আকাশপথে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য বিস্তারের লড়াই

- সংগৃহীত

  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ০৪ জুন ২০২৩, ১৫:০৮

মার্কিন বিমানবাহিনীর এক সময়ের প্রধান আকাশযান এফ-টেয়েন্টি টু র‌্যাপটর অধ্যায় খুব শীঘ্রই শেষ হতে চলেছে। এফ-টোয়েন্টি টু বিমানের স্থান নেওয়ার জন্য প্রস্তত হচ্ছে নেক্সট জেনারেশন এয়ার ডোমিন্যান্স বা এনজিএডি। চলতি মাসে প্রকাশিত ডিফেন্স জার্নাল জানিয়েছে, অতি সম্প্রতি মার্কিন বাহিনী এনজিএডির ষষ্ঠ প্রজন্মের নকশা নিয়ে একটি প্রতিযোগিতা আহবান করেছে। যে বিমানের নকশা চূড়ান্ত হিসেবে গৃহীত হবে, সেই বিমানগুলোই আগামী ১০ বছরের মধ্যে স্টেলথ এফ-টোয়েন্টি টুর স্থান দখল করে নেবে। ঠিক একইভাবে চীনও আকাশপথে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য নিয়মিত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

ষষ্ঠ প্রজন্মের ফাইটার জেট কীভাবে তৈরি হবে তার কোনো সার্বজনীন সংজ্ঞা না থাকলেও ধারণা করা হয় যে, এই বিমানগুলোতে একটি মডিউলার ডিজাইন, পাইলটের ঐচ্ছিক উপস্থিতি, ড্রোন বৈশিষ্ট্য, মেশিন লার্নিং, আর্টিফিশিয়ার ইন্টেলিজেন্স এবং ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মতো বৈশিষ্ট্যগুলো থাকতে পারে।

ডিফেন্স জার্নাল তার প্রতিবেদনে মার্কিন বিমানবাহিনীর একটি বিবৃতির বরাত দিয়ে জানিয়েছে, এই বিমানগুলোতে উন্নতমানের স্থাপত্য কাঠামো ব্যবহার করা হবে। বিমানগুলো এমনভাবে নির্মাণ করা হবে যাতে নির্ধারিত লাইফ সাইকেলগুলোতে এটি সর্বাধিক কার্যকর থাকে। পাশাপাশি রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত খরচও তাৎপর্যপূর্ণ মাত্রায় কমিয়ে আনা যায়।

ডিফেন্স ওয়ানের সাম্প্রতিক রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, ইউএস এয়ার ফোর্স সলিসিটেশন রিলিজ এরই মধ্যে এনজিএডি নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু করেছে। তবে, এখনও এই বিমানগুলোর প্রকৌশল ও নির্মাণ কাঠামো চুক্তির বিস্তারিত তারা জানায়নি। ২০২৪ সালের মধ্যে ষষ্ঠ প্রজন্মের বিমানের চূড়ান্ত নকশা প্রনয়নকারীকে বাছাই করা হবে।

ডিফেন্স ওয়ান আরও জানায়, মার্কিন বিমানবাহিনী যে বিবৃতি দিয়েছে তা থেকে জানা যায়, এরই মধ্যে বিমানের অপারেশনাল ও প্রযুক্তিগত সুবিধাগুলো সংরক্ষিত ও বিধিবদ্ধ রাখার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে, এই বিমানের প্রাসঙ্গিক হিসেবে যে ড্রোনগুলো নির্মিত হবে, সেগুলোকে ষষ্ঠ প্রজন্মের এই বিমানগুলোর বিশেষায়িত শ্রেণী বা অতি গোপন হিসেবে বিবেচনা করা হয়নি। ডিফেন্স ওয়ান আরও জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের দুটো অ্যারোস্পেস প্রতিষ্ঠান লকহিড মার্টিন এবং বোয়িং বর্তমানে যুদ্ধবিমান নির্মাণ করছে। নর্থম্যান গ্রুম্যান এই প্রতিষ্ঠান দুটোকে বিমান তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করছে।

মার্কিন বিমানবাহিনী কমপক্ষে ২০০টি এনজিএডি বিমান এবং একইসাথে ১ হাজার কোলাবোরেট কমব্যাট এয়ারক্রাফট সংগ্রহ করার পরিকল্পনা করেছে। সিসিএ হলো এমন ধরনের বিমান, যেগুলোকে রিমোটের মাধ্যমে দূর থেকে পরিচালনা করা হয়। এনজিএডি বিমানগুলো অনেকবেশি ব্যয়বহুল হবে। অন্যদিকে, সিসিএগুলো তুলনামূলক সস্তা হবে এবং সবার জন্যই সহজলভ্য করার চেষ্টা করা হবে।

বিমানগুলোর নকশা এমনভাবে করা হবে, যেন এগুলো নির্মাণে এফ-থার্টি ফাইভ যুদ্ধবিমান নির্মাণ খরচের সামান্য একটি অংশ ব্যয় করা হয়। এফ-টোয়েন্টি টু বিমানগুলো বেশি পুরাতন হয়ে যাওয়ায় কিংবা এগুলোর প্রযুক্তি অকার্যকর হওয়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্র এখন এফ-টোয়েন্টি টু বিমানগুলোর পরিবর্তে এনজিএডি সংস্করণের বিমানগুলো অপারেশনে নিয়ে আসতে চাইছে।

শুধু এফ-টোয়েন্টি টু বিমানই নয়, মার্কিন বিমানবহরে অবসরে যাওয়ার মতো অন্যান্য বিমানের সংখ্যা নেহাত কম নয়। এগুলোকে আপগ্রেড করতে গেলেও বিপুল অর্থের প্রয়োজন হবে। তাই ৯০ দশকের বিমানগুলোকে অনেক অর্থ খরচ করে সার্ভিসে রেখে দেওয়ার চেয়ে নীতি নির্ধারকদের কাছে বরং নতুন বিমান নিয়ে আসাই অধিক যৌক্তিক বলে বিবেচিত হচ্ছে।

চীনের সর্বাধুনিক জে-টোয়েন্টি বিমানের সাথে মোকাবেলায় অকার্যকর হওয়ায় ২০২৩ সালের মধ্যে ৩৩টি পুরনো এফ-টোয়েন্টি বিমানকে অবসরে পাঠানোর একটি পরিকল্পনা নিয়েছিল মার্কিন বিমানবাহিনী। পুরনো এ বিমানগুলোর প্রধান সংকট হলো, এতে অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র বা ইলেক্ট্রনিক ওয়ারফেয়ার বহন করা যায় না। যুদ্ধবিমান ও প্রশিক্ষণ বিমানের মধ্যে অনেকটা ব্যবধান থাকায় প্রশিক্ষণ শেষে পাইলটেরাও এ বিমানগুলো পরিচালনা করতে এসে হিমশিম খেয়ে যায়।

২০০৯ সালেই এফ-টোয়েন্টি টু নির্মাণ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। তখন এফ-টোয়েন্টি টু বিমানের সংখ্যা ছিল ১৮৬টি। এর নির্মাণ অব্যহত থাকলে পরবর্তী উন্নত সংস্করণ বা এফ-থার্টি ফাইভ বিমানের নির্মাণ কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছিল। এ কারণেই এফ-টোয়েন্টি টু নির্মাণ না করার সিদ্ধান্ত নিতে নীতি নির্ধারকেরা বাধ্য হয়েছিলেন।

চীনসহ অন্যান্য দেশগুলো ক্রমাগতভাবে উন্নত বিমান প্রযুক্তি ও নিরাপত্তা পদ্ধতি আবিষ্কার করে যাওয়ায় এফ-টোয়েন্টি টু বিমানগুলোর ডিফেন্স কৌশল ক্রমশ অকার্যকর ও সেকেলে হিসেবে বিবেচিত হতে শুরু করে। গত মাসে সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট জানায়, চীনের গবেষকরা এখন এফ-টোয়েন্টি টু বিমানকে আর হুমকি বলে মনে করেন না। এফ-থার্টি ফাইভ বিমানকে বিবেচনায় নিয়ে নিজেদের প্রতিরোধ কৌশল ঢেলে সাজাচ্ছে চীন। কারণ এফ-থার্টি ফাইভ নতুন প্রজন্মের বিমান এবং এগুলোর এভিওনিক্স যথেষ্ট উন্নত। এছাড়া এ বিমানগুলো একইসাথে অনেকগুলো ভূমিকা পালন করতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে প্রতিপক্ষের এয়ার ডিফেন্সের ব্যুহ ভেদ করে এয়ারফিল্ড বা কমান্ড ও কন্ট্রোল সেন্টারগুলোতে হামলার পরিকল্পনা করছে, চীন সে সম্পর্কে অবগত। এ কারণে চীনও বিকল্প প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসেবে কাউন্টার-এয়ার সমরাস্ত্র বিশেষ করে এইচ-কিউ নাইন মিসাইল এবং জে-টোয়েন্টি বিমানকে আরও উন্নত করেছে।

এফ-টোয়েন্টি টু বিমানের দুর্বলতা হলো এতে ইনফ্রাড সার্চ ও ট্র্যাক প্রযুক্তি নেই। অথচ আধুনিক বিমানগুলোতে এই প্রযুক্তি থাকা অপরিহার্য। ইতোপূর্বে নির্মিত এফ-টোয়েন্টি টু বিমানগুলোতে ইনফ্রাড সার্চ ও ট্র্যাক প্রযুক্তির পাশাপাশি সাইড লুকিং এয়ারবোর্ন রাডারও নেই।

বিমান নির্মাণের খরচ কমিয়ে আনার জন্য বিমানগুলোর নকশা থেকে এ প্রযুক্তিগুলো বাদ দেওয়া হয়েছিল। অথচ এ দুটো প্রযুক্তিই জরুরি। ইনফ্রাড সার্চ ও ট্র্যাক প্রযুক্তি থাকলে বিমান অনেক দূর থেকেই হুমকিগুলো সনাক্ত ও নির্নয় করতে পারে। এছাড়া এর একটি সেন্সরও থাকে যা অনেকটা নিস্ক্রিয়। কারণ, এগুলো থেকে কোনো সিগনাল প্রকাশ করে না। ফলে এই প্রযুক্তি থাকলে বিমান সবার আগে হুমকি দেখতেও পারে আবার হামলাও করতে পারে। এতে বিমানের স্টেলথ প্রযুক্তিও অক্ষুন্ন ও নিরাপদ থাকে। ফলে, বিমানগুলো ইলেক্ট্রনিক আক্রমণ বা জ্যামিং-এর ঝুঁকি থেকেও অনেকটা নিরাপদে থাকে।

যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড়ো প্রতিপক্ষ চীনও বসে সেই। তারাও ষষ্ঠ প্রজন্মের বিমান নির্মাণের জন্য জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ২০২২ সালের অক্টোবরে এশিয়া টাইমসে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের এনজিএডি প্রকল্প মোকাবিলা করার উদ্দেশ্যে চীনও একই সিস্টেমের নতুন বিমান নির্মাণ নিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছে।

চীন আশা করছে, ষষ্ঠ প্রজন্মের বিমানের ক্ষেত্রে তারাই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করবে। কেননা তাদের বিমানগুলোতে সিগনেচার রিডাকশনের মাত্রা কমিয়ে আনা হবে। সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হবে। অনেক বেশি শক্তি ধারণ ও প্রয়োগ করা সম্ভব হবে। এছাড়া এ বিমানগুলোর সিস্টেম, নির্মাণ কাঠামো এবং গতিমাত্রা- সবকিছুই বিদ্যমান যেকোনো বিমানের চেয়ে অনেকটাই বেশি ও উন্নত হবে।

চীন তার নির্মিতব্য ষষ্ঠ প্রজন্মের বিমান দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বিমানভিত্তিক শক্তির ব্যবধান কমিয়ে আনতে চায়। এখন পর্যন্ত দুই দেশের যে পরিকল্পনা জানা গেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের এনজিএডি বিমান অপারেশনে আসার মাস খানেকের মধ্যে চীনের এনজিএডি বিমানগুলোও অপারেশনে চলে আসবে।

বর্তমানে আমেরিকার থেকে আকাশ প্রতিরক্ষায় একটু পিছিয়ে থাকায় সেই ব্যবধান কমানোর জন্য চীন যেভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে, বিপুল অর্থ ব্যয় করছে, সেই তুলনায় মার্কিন বিমানবাহিনীর আধুনিকায়ন কার্যক্রমকে অনেকটা ধীর বলা যায়। জে-টোয়েন্টি দিয়ে চীন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় এরই মধ্যে সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। চীনের জে-টোয়েন্টিকে ষষ্ঠ প্রজন্মের বিমানের ভিত্তি বা প্রাথমিক সংস্করণই বলা যায়। অল্প কিছু উন্নত, দেশীয় ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও সমরাস্ত্র সন্নিবেশ করতে পারলেই এই বিমানটিও ষষ্ঠ প্রজন্মের বিমানে পরিণত হবে।