পুরোনো খেলায় নেমে বিপাকে আর্মেনিয়া

- সংগৃহীত

  • হায়দার সাইফ
  • ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৪:১১

আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে নাগর্নো-কারাবাখ। আজারবাইজানের অভিযানে পরাজিত হয়েছে আর্মেনীয় বিদ্রোহীরা। মাইন দুর্ঘটনায় ছয় ব্যক্তি নিহত হওয়ার পর আজারবাইজান সেখানে সামরিক অভিযান শুরু করে। বাকু জানিয়েছে, সন্ত্রাস দমনের জন্য তারা এই অভিযানে নেমেছে। ওই এলাকা থেকে আর্মেনীয় বাহিনী পুরোপুরি সরে না গেলে তারা অভিযান থামাবে না। এদিকে, আর্মেনিয়া বলছে, ওই এলাকায় তাদের কোনো বাহিনী নেই। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেখানে হস্তক্ষেপের জন্য তারা রাশিয়ান শান্তিরক্ষীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। রাশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘ এই ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছে। অবিলম্বে সামরিক তৎপরতা বন্ধের জন্য তারা আজারবাইজানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, পরিস্থিতি এখনই নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে দুই দেশ আবারও বড় ধরনের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে।

নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চল থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া এলাকায় সামরিক অভিযান শুরু করে আজারবাইজান। এই অভিযানকে তারা বলছে সন্ত্রাস-বিরোধী অভিযান। বিতর্কিত এই অঞ্চলে শান্তির জন্য তারা শর্তও দিয়েছে। শর্ত হলো- জাতিগত আর্মেনীয় বাহিনীকে সেখান থেকে পুরোপুরি সরে যেতে হবে। শেষ পর্যন্ত তারা অভিযানে সফল হয়। আত্মসমর্পণ করে আর্মেনিয়া সরকারের সমর্থনপুষ্ট বিদ্রোহীরা। যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে বাধ্য হয় আর্মেনিয়া। অপরদিকে এর প্রতিবাদে আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশিনিয়ানের পদত্যাগ দাবিতে বিক্ষোভ করছে আর্মেনীয়রা।

আর্মেনিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অভিযোগ করেছে, আজারবাইজান স্থানীয় বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে পুরোদমে আগ্রাসন চালাচ্ছে। যে এলাকায় অভিযান চলছে, সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ জাতিগত আর্মেনীয়। মন্ত্রণালয় রাশিয়ান শান্তিরক্ষী সেনাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, যাতে তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে হস্তক্ষেপ করে।

কিন্তু হঠাৎ করে এই অভিযান শুরু হলো কেন? আজারবাইজানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এর আগে জানানো হয়, আজেরি খোজাবেন্দ জেলাতে দুটো দুর্ঘটনায় অন্তত ছয়জন নিহত হয়েছে। আর্মেনীয় নিরাপত্তা বাহিনীর পেতে রাখা স্থলমাইন বিস্ফোরিত হয়ে ওই দুর্ঘটনা ঘটে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই বিবৃতির কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বাকু জানায়, তারা সন্ত্রাস-বিরোধী অভিযান শুরু করেছে। কিন্তু আর্মেনিয়া বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরেই অভিযোগ করে আসছিল যে, আজারবাইজান তাদের সেনা শক্তি বাড়াচ্ছে। নাগর্নো-কারাবাখে যাওয়ার যে একমাত্র স্থল করিডোর, সেটাও আজারবাইজান বন্ধ করে দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছিল তারা।

আর্মেনিয়া দাবি করেছে, নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চলে বেশ কয়েক মাস ধরে যে মানবিক সংকট চলছে, তার জন্য দায়ী মূলত আজারবাইজান। গত বছর বাকু আর্মেনিয়া থেকে ওই অঞ্চলে যাওয়ার একমাত্র সংযোগ সড়কটি বন্ধ করে দিয়েছিল। লাচিন করিডোর নামে পরিচিত এই সংযোগ সড়কটির দেখাশোনা করে মূলত রাশিয়ার শান্তিরক্ষী সেনারা।

আর্মেনিয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে আজারবাইজান বলছে, মানবিক ত্রাণ সহায়তা ভর্তি করে ট্রাক গেছে নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চলে। আর্মেনীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং কেন্দ্রীয় সরকার এর আগে সমঝোতায় পৌঁছায়। সমঝোতা অনুযায়ী নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চলের সাথে দুই দেশের সংযোগ স্থাপনকারী সড়ক তারা ব্যবহার করবে।

আজারবাইজানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ঘোষণা দেয়, কারাবাখ অঞ্চলে আজারবাইজানের সশস্ত্র বাহিনী স্থানীয় সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে। ওই বিবৃতিতে জানানো হয়, অভিযানের অংশ হিসেবে, শুধুমাত্র বৈধ সামরিক স্থাপনা এবং অবকাঠামোকে টার্গেট করা হয়েছে। টার্গেটের বাইরে যাতে কারো ক্ষতি না হয়, সে জন্য অভিযানে নিখুঁত আঘাত হানতে সক্ষম অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। মন্ত্রণালয় আরও বলেছে, বেসামরিক নাগরিকরা যাতে নিরাপদে সরে যেতে পারে, সে জন্য তারা মানবিক করিডোরও খোলা রেখেছে।

এদিকে, আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশিনিয়ান রাশিয়া ও জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে লড়াই বন্ধে তারা দ্রুত হস্তক্ষেপ গ্রহণ করে। নাগর্নো-কারাবাখের ঘটনা প্রবাহের ওপর গভীর নজর রেখেছেন আল জাজিরার রবিন ফরেস্টিয়ার-ওয়াকার। তিনি বলেছেন, ওই অঞ্চলের ভেতরের বিভিন্ন সূত্র থেকে তিনি জানতে পেরেছেন, সেখানে বড় ধরনের অভিযান চলছে। হামলায় রকেট ও শেল ব্যবহার করা হচ্ছে। অন্যদিকে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেসব ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে, সেখানে ছোট অস্ত্র ব্যবহারের শব্দ পাওয়া গেছে।

আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা হিকমাত হাজিয়েভ রয়টার্সকে বলেছেন, আজারবাইজানের বাহিনী নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় আর্মেনীয় বাহিনীর যোগাযোগের মাধ্যমগুলো বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। কৌশলগত লক্ষ্য হাসিলের জন্য আজারবাইজানের বাহিনী বদ্ধপরিকর বলেও জানান তিনি।

আর্মেনিয়া অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তারা বলেছে, ওই এলাকায় তাদের কোনো বাহিনী নেই। তবে, অনেক আর্মেনীয় অতীতে নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চলে যুদ্ধের জন্য স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে অংশ নিয়েছে।

কিন্তু এই অভিযানের পরিণতি কী হতে পারে? মস্কো থেকে সাংবাদিক ইউলিয়া শাপোভালোভা বলেছেন, যে অভিযান শুরু হয়েছে, তা আরও অবনতির দিকে যেতে পারে। দুই দেশের মধ্যে আরেকটা নতুন যুদ্ধ লেগে যেতে পারে। তিনি জানান, আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী পাশিনিয়ান বলছেন, আজারবাইজান আর্মেনিয়াকে আরেকটি যুদ্ধের মধ্যে টেনে আনতে চাচ্ছে। কিন্তু আর্মেনিয়া কোনো সামরিক সঙ্ঘাতে জড়াবে না। শাপোভালোভা আরও জানান, বাকু বলেছে, শান্তির একমাত্র পথ হলো আর্মেনিয়াকে ওই এলাকা থেকে তাদের সেনা পুরোপুরি সরিয়ে নিতে হবে। কিন্তু আর্মেনিয়া এই শর্ত মানতে অস্বীকার করেছে।

আলজাজিরার ফরেস্টিয়ার-ওয়াকার বলেছেন, অনেকের মধ্যেই তীব্র আশঙ্কা জন্মেছে, আজারবাইজানের যে অভিযান শুরু হয়েছে, সেটা শেষ পর্যন্ত দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বড় আকারের যুদ্ধে রূপ নিতে পারে। তিনি বলেন, নাগর্নো-কারাবাখের অধিবাসীরা বেশ অনেক মাস ধরেই নানা দুর্ভোগের ভিতরে বাস করছে। আর্মেনিয়া থেকে কারাবাখের যে সরবরাহ ব্যবস্থা, তা বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে।

পরিস্থিতি সম্প্রতি বদলাতে শুরু করেছে। আজারবাইজান কর্তৃপক্ষ আজেরি এলাকা দিয়ে কারাবাখে কিছু ত্রাণ দিতে পেরেছে। কিন্তু আর্মেনিয়া থেকে কারাবাখের সাথে যোগাযোগের যে পথ, তার ওপর তারা চাপ জারি রেখেছে। কারণ আজেরি কর্তৃপক্ষ অনেক দিন ধরেই অভিযোগ করে আসছে যে, এই সংযোগ পথে আগ্নেয়াস্ত্র আর মাইন কারাবাখ অঞ্চলের ভেতরে পাচার করা হচ্ছে। এই অঞ্চলটি এখনও জাতিগত আর্মেনীয়দের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, এবং আর্মেনিয়া তাদেরকে অস্ত্র ও মাইন দিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

বিতর্কিত এলাকায় হঠাৎ সহিংসতা বেড়ে যাওয়ায় রাশিয়া গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভার বরাত দিয়ে এই তথ্য জানিয়েছে বার্তা সংস্থা তাস। জাখারোভা জানান, সামরিক অভিযান শুরুর মাত্র কয়েক মিনিট আগে আজারবাইজান রাশিয়ান শান্তিরক্ষীদেরকে অভিযান সম্পর্কে সতর্ক করে।

জাতিসংঘের মুখপাত্র স্টিফানে দুজারিকও এই ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছেন। তিনি বলেন, সব ধরনের সহিংস কর্মকাণ্ড এখনই বন্ধ হওয়াটা জরুরি। সহিংসতা এড়ানোর জন্য দুই পক্ষকেই অভিযান বন্ধ করে সংলাপে ফিরতে হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন নাগর্নো-কারাবাখে সামরিক অভিযানের নিন্দা জানিয়েছে। আজারবাইজানকে তারা সামরিক তৎপরতা বন্ধ করতে বলেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান জোসেফ বোরেল এক বিবৃতিতে এই আহ্বান জানিয়েছেন।

জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্নালেনা বায়েরবোক বলেছেন, নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চলে সামরিক অভিযান চালিয়ে আজারবাইজান তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে। অন্যদিকে, সংকট অবসানের জন্য জরুরি ভিত্তিতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডাকার আহ্বান জানিয়েছে প্যারিস।

যুক্তরাষ্ট্রের এক কর্মকর্তা বলেছেন, আজারবাইজানের অভিযান বন্ধ করার জন্য মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন সব পক্ষের সাথে জরুরি বৈঠকে বসবেন। ওই কর্মকর্তা বলেন, কারাবাখে ত্রাণ পাঠানোর জন্য রাস্তা খুলে দেওয়ার পর আমরা আশাবাদী হয়েছিলাম যে, সেখানে দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের একটা উপায় হয়তো বের হবে। কিন্তু পরিস্থিতির সেখানে আরও অবনতি হয়েছে।

তিন বছর আগে নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চল নিয়ে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান যুদ্ধে জড়িয়েছিল। যুদ্ধ দীর্ঘ না হলেও এর তীব্রতা ছিল ভয়াবহ। ওই যুদ্ধে ছয় হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়।

ককেশাস অঞ্চলের দুই দেশ আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া দুটোই এক সময় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল। দুই দেশের মধ্যে কয়েক দশক ধরে বিবাদ চলে আসছে। ১৯৯০ এর দশক ও ২০২০ সালে দুই পক্ষ বড় ধরনের সঙ্ঘাতেও জড়িয়েছিল।

নাগার্নো-কারাবাখ অঞ্চলকে কেন্দ্র করে সবশেষ ২০২০ সালে বড় ধরনের যুদ্ধ হয়। ওই যুদ্ধ ছয় সপ্তাহ স্থায়ী হয়েছিল। রাশিয়ার মধ্যস্থতায় শেষে দুই পক্ষের মধ্যে চুক্তি হয়। ওই চুক্তির মাধ্যমে দখলকৃত কিছু ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিতে হয়েছিল আর্মেনিয়াকে। ১৯৯০-এর দশক থেকে ওই এলাকার নিয়ন্ত্রণ ছিল আর্মেনিয়ার কাছে।

ওই সময় থেকেই দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা চলে আসছে। এখন পর্যন্ত তারা স্থায়ী কোনো শান্তি প্রক্রিয়ার মধ্যে যেতে পারেনি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতা চেষ্টার পরও কোনো লাভ হয়নি।