এশিয়ায় মার্কিন নৌশক্তি

যুক্তরাষ্ট্রের নৌবহর - সংগৃহীত

  • আলফাজ আনাম
  • ৩১ জানুয়ারি ২০২০, ১০:৩১

অর্থনৈতিক ও কৌশলগত গুরুত্ব বিবেচনায় এশিয়া এখন যুক্তরাষ্ট্রের মনোযোগের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। আঞ্চলিক শক্তি থেকে পরাশক্তি হিসেবে চীনের উত্থান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এশিয়া নীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের নৌশক্তিকে চ্যালেঞ্জ করছে চীন। ২০১৭ সালের শুরুতে চীনের যুদ্ধ জাহাজের সংখ্যা ছিলো ৩২৮ এখন তা ৩৫০টি অতিক্রম করতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে চীন যুদ্ধ জাহাজের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলেছে। চীন প্রতিবছর অনন্ত তিনটি সাবমেরিন কমিশন করছে। নৌবহরে যোগ হয়েছে ৭৬টি সাবমেরিন। জ্বালানি নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তারকে সামনে রেখে এ অঞ্চলে নৌ উপস্থিতির গুরুত্ব বাড়ছে।


এশিয়ায় মার্কিন রণতরী বা নৌঘাঁটিগুলোর উপস্থিতির চিত্র দেখলে আমরা বুঝতে পারব জালের মতো এশিয়াকে ঘিরে রেখেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ছয়টি নৌবহর বিশ্বজুড়ে সমুদ্রসীমা নিয়ন্ত্রণ করছে : ১. পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্য তৃতীয় নৌবহর। এর হেডকোয়ার্টার ক্যালিফোর্নিয়ার সান দিয়াগো। ২. দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরের জন্য চতুর্থ নৌবহর। এর হেড কোয়ার্টার ফ্লোরিডার মে পোর্ট। ৩. আরব সাগর ও মধ্যপ্রাচ্যের জন্য পঞ্চম নৌবহর। এর হেড কোয়ার্টার বাহরাইনের মানামা। ৪. ভূমধ্যসাগর ও ইউরোপীয় অঞ্চলের জন্য ষষ্ঠ নৌবহর। এর হেড কোয়ার্টার গেতে, ইতালি। ৫. এশিয়া ও পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্য প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবহর যা সপ্তম নৌবহর নামে পরিচিত। হেড কোয়ার্টার ইওকুসুকা, জাপান। ৬. অ্যান্টি-সাবমেরিন যুদ্ধ বিষয়ে গঠন করা হয়েছে দশম নৌবহর। হেড কোয়ার্টার মেরিল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র।

পশ্চিম এশিয়ায় মার্কিন নজরদারি বাড়ানোর লক্ষ্যে বাহরাইনে অবস্থান করছে পঞ্চম নৌবহর। এর হেড কোয়ার্টার বাহরাইনের রাজধানী মানামায়। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মার্কিন নৌ-আধিপত্য বজায় রাখছে প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবহর বা সপ্তম নৌবহর। বাহরাইনে ১৯৭১ সালে নৌঘাঁটি স্থাপন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সম্প্রতি এই নৌঘাঁটির আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ করা হয়েছে। এই নৌবহর পারস্য উপসাগর, লোহিত সাগর, আরব সাগর এবং পূর্ব আফ্রিকা ও কেনিয়ায় মার্কিন সামরিক প্রভাব বজায় রাখার দায়িত্ব পালন করে। আফ্রিকার জিবুতিতে যে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি রয়েছে সেটিও এই নৌবহরের আওতাভুক্ত। ইরাক যুদ্ধে এই নৌবহর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অপারেশন এনডিউরিং ফ্রিডম ও অপরাশেন নিউ ডন নামে ইরাক যুদ্ধে দু’টি সামরিক অভিযান চালানো হয় এই ঘাঁটি থেকে। বাহরাইন ছাড়াও সংযুক্ত আরব আমিরাতে দু’টি নৌঘাঁটি রয়েছে। এর একটি ফুজাইরাহতে, অপরটি দুবাইয়ের পোর্ট জুবেল আলীতে। এ ছাড়া কাতারে রয়েছে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি। এই নৌবহর ও সামরিক ঘাঁটি থেকে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় মার্কিন সামরিক নজরদারি নিশ্চিত করা হয়।


এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মার্কিন নৌ-আধিপত্য বজায় রাখছে প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবহর বা সপ্তম নৌবহর। দক্ষিণ চীন সাগর, ভারত মহাসাগর, বঙ্গোপসাগরের ওপর নজর রাখে এই নৌবহর। জাপানের ইয়োকোসুকায় এই হেডকোয়ার্টার দক্ষিণ কোরিয়ারও কাছাকাছি। কোরিয়া যুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ ও উপসাগরীয় যুদ্ধে এই নৌবহর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় নৌবহর সপ্তম নৌবহর। ১০টি টাস্কফোর্সে ৫০ থেকে ৬০টি জাহাজ, ৩৫০টির মতো এয়ারক্রাফট, ৬০ হাজার নৌ ও মেরিন সৈন্য এই নৌবহরে দায়িত্ব পালন করে।

সপ্তম নৌবহরের আওতায় এশিয়ার সমুদ্র অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে ১৫টির বেশি জাহাজ স্থায়ীভাবে মোতায়েন রয়েছে। সপ্তম নৌবহরের আওতায় বেশ কয়েকটি সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। পশ্চিম প্রশান্ত মহসাগরের দ্বীপ গুয়াম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপগুলোর একটি গুয়াম। ৫৪১ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই দ্বীপটির ৩৯ শতাংশ মার্কিন সামরিক স্থাপনার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। এখানে মার্কিন নৌঘাঁটি ছাড়াও অ্যান্ডারসন বিমানঘাঁটি, অপরা পোতাশ্রয়, নেভাল কম্পিউটার ও টেলিকমিউনিকেশন স্টেশন এবং জয়েন্ট ফোর্সের হেড কোয়ার্টার রয়েছে। গুয়াম দ্বীপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমুদ্র ও আকাশ যুদ্ধের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হবে। গুয়াম নৌঘাঁটি গুরুত্বপূর্ণ সাবমেরিন স্কোয়াড্রন-১৫ কমান্ডারের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার হয়। মার্কিন সেনাবাহিনী প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবহর, সপ্তম নৌবহর ও পঞ্চম নৌবহরের বিভিন্ন ধরনের সহায়তা ও যোগাযোগ রক্ষা করা হয় গুয়াম থেকে। গুয়ামের অ্যান্ডারসন বিমানঘাঁটি থেকে যুদ্ধবিমানগুলো বিমান হামলা করে থাকে।

যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি ঘাটি রয়েছে দিয়েগো গার্সিয়ায়। ভারত মহাসাগরে মার্কিন নৌবাহিনীর সবচেয়ে বড় নৌঘাঁটি দিয়েগো গার্সিয়া দ্বীপ। সপ্তম নৌবহরের আওতায় এই দ্বীপটি ভারতের দক্ষিণ উপকূল থেকে ১২০০ নটিক্যাল মাইল দক্ষিণে এবং আফ্রিকা উপকূল থেকে ১৮০০ নটিক্যাল পূর্বে। এ দ্বীপে নৌবহরের অনেক জাহাজ ও সাবমেরিন সহায়ক ঘাটি রয়েছে। এ ছাড়া সামরিক বিমানঘাঁটিও রয়েছে। একসময়ের ব্রিটিশশাসিত এই দ্বীপে ১৯৭১ সালে ঘাঁটি স্থাপনের কাজ শুরু করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এরপর ধাপে ধাপে বৃহৎ সামরিক ঘাঁটিতে পরিণত করা হয়। দ্বীপটিতে ১২ হাজার ফুট দীর্ঘ দু’টি রানওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। যেখানে বোমারু বিমানগুলো নামতে পারে। এই বিমানঘাঁটি থেকে ইরাক-কুয়েত যুদ্ধে বি-৫২ বোমারু বিমান ব্যাপক বোমাবর্ষণ করে আবার এখানে ফিরে আসত। ২০০১ সালে আফগান ও ইরাক যুদ্ধেও মার্কিন যুদ্ধবিমানগুলো দিয়েগো গার্সিয়ার বিমানঘাঁটি ব্যবহার করেছে।

গভীর সমুদ্রে মার্কিন ও ব্রিটিশ জাহাজগুলো ভেড়ার মতো স্থাপনা নির্মাণ করা হয়। এয়ারক্রাফট হ্যাঙ্গার, রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ভবন এবং বিশাল এয়ার টার্মিনাল স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া ১৩ লাখ ৪০ হাজার ব্যারেল জ্বালানি মজুদের ব্যবস্থা রয়েছে এ দ্বীপে। একসময় ভারতের পক্ষ থেকে দ্বীপটিকে সামরিক ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহারের সমালোচনা করা হলেও এখন আর ভারতের রাজনীতিবিদেরা এর সমালোচনা করেন না। ২০০১ সাল থেকে বিভিন্ন সময় ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের নৌ ও সেনাবাহিনী দিয়েগো গার্সিয়ায় সামরিক মহড়ায় অংশ নিয়েছে।


এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের নৌবহর কৌশলগত গুরুত্বপূর্ন স্থানগুলোতে অবস্থান করছে। এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে পুরানো ও বিশ্বস্ত মিত্র হচ্ছে জাপান ও দক্ষিন কোরিয়া। এই দুদেশে আছে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি। এই দুদেশের নৌ সীমায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ জাহাজ। জাপানে ও দক্ষিন কোরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের এই সামরিক উপস্থিতি চীনের জন্য বড় হুমকি। চীন ও জাপানের মধ্যে বিরোধের অন্যতম কারন হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি।


জাপানে বিভিন্ন দ্বীপে মার্কিন বিমান ও নৌবাহিনীর অনেক ঘাঁটি রয়েছে। দুই দেশের মধ্যে নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা চুক্তির আওতায় এসব ঘাঁটি স্থাপন করা হয়। মার্কিন সপ্তম নৌবহরের ঘাঁটি রয়েছে ইয়োকোসুকাতে, তৃতীয় মেরিন এক্সপিডিটেশনারি ফোর্সের ঘাঁটি রয়েছে ওকিনাওয়া দ্বীপে, মার্কিন বিমান বাহিনীর দু’টি ঘাঁটি রয়েছে মিসওয়া ও কাদিনা দ্বীপে। এ ছাড়া জাপানের বিভিন্ন দ্বীপে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি রয়েছে। সপ্তম নৌবহরের কমান্ড শিপ ইউএসএস ব্লু রিজ-এর অবস্থান ইয়োকোসুকায়। এখানে রয়েছে এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার জর্জ ওয়াশিংটন, ডেস্ট্রয়ার স্কোয়াড্রন-১৫-এর অবস্থানও এখানে। সপ্তম নৌবহর পরিচালিত হয় জাপান থেকে। জাপানের বিভিন্ন দ্বীপে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি নিয়ে জাপানিদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। ওকিনাওয়া দ্বীপের জাপানি নাগরিকদের আন্দোলন বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সময় আলোচিত হয়েছে।


জাপানের পর এশিয়ায় মার্কিন সামরিক উপস্থিতি রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ায়। দেশটিতে সামরিক বাহিনীর ছোট-বড় মিলিয়ে ১১টি ঘাঁটি রয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার বুসানে রয়েছে নৌঘাঁটি। সপ্তম নৌবহরের আওতায় এই নৌঘাঁটি পরিচালিত হয়। এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের নৌশক্তির উপস্থিতিতে বাংলাদেশ দৃষ্টির বাইরে নয়। কৌশলগত দিক দিয়ে বাংলাদেশের গুরুত্ব রয়েছে। প্রচ্ছন্নভাবে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের মধ্যে বঙ্গোপসাগর কেন্দ্রিক প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা রয়েছে। যার একটি পক্ষ মিয়ানমার। আগামি দিনে এ অঞ্চলে এই প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা আরো তীব্র রুপ নিতে পারে।