতেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছিল।

কাতারে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ১৩ হাজার সেনা। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটি হলো কাতারের আল উদেইদ। ২০১৮ সালে এই ঘাঁটিটি আধুনিকায়নে ১৮০ কোটি ডলারের পরিকল্পনা ঘোষণা করে কাতার। সৌদি আরব ও আরব আমিরাতের দ্বারা অবরোধের বিরুদ্ধে যখন কাতার লড়াই করছিল তখন এই আধুনিকায়নের পদক্ষেপ নেয়া হয়।

ইরানের পাশে অবস্থান ন্যাটো সদস্যভুক্ত দেশ তুরস্ক। দেশটিতে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ২৫০০ সেনা সদস্য। এর ইনসিরলিক বিমান ঘাঁটিতে অবস্থান করছে এসব সেনা। যদি ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ বেধে যায় তাহলে চারদিকে থেকে এসব সেনা ও সামরিক সরঞ্জাম একসঙ্গে ব্যবহার করতে পারেন পেন্টাগন।