হাইপারসনিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা, ভারত কিনছে এস-৪০০, উদ্বিগ্ন পাকিস্তান,ভাগ্যবান সাত গোয়েন্দা

হাইপারসনিক অস্ত্র- সংগৃহীত -

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী 
  • ৩১ জানুয়ারি ২০২০, ১০:৩৭

হাইপারসনিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা

হাইপারসনিক বা শব্দের গতির চাইতে পাঁচ গুণ বেশি গতিসম্পন্ন অস্ত্র উৎপাদনে বিশ্বে এ মুহূর্তে সবচাইতে অগ্রসর দেশ কোনটি? এ প্রশ্নের একটাই জবাব : রাশিয়া। তারা ইতিমধ্যে তাদের হাইপারসনিক গ্লিডার ''আভাগার্দ'' মোতায়েনও করে ফেলেছে। রাশিয়া করেছে, চীন কি বসে থাকতে পারে? তারাও এ ধরনের মিসাইল নির্মাণের পেছনে বিপুল বিনিয়োগ করছে। এদিকে বসে নেই আমেরিকাও। হাইপারসনিক অস্ত্র নির্মাণে রাশিয়ার সাফল্য এবং চীনের অগ্রগতি ঘোষণার পরপরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজস্ব  হাইপারসনিক মিসাইল নির্মাণে তড়িঘড়ি করে মাঠে নামে। কারণ, এ দু' দেশকেই যুক্তরাষ্ট্র ''প্রায় সমকক্ষ প্রতিপক্ষ'' বলে মনে করে এবং যে কোনো মূল্যে তাদের ঠেকাতে চায়। তাই আমেরিকার আকাশকে সুরক্ষিত রাখার আওয়াজ তুলে তারাও জার্মানির শীর্ষস্থানীয় মহাকাশ ও প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি কম্পানি নরথ্রপ গ্রূম্যানের সাথে একটি চুক্তি করেছে। চুক্তি অনুযায়ী ১৩ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে আমেরিকাকে ওই কম্পানি হাইপারসনিক অস্ত্র প্রতিরোধ সিস্টেম তৈরি করে দেবে। নতুন এ সিস্টেমটি কীভাবে কাজ করবে তা আগামী এক বছর অর্থাৎ ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসের মধ্যে আমেরিকার কাছে উপস্থাপন করবে ওই জার্মান কম্পানি।

আগেই বলা হয়েছে, রাশিয়া ইতিমধ্যে অর্থাৎ ২০১৯ সালে তাদের হাইপারসনিক গ্লিডার ''আভাগার্দ'' মোতায়েন করে ফেলেছে। এখন তারা পরিকল্পনা করছে, নিকট-ভবিষ্যতে আরো দু'টি হাইপারসনিক মিসাইল যোগ করার, যার একটি হবে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য এবং অপরটি সমুদ্রভিত্তিক। নিজ দেশের এই নতুন ধারার অস্ত্রসজ্জা উপস্থাপন করে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, অবিশ্বাস্য গতির এই মিসাইলই বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রতিরক্ষাব্যবস্থা।

এদিকে হাইপারসনিক অস্ত্র নির্মাণে অনেক দূর এগিয়ে গেছে চীনও। পেইচিং ২০১৯ সালের অক্টোবরেই তার প্রথম হাইপারসনিক গ্লাইড ভেহিকল ডিএফ-জেডএফ নির্মাণ করে। এটি উ-১৪ নামেও পরিচিত। চীনের এই হাইপারসনিক গ্লাইড ভেহিকলটির গতি শব্দের চাইতে পাঁচ ১০ গুণ বেশি। পক্ষান্তরে রাশিয়ার হাইপারসনিক গ্লিডার ''আভাগার্দ''-এর গতি শব্দের গতির চাইতে ১০-১২ গুণ বেশি।

ভারত কিনছে এস-৪০০, উদ্বিগ্ন পাকিস্তান

পাকিস্তান ও ভারতের বৈরিতা নতুন কিছু নয়। বাংলাদেশের পপ গুরু আজম খানের সেই জনপ্রিয় গানের মতোই তাদের সম্পর্ক ''আলাল যদি ডাইনে যায়, দুলাল যায় বাঁয়ে।'' এবারও তা-ই হয়েছে। ভারতে নিযুক্ত রুশ উপ-রাষ্ট্রদূত জানুয়ারি মাসের গোড়ার দিকে ঘোষণা দেন যে নয়াদিল্লি যে পাঁচটি এস-৪০০ মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম কেনার অর্ডার দিয়েছে, রাশিয়া সেগুলোর নির্মাণকাজ শুরু করেছে।


পাকিস্তান তার ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপণযোগ্য ব্যলাস্টিক মিসাইল ''গজনবি''র সফল পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণের পরপরই রুশ উপ-রাষ্ট্রদূতের এ ঘোষণা এলো। বলা প্রয়োজন যে, এর আগে ভারতও তাদের পরমাণু অস্ত্র বহনক্ষম মাঝারি পাল্লার কে-৪ ব্যালিস্টিক মিসাইলের পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ সম্পন্ন করে। রুশ উপ-রাষ্ট্রদূতের ঘোষণা শুনেই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে ইসলামাবাদ। তারা নয়াদিল্লির এস-৪০০ মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম কেনার সিদ্ধান্তে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, এটি এ অঞ্চলে ''একটি অকারণ অস্ত্র প্রতিযোগিতাই'' বাড়াবে শুধু।

এ প্রসঙ্গে পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আয়শা ফারুকী সাংবাদিকদের বলেন, আমরা অনুভব করছি যে এ ধরনের একটি স্থিতিশীলতা বিনষ্টকারী ব্যবস্থা দক্ষিণ এশিয়ার বর্তমান প্রতিরোধমূলক পরিস্থিতি ও স্থিতিশীলতাকে নস্যাত করবে, যা পরিণামে একটি অকারণ অস্ত্র প্রতিযোগিতার দিকে গড়াতে পারে। পাকিস্তান এ অঞ্চলে একটি কৌশলগত নিবৃত্তিমূলক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আলোচনার প্রস্তাব করছে।

২০১৮ সালে সম্পাদিত এক চুক্তিবলে ভারত ৫০০ কোটি মার্কিন ডলারের বিনিময়ে রাশিয়ার কাছ থেকে পাঁচটি এস-৪০০ মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম পাবে। ২০২৫ সালের মধ্যে রাশিয়ার এগুলো ভারতের কাছে হস্তান্তরের কথা রয়েছে। তবে নয়া দিল্লি বলেছে, ২০২০ সালের মধ্যে দেশে এসব সিস্টেম মোতায়েন করা হবে। এদিকে চুক্তিটি ওয়াশিংটনের চাপের মুখে রয়েছে। তারা বলছে, ভারতের উচিত, রাশিয়ার পরিবর্তে আমেরিকার কাছ থেকেই এ সিস্টেম কেনা।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে হুমকি দিয়ে রেখেছে যে যদি কোনো দেশ রাশিয়ান প্রতিরক্ষা খাত থেকে অস্ত্র ক্রয় করে তাহলে যুক্তরাষ্ট্র সে দেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার এ হুমকি ভারতের ওপর কার্যকর করবে কি না কিংবা আদৌ করতে পারবে কি না, সেদিকে সকৌতুক নজর রেখেছেন পর্যবেক্ষক মহল। 
 

ভাগ্যবান সাত গোয়েন্দা

বিশ্বব্যাপী  গোয়েন্দা বিভাগের একটা অলিখিত নিয়মই হলো, তারা সহজে তাদের গুপ্তচরদের নামধাম প্রকাশ করে না। তারা অপরিচয়ের অন্ধকারে থেকে নীরবে কাজ করে যান আর মহাকালের অন্ধকারেই চিরতরে হারিয়ে যান। বিশেষ করে যারা দূতাবাস ও কনস্যুলেটের মতো রাষ্ট্রীয় সংস্থার লিগ্যাল কভার ছাড়া বিদেশে গুপ্তচরবৃত্তি করেন, তাদের নাম প্রকাশের ঘটনা অতি বিরল। এই অর্থে পরলোকগত এ সাত গোয়েন্দাকে ''ভাগ্যবানই'' বলা যায়।


গত মঙ্গলবার সেই বিরল ঘটনাটিই ঘটালেন রাশিয়ান ফরেইন ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসের প্রধান সার্গেই নারিশকিন। তিনি প্রথম বারের মতো সাত জন রুশী গুপ্তচরেরনাম প্রকাশ করলেন, যারা কোনো রকম লিগ্যাল কভার ছাড়াই দেশের হয়ে বিদেশে গুপ্তচরবৃত্তি করেছেন।

রোশিয়া সেগুতনিয়া ইন্টারন্যাশনাল ইনফরমেশন এজেন্সিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে নারিশকিন এ সাত জনের নাম প্রকাশ করেন। এদের মধ্যে রাশিয়া ও অধুনালুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের সরবোচ্চ রাষ্ট্রীয় খেতাবপ্রাপ্ত ব্যক্তিও রয়েছেন। তারা হলেন হিরো অব দ্য রাশিয়ান ফেডারেশন ইউরি আনাতোলিয়েভিচ শেভচেনকো, হিরো অব দ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন ইয়েভগেনি ইভানোভিচ কিম, হিরো অব দ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন মিখাইল আনাতোলিয়েভিচ ভাসেনকভ, হিরো অব দ্য রাশিয়ান ফেডারেশন ভিতালি ভিচেসস্লাভোভিচ নেতিকসা ও তার স্ত্রী তামারা ইভানভনা নেতিকসা, ভ্লাদিমির ইওসিফোভিচ লেখভ এবং আলেসেইভিচ নিউকিন।

এর আগে গত ডিসেম্বরে রাশিয়ান ফরেইন ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসের প্রধান সার্গেই নারিশকিন ঘোষণা দিয়েছিলেন যে সংস্থার শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে এর সাতজন ''স্পেশ্যাল রিজার্ভ স্টাফ''-এর নাম প্রকাশ করা হবে।

সাবমেরিন নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে ভারত

৭০০ কোটি মার্কিন ডলারেরও বেশি অর্থ ব্যয়ে ছয়টি সাবমেরিন নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে ভারত। এ লক্ষ্যে প্রতিরক্ষা বিষয়ক সাতটি দেশি-বিদেশি কম্পানিকে চূড়ান্তও করেছে তারা। ভারতীয় নৌবাহিনীর পি৭৫আই প্রোগ্রামের অধীনে এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ মডেলের নির্দেশনায় ডিজেল-ইলেকট্রিক সাবমেরিনগুলো বানানো হবে ভারতেই। এ লক্ষ্যে দু'টি দেশীয় এবং পাঁচটি বিদেশি কম্পানি বাছাই করা হয়েছে। ভারতীয় কম্পানিগুলো হচ্ছে সরকারি খাতের মাজাগন শিপবিল্ডার্স লিমিটেড এবং বেসরকারি খাতের লারসেন অ্যান্ড টারবো। এছাড়া রয়েছে রাশিয়া, ফ্রান্স, স্পেন, জার্মানি ও দক্ষিণ কোরিয়ার একটি করে মোট পাঁচটি কম্পানি। এই পাঁচটি বিদেশি কম্পানিই সাবমেরিনের মূল সরঞ্জামগুলো তৈরি করবে।

ভারতীয় দুই কম্পানি মূলত এদের সহযোগী হিসেবেই থাকবে। শর্ত হচ্ছে, সাবমেরিনগুলোর ৬৫ শতাংশ উপাদান হতে হবে দেশীয় অর্থাৎ ভারতীয়। মাজাগন শিপবিল্ডার্স লিমিটেড ও লারসেন অ্যান্ড টারবো ছাড়াও আরো দু'টি ভারতীয় কম্পানি এ কাজে অংশ নিতে আগ্রহপত্র দিয়েছিল, কিন্তু বাছাইয়ে তারা বাদ পড়ে যায়। একইভাবে একটি সুইস প্রতিরক্ষা কম্পানিও প্রথমে আগ্রহ দেখায়, কিন্তু পরে ''শর্তাবলী অস্পষ্ট'' বলে তারা সরে যায়।

 

একজন ভারতীয় কর্মকর্তা বলেন, বিদেশি কম্পানিগুলোকে অবশ্যই সাবমেরিনের জটিল বিষয়গুলোর প্রযুক্তি হস্তান্তর করতে হবে। সাবমেরিনের খুচরা যন্ত্রাংশ ও অন্যান্য সরঞ্জামের যেন দেশেই উৎপাদন করা যায়, সে ব্যবস্থাও তাদের অবশ্যই করতে হবে। বিদেশি কম্পানিগুলো চাইলে যৌথ উদ্যোগ কিংবা ইক্যুইটি পার্টনারশিপ অথবা রয়্যালটি অ্যারেঞ্জমেন্টের ভিত্তিতে এ কাজ করতে পারে।অপর এক কর্মকর্তা জানান, প্রাথমিকভাবে মনোনীত পাঁচ বিদেশি কম্পানির একটির সাথে টেকনিক্যাল পার্টনারশিপ গড়তে চায় দু'টি ভারতীয় কম্পানি। বিষয়টি যাচাই করে দেখা হচ্ছে। 

মার্কিন আপত্তিতে পাক-তুরস্ক হেলিকপ্টার চুক্তি


তুরস্কের কাছ থেকে ৩০টি  টি১২৯ হেলিকপ্টার গানশিপ কেনার চুক্তি করেছিল পাকিস্তান। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তির মুখে চুক্তিটি নড়বড়ে হয়ে গেছে। এ অবস্থায় টার্কিশ অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজকে (টিএআই) হেলিকপ্টার সরবরাহের সময় আরো এক বছর বাড়িয়ে দিয়েছে পাকিস্তান।


২০১৮ সালে টিআইএ ও পাকিস্তানের মধ্যে টি১২৯ হেলিকপ্টার কেনাবেচার দেড় শ' কোটি মার্কিন ডলারের এ চুক্তিটি হয়। তবে তৃতীয় কোনো দেশের কাছে এ হেলিকপ্টার বিক্রি করতে হলে মার্কিন রফতানি লাইসেন্স প্রয়োজন হয়। কেন, সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।এখন পাকিস্তান দেনদরবার করছে, যাতে তুরস্ককে ওই হেলিকপ্টার রফতানির লাইসেন্সটা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। তবে কূটনীতিকরা বলছেন, ওয়াশিংটন তা দেবে বলে মনে হয় না। কারণ, রুশ নির্মিত এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কেনার কারণে গত বছর মাল্টিন্যাশনাল জয়েন্ট স্ট্রাইক ফাইটার প্রোগ্রামে তুরস্কের সদস্যপদই স্থগিত করে দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।


এখানে বলে রাখা ভালো, টি১২৯ হচ্ছে হচ্ছে দুই ইঞ্জিনবিশিষ্ট এক ধরনের মাল্টিরোল অ্যাটাক হেলিকপ্টার। ইতালিয়ান-ব্রিটিশ কম্পানি অগাস্টা ওয়েস্টল্যান্ড-এর লাইসেন্স নিয়ে এগুলো তুরস্কে উৎপাদিত হচ্ছে। এ হেলিকপ্টারের ইঞ্জিন নির্মাণ করে আমেরিকান প্রতিষ্ঠান হানিওয়েল এবং ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান রোলস-রয়েস। এ সম্পৃক্ততার কারণেই তৃতীয় কোনো দেশের কাছে এ হেলিকপ্টার রফতানির ব্যাপারে শর্ত দিতে পেরেছে যুক্তরাষ্ট্র।