এফ-৩৫ এর মতো বিমান বানাবে তুরস্ক : পাশে আছে মালয়েশিয়া

এফ-৩৫ যুদ্ধ বিমান-সংগৃহীত -

  • মেহেদী হাসান
  • ২৪ জানুয়ারি ২০২০, ২৩:১৭

আকাশে শ্রেষ্ঠত্ব  প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শক্তিশালী যুদ্ধ বিমান তৈরির বিশাল এক  প্রকল্প নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে তুরস্ক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে এফ-৩৫ যুদ্ধ বিমান সরবরাহ প্রত্যাখান করার পর তুরস্ক তাদের এ প্রকল্প নিয়ে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। তুরস্কের তৈরি এ যুদ্ধ বিমান হবে বিশ্বের  সর্বাধুনিক  যুদ্ধ বিমান। যা মানের দিক দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এফ-৩৫ বিমানের মতো হবে। এই বিমান বানানোর কর্মসূচীতে আমন্ত্রন জানানো হয়েছে মালয়েশিয়াকে।

তুরস্ক নতুন এ যুদ্ধ বিমানের নাম দিয়েছে টিএফ-এক্স বা  তার্কিশ ফাইটার এক্সপেরিমেন্টাল। ডিফেন্স নিউজের খবরে বলা হয়েছে  এই বিমান নির্মানে প্রাথমিক খরচ ধরা হয়েছে ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ৪ লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকা। তুরস্কের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে এ যুদ্ধ বিমান হবে মুসলমানদের জন্য প্রথম শক্তিশালী যুদ্ধ বিমান। ২০১৯ সালের জুন মাসে প্যারিস এয়ার শোতে এই ফাইটার যুদ্ধ বিমানের মডেল প্রদর্শন করা হয়।

২০১৯ সাল পর্যন্ত বিশ্বে সবচেয়ে শক্তিশালী যুদ্ধ বিমান গুলোর মধ্যে রয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এফ-২২ র‌্যাপটার, এফ-৩৫,  ইউরোপের ইউরো ফাইটার টাইফুন, ফ্রান্সের ড্যাসল্ট রাফায়েল, রাশিয়ার এসইউ-৫৭, চীনের চেংদু জে-২০ । এসব যুদ্ধ বিমান স্টেলথ ফাইটার বা ফিফথ জেনারেশন যুদ্ধ বিমান নামে পরিচিত। তুরস্ক  নতুন যুদ্ধ বিমান প্রকল্প নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে তা হবে  এ ধরনের যুদ্ধ বিমান।  অর্থাৎ তুরস্কের নতুন এ যুদ্ধ বিমান হবে স্টেলথ ফাইটার বা ফিফথ জেনারেশন যুদ্ধ বিমান।  ২০৭০ সাল পর্যন্ত বিমান যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা সামনে রেখে শক্তিশালী এ যুদ্ধ বিমান তৈরির পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে তুরস্ক। শুরুতে ২০২৩ সালে টিএফ-এক্স বিমান তৈরির প্রথম লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল । তবে এখন এর নতুন লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ২০২৫-২৬ সাল। অপর দিকে ডেইলি সাবাহর খবরে বলা হয়েছে ২০২৫-২৬ সালে ইঞ্জিন পরীক্ষা করা হবে ।

ডিফেন্স নিউজ ও ডেইলি সাবাহর খবরে বলা হয়েছে তুরস্ক এ সুদুরপ্রসারী  কর্মসূচীতে অংশগ্রহনের আমন্ত্রন জানিয়েছে এশিয়ার অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশ মালয়েশিয়াকে।  এ বিমান তৈরি করবে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান তার্কিস অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রি বা টিআইএ । মালয়েশিয়াকে এ বিমান তৈরির কর্মসূচীতে অংশগ্রহনের আমন্ত্রন বিষয়ে টিআইএ’র  প্রধান নির্বাহী তামেল কোটিল বলেন,  আমরা এখন তাদের উত্তর পাওয়ার অপেক্ষায় আছি। তার্কিস এরোস্পেস ইন্ডাস্ট্রি বা টিআইএ গত বছর মালয়েশিয়ার সাথে যৌথভাবে এ বিমান তৈরি বিষয়ে  সমঝোতা স্মারক সাক্ষর করে।

এ বিমান তৈরির কর্মসূচীত ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং কাজাখস্তানকেও সম্ভাব্য অংশীদার করতে চায় তুরস্ক। অথবা এসব দেশকে  ভবিষ্যত এ যুদ্ধ বিমানের ক্রেতা হিসেবে বিবেচনা করছে। তামেল কোতিল জানান টিএফ-এক্স  বিমান হবে কোনো মুসলিম দেশের প্রথম সবচেয়ে শক্তিশালী যুদ্ধ বিমান। আমরা ভাবছি এতে কাউকে  অংশীদার করতে পারলে ভালো হবে।  তামেল কোতিল আনাদলু এজেন্সিকে বলেন, টিএফ-এক্স এবং আরো একটি কম শক্তিশালী যুদ্ধ বিমান তৈরিতে মালয়েশিয়াকে অংশগ্রহনের প্রস্তাবে মালয়েশিয়া খুবই আগ্রহ দেখিয়েছে।  তিনি জানান, মালয়েশিয়ার  প্রধানমন্ত্রী মহাথির মোহাম্মদ এর আগে টিএআই কেন্দ্র পরিদর্শন করেছেন। আর গত ডিসেম্বরে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের মালয়েশিয়ার সফরের সময় দুই নেতার মধ্যে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা হয়েছে।

২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে তুরস্ক সফর করেন বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে। এসময় বৃটেনের ডিফেন্স কনট্রাকটর সংস্থা বিএই সিস্টেমস এর  সাথে ১২৫ মিলিয়ন ডলারের একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে টিআইএ। চুক্তি অনুসারে তুরস্কের এ আধুনিক যুদ্ধ বিমান তৈরির ক্ষেত্রে প্রকৌশলগত সহায়তা করবে বিএই সিস্টেমস। বৃটেনের বিএই সিস্টেমস পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ একটি প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা এবং অ্যারোস্পেস কোম্পানী। এই কোম্পানি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ বিমান বানানোর সাথে জড়িত। এছাড়া রাশিয়ার রসটেক, ইউনাইটেড ইঞ্জিন করপোরেশনসহ  কয়েকটি প্রতিরক্ষা কোম্পানী নিজ থেকে তুরস্ককে ফিফথ জেনারেশন যুদ্ধ  বিমান তৈরিতে সহায়তা করার প্রস্তাব দিয়েছে।  বৃটেনের এই কোম্পানির সাথে তুরস্কের  চুক্তির পর বৃটেন অন্য  প্রতিরক্ষা কোম্পানীগুলোর জন্য রপ্তানি লাইসেন্স  উন্মুক্ত করে দেয়।  যাতে এসব কোম্পানি তুরস্কের কাছে প্রযুক্তি হস্তান্তর করতে পারে।

এদিকে টিএফ-এক্স বিমান তৈরি ও নকশা প্রণয়নের জন্য তুরস্ক বৃটেনের রোলস-রয়েস কোম্পানীর সাথে  আলোচনা শুরু করবে। তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী  মেভলুত কাভুসোগলু গত ডিসেম্বরে বলেছেন, এ বিমান তৈরির জন্য বৃটেনের সহায়তা গ্রহন বিষয়ে পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ বিষয়ে আমরা সামনে এগিয়ে যেতে চাই। কিন্তু তুরস্ককে প্রথমে একটি ইঞ্জিন বাছাই করতে হবে এবং তারপর বিমানের নকশা।  এর আগে তুরস্কের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান কেল গ্রুপ ও বৃটেনের রোলস রয়েসের  মধ্যে  প্রযুক্তি হস্তান্তর বিয়ষক অনিশ্চিয়তার কারনে ১৩১ মিলিয়ন ডলারের একটি চুক্তি স্থগিত রাখা হয়েছিল ।

রোলস রয়েস ২০১৬ সালে যৌথভাবে তুরস্কে টিএফ-এক্স বিমানের ইঞ্জিন তৈরি, হেলিকপ্টার, ট্যাঙ্ক এবং মিসাইল তৈরির প্রস্তাব দিয়েছিল। এই প্রস্তাবে এগুলো তৃতীয় দেশে রপ্তানিরও সুযোগ রাখার বিষয়েও সিদ্ধান্ত হয় । এ বিষয়ে উভয় কোম্পানীর সাথে সমঝোতা স্বারকও সাক্ষরিত হয়। এর আওতায় রোলস রয়েস  তুরস্কে একটি আধুনিক যন্ত্রপাতি নির্মান কেন্দ্র ও প্রযুক্তি কেন্দ্র স্থাপনের কথা রয়েছে। বিশ্বে এ ধরনের আটটি শাখা রয়েছে রোলস রয়েসের।

ফিফথ জেনারেশনের টিএফ-এক্স যুদ্ধ বিমান তৈরি তুরস্কের দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা। ২০১১ সালে প্রথম এ উদ্যোগের ঘোষণা দেয়া হয়। ২০১৩ সালে  প্রথমে সুইডেনের সাথে একটি সমঝোতা স্মারক সাক্ষর করে তুরস্ক। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এরদোগান বাজেট বরাদ্দের ঘোষণা দেন। ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী আহমেদ দাভুতগলু ঘোষণা দেন বিদেশী কোনো সাহায্যা ছাড়া তুরস্ক নিজেই তৈরি করবে এ যুদ্ধ বিমান।

তুরস্কের নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা আশা করছেন টিএফ -এক্স যুদ্ধ বিমান যখন তৈরি হলে এটি তুরস্ক বিমান বাহিনীতে বর্তমানে  এফ-১৬ যুদ্ধ বিমানের জায়গা পূরণ করবে । এ ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে এফ-৩৫ যুদ্ধ বিমানের বহরে এটি যুক্ত করার প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল। যুক্তরাষ্ট্র এখন তুরস্ককে এফ-৩৫ যুদ্ধ বিমান কর্মসূচী থেকে বাদ দিয়েছে। প্যারিসে গত বছর অনুষ্ঠিত বিমান প্রদর্শনীতে তুরস্ক  ভবিষ্যতের এ টিএফ-এক্স  ফিফথ জেনারেশন যুদ্ধ বিমানের নমুনা প্রদর্শণ করেছে।  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্ক যৌথভাবে এফ-৩৫ বিমান তৈরির বিশাল এক কর্মসূচী নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। এজন্য তুরস্ক বিপুল পরিমান অর্থ বিনিয়োগ করে। এ প্রকল্পের আওতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ১০০টি এফ-৩৫ যুদ্ধ বিমান পাওয়ার কথা ছিল। ২০১৮ সালের জুন মাসে তুরস্ককে ২টি এফ ৩৫ যুদ্ধ বিমান হস্তান্তরের অনুষ্ঠান উদযাপনও করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রে থাকা অবস্থায় এসব বিমানে প্রশিক্ষন নিচ্ছিলেন তুরস্কের পাইলটরা। কিন্তু ২০১৯ সালে তুরস্ক রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ মিসাইল কেনার পর যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে এ প্রকল্প থেকে বের করে দেয়।  এফ-৩৫ সরবরাহের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে ওয়াশিংটন।

তুরস্ক যে টিএফ-এক্স যুদ্ধ  বিমান বানানোর পরিকল্পনা নিয়েছে যুদ্ধ ক্ষেত্রে বহুমুখী রাখতে পারবে।  এয়ার টু এয়ার এবং এয়ার টু সার্ফেস অ্যাটাকের সক্ষমতা থাকবে। দুই ইঞ্জিনের এ বিমান সব ধরনের আবহাওয়ায় শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শন করতে পারবে। তুরস্ক ছাড়াও পাকিস্তান, জাপান এবং ভারতও ফিফথ জেনারেশন যুদ্ধ বিমান বা স্টেলথ ফাইটার  উদ্ভাবনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ২০১৭ সালে পাকিস্তান প্রজেক্ট আজম নামে ফিফথ জেনারেশন যুদ্ধ বিমান তৈরির কর্মসূচী ঘোষণা করে। মনে করা হয় তুরস্কের সাথে মালয়েশিয়া ছাড়া পাকিস্তানও যোগ দিতে পারে। কারন এই দুদেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি রয়েছে।

প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকরা মনে করেন, ২০১৮ সাল পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এফ-২২ র‌্যাপ্টরকে  সর্বাধুনিক ফিফথ জেনারেশন যুদ্ধ বিমান হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীতে হয় ২০০৫ সালে। এরপর ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মার্কিন  বিমান বাহিনীতে যুক্ত হয় এফ-৩৫বি, এফ-৩৫এ ও এফ-৩৫ সি যুদ্ধ বিমান।  চীনের বিমান বাহিনীতে ২০১৭ সালে যোগ হয় চেংদু জে ২০। এখন তুরস্ক ফিফথ জেনারেশন বিমান বানানোর পরিকল্পনায় যুক্ত হলো।