কম দামে বানানো হচ্ছে ভয়াবহ সমরাস্ত্র

- সংগৃহীত

  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ২১ অক্টোবর ২০২৩, ১৭:২২

গত জুলাই মাসে গুগলের সাবেক প্রধান এরিক শ্মিডট ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে লেখা এক প্রবন্ধে চলমান রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইউক্রেনের ছোট, ইম্প্রোভাইজড কামিকাজে ড্রোন ব্যবহারের প্রশংসা করেছেন। আগামী দিনের যুদ্ধের ধরন নিয়েও তিনি বেশ কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। এরিক সামরিক জগতের কোনো মানুষ নন। বরং একেবারেই প্রযুক্তি জগতের মানুষ। এরিকের মতো মানুষের কাছে সিলিকন ভ্যালি, রকেট জ্বালানি বা টেকনোলোজিই শেষ কথা। অথচ তিনি তার লেখায় আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, এই কামিকাজ ড্রোনগুলোই হয়তো আগামীতে অনেক বড়ো সব অস্ত্রের জায়গা নিয়ে নেবে।

আগামী দিনের যুদ্ধে ড্রোন নিয়ে আশাবাদী হওয়ার কারণ আছে। ড্রোন হলো এমন একটি অস্ত্র, যা অতি অল্প খরচে তৈরি করা যায় আর ড্রোন দিয়ে প্রতিপক্ষের টার্গেটেও নিখুঁতভাবে হামলা করা সম্ভব। একসাথে অনেকগুলো ড্রোন মোতায়েন করা যায়। মর্টারের চেয়েও ড্রোন সস্তা এবং কামানের গুলির চেয়েও এর টার্গেট যথাযথ হয়। একেকটি কামিকাজে ড্রোন তৈরি করতে ৪০০ ডলারের মতো খরচ পড়ে এবং প্রতিটি ড্রোন ৩ পাউন্ডের বেশি বিস্ফোরক বহন করতে পারে। এরিক এমন একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িয়ে আছেন, যারা ইউক্রেনের ড্রোন নির্মাণ প্রকল্পের জন্য ১০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে। গত তিন দশক জুড়েই বৈশ্বিক সামরিক খাতে নানা ধরনের বিবর্তন ঘটে যাচ্ছে। তবে সর্বশেষ কোন ধরনের সমরাস্ত্র বাজারে আসতে যাচ্ছে, তা নিয়ে সমর বিশেষজ্ঞরাও যেন এক ধরনের লুকোচুরির আশ্রয় নিচ্ছেন।

কামিকাজে ড্রোনের বিষয়ে এরিকের মন্তব্য অনেকটাই যথার্থ। সাধারণত রেসিং ড্রোনের নানা যন্ত্রাংশ সংযোজন করেই কামিকাজে তৈরি করা হয়। এর ব্যয় ৪০০ থেকে ৭০০ ডলারও হতে পারে। এর সাথে শক্তিশালী মোটর সংযুক্ত থাকায় ড্রোনগুলো মোডিফাইড পিজি সেভেন ভি বা আরকেজি থ্রি অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক হ্যান্ড গ্রেনেড বহন করতে পারে। আবার কোনো কোনো ড্রোন সর্বোচ্চ ৫ কেজি ওজনের পেলোডও বহন করতে পারে। এই ড্রোনগুলো পরিস্থিতি ভেদে ৬ মাইল দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে।

ইউক্রেনের এসকাড্রোন নামক কোম্পানি জানিয়েছে, তারা এমন কিছু ড্রোনও বানাতে পেরেছে যা ৮ মাইল দূর থেকে গিয়েও টার্গেটে হামলা চালাতে পেরেছে। এই ড্রোনগুলোর নির্মাণ খরচ মর্টার বোমার চেয়েও কম। মার্কিন সামরিক বাহিনী একেবারেই প্রাথমিক স্তরে যে এইটি ওয়ান এমএম মর্টার ব্যবহার করে তার নির্মাণ-ব্যয়ও ৬৩৫ ডলারের কম নয়। আর যদি ভালোমানের তথা এমএইট টুয়েন্টি ওয়ান মর্টার হয় তাহলে তার নির্মাণ খরচ ১ হাজার ডলারও পার হয়ে যায়।

এফপিভি ড্রোনগুলো ঘরোয়াভাবে নির্মিত। কিন্তু সামরিক বাহিনী যেসব অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক মিউনিশন ব্যবহার করে, সেগুলোর নির্মাণে দেড় লাখ ডলারেরও বেশি ব্যয় হতে পারে। এসব ড্রোন সাধারণত ট্যাঙ্ক এবং অন্যান্য সমরযান ধ্বংসে ব্যবহৃত হয়। এফপিভি ড্রোন যেহেতু সস্তা তাই ট্রাক, ভ্যান এমনকি এককভাবে একজন সৈন্যের ওপর হামলা চালাতেও এ ড্রোনগুলো ব্যবহৃত হয়। এফপিভি ড্রোনগুলোতেও প্রথাগত কিছু অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক গাইডেড মিসাইল থাকে। বেশ দূরত্ব থেকেও এই ড্রোনগুলো সঠিকভাবে টার্গেটে আঘাত হানতে পারে।

এফপিভি ড্রোনের আরো দুটো বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। এগুলো দ্রুতবেগে চলন্ত টার্গেটে হামলা করতে পারে। আর নিজেকে অনেকটা আবৃত রেখেও এই ড্রোনগুলো তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে। বিভিন্ন ভবনের আড়ালে থেকে কিংবা ব্রিজের নিচে টানেলের ভেতর আশ্রয় নিয়েও এই ড্রোনগুলো নিজেকে লুকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়। জাভেলিন ড্রোন অনেক ব্যয়বহুল। এই ড্রোনগুলো ১৯ পাউন্ড ওয়ারহেড বহন করতে পারে। সেই অনুযায়ী এফপিভিকে গরিবের জাভেলিনও বলা যায়, কারণ এ ড্রোনগুলো অনায়াসে ৪ পাউন্ড ওয়ারহেড বহন করে।

আগামী দিনের যুদ্ধে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল বাহিনী অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক মিউনিশন ব্যবহার কমিয়ে এনে বরং বাড়তি মাত্রায় এফপিভি ব্যবহারের দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে। এখনো পর্যন্ত এফপিভি ড্রোনের হিট রেইট অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক মিউনিশনের তুলনায় কিছুটা কম। তবে একই খরচে অনেক বেশি এফপিভি ব্যবহার করা যায় ফলে এই ঘাটতি সহজেই পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব।

অল্প সংখ্যক অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক মিউনিশন ব্যবহার করে একটি বাহিনী প্রতিপক্ষের সমরযান ধ্বংস করতে পারে তার তুলনায় বেশি এফপিভি ড্রোন ব্যবহার করে সফলতা পাওয়া যায়। ইউক্রেন সেনাবাহিনী তো বটেই, মার্কিন সেনাবাহিনীও এখন কম উচ্চতায় উড়তে পারে ও প্রতিপক্ষের ওপর হামলা চালাতে পারে এমন সমরাস্ত্র নির্মাণে আগ্রহী।

এরিকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যয়বহুল অস্ত্রের পরিবর্তে আরও বেশি সংখ্যক সস্তা অস্ত্রের ব্যবহার অনেক বেশি কার্যকর হয়ে উঠতে পারে। এমনকি আর্টিলারি অস্ত্রের প্রতিস্থাপন হিসেবেও এফপিভি কাজ করতে পারে। এর আগে প্রথাগত অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক অস্ত্রকে হটিয়ে দিয়ে অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক মিউনিশন যেমন জায়গা করে নিয়েছিল তেমনি এফপিভিও হয়তো অন্যান্য আর্টিলারিকে প্রতিস্থাপন করতে পারে। এক্ষেত্রে এয়ার পাওয়ারের সাথেও সামঞ্জস্য রাখার সুযোগ অছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিক থেকে, ভারী বোমারু বিমানের জন্য আদর্শ আক্রমণ পদ্ধতি ছিল কার্পেট বোমাবর্ষণ। কারণ ভারি বোমারুগুলো পয়েন্ট টাগের্টেও লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করার জন্য সঠিক ছিল না। ভারি বোমারু দিয়ে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত নিশ্চিত করার জন্য পুরো এলাকায় উচ্চমানের বিস্ফোরক পাঠানো জরুরি ছিল। এই পদ্ধতিতে কেবলমাত্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হাজার হাজার বোমা হামলাই করা হয়নি বরং পরবর্তীতে ভিয়েতনামে ‘আর্ক লাইট’ অভিযানেও এই পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়।

বি-ফিফটি বিমানগুলো এখনো সেবা দিয়ে যাচ্ছে। এই বিমানগুলো এখন থার্টি টু জিবিইউ থার্টি নাইন আকৃতির শেল বহন করে। কার্পেট বোমা বিস্ফোরণে যে কোনো লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার সম্ভাবনা যতটা কম, প্রিসিশন পদ্ধতির বোমা হামলায় সেই সম্ভাবনা ততটাই বেশি। বিটু বিমানগুলো এ ধরনের ১৯২টি অস্ত্র বহন করতে পারে। কার্পেট পদ্ধতির বোমা বিস্ফোরণের জন্য যেখানে প্রতিটি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার জন্য শত শত বোমার প্রয়োজন হয়, তা যে কোনো বাহিনীর জন্যই ভোগান্তির ও অনেক বেশি ব্যয়সাপেক্ষ।

ইউক্রেন রাশিয়া-বিরোধী যুদ্ধে এখনও পুরানো সোভিয়েত যুগের আর্টিলারি ফায়ারিং টেবিল ব্যবহার করে। এই পদ্ধতিতে শত্রুপক্ষের স্ব-চালিত আর্টিলারির একটি ব্যাটারি মোকাবিলার জন্য ৪৫০টি ১২২ মিলিমিটার শেলের প্রয়োজন হয়। আর সেক্ষেত্রে অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক মিউনিশন পদ্ধতিতে ১০০ রাউন্ড হলেই হয়ে যায়।

মার্কিন সেনাবাহিনীতে এরই মধ্যে আর্টিলারির সেকেলে পদ্ধতিগুলো স্থগিত করেছে। এক্ষেত্রে তারা এখন এইম নাইন এইটিটু এক্স ক্যালিবার গাইডেড ওয়ান ফিফটি ফাইভ এমএম আর্টিলারি রাউন্ড এবং হিমার্স থেকে নিক্ষেপ করা গাইডেড রকেটের ওপরই বেশি আস্থা রাখছে।

এই সিস্টেমগুলো স্যাটেলাইট নির্দেশনার আলোকে পরিচালিত হয় এবং খুবই আস্থার সাথে টার্গেটের কয়েক মিটারের মধ্যে চূড়ান্ত আঘাত করতে সক্ষম। এই প্রিসিশন স্ট্রাইকগুলো পরিচালনা করা খুবই ব্যয়বহুল আর তাই এগুলোর সরবরাহও কম থাকে।

একটি আনগাইডেড ওয়ান ফিফটি ফাইভ এমএম রাউন্ডের দাম কয়েক হাজার ডলার বা তারও বেশি। অন্যদিকে, একটি এক্সক্যালিবার রাউন্ডের দাম আট হাজার ৭০০ ডলারেরও বেশি।

সস্তা এফপিভি ড্রোনের দাম একটি আর্টিলারি শেল থেকে খুব বেশি নয়। এগুলোর কার্যকারিতাও এক্সক্যালিবার থেকে একদমই ভিন্ন। এটিকে টার্গেট একদম যথাযথভাবে দেখিয়ে দেওয়া যায়। এফপিভিতে ক্যামেরাও সংযুক্ত আছে, যার মাধ্যমে অপারেটর বর্তমান অবস্থান নিজেই দেখতে পারে। তাই টার্গেট চলন্ত হলেও এফপিভি ড্রোনের মাধ্যমে ভালোভাবেই তা শনাক্ত করা যায়। ওয়ান ফিফটি ফাইভ এমএম শেল সস্তা হলেও যে প্যালাডিন ব্যবহার করে শেলগুলো নিক্ষেপ করা হয় তার দাম বর্তমানে প্রায় ১৪ মিলিয়ন ডলার। কোনো সেনাবাহিনী যদি এই ব্যয়বহুল প্যালাডিন ব্যবহারে সক্ষম না হয় তাহলেও তারা সহজেই কয়েক হাজার এফপিভির ব্যয় বহন করতে পারে।

শত্রুর অবস্থান সঠিকভাবে জানা না গেলে তাদেরকে দমিয়ে রাখার জন্য সাধারণ সব অঞ্চলে একটানা আর্টিলারি দিয়ে গুলি চালিয়ে যাওয়া হয়। অন্যদিকে, এফপিভি বা ফার্স্ট পারসন ভিউ ড্রোনগুলো নিজস্ব রিকনেসান্স চালাতে পারে। প্রতিপক্ষের আনুমানিক অবস্থান জানা থাকলে, এফপিভি শত্রু অবস্থান শনাক্ত করতে পারে এবং সম্ভাব্য এলাকায় উপরে, নিচে, ডানে ও বায়ে উড়ে তা ধ্বংস করতে পারে।

ইউক্রেন থেকে এমন তথ্য পাওয়া গেছে, এফপিভি উড্ডয়নের সময় যে আওয়াজ হয় তা প্রতিপক্ষের সেনাদের ওপর মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব ফেলে। যার পরিণতিতে, সেনারা যুদ্ধ থামিয়ে অসাড় হয়ে যায়। তারা গুলি করাও বন্ধ করে দেয় যাতে তাদেরকে সহজে শনাক্ত করা না যায়।

বর্তমান এফপিভিগুলোর সংক্ষিপ্ত ভার্সন রয়েছে, যা ১৫৫ মিলিমিটার শেল থেকেও ছোট পেলোড বহন করে। এগুলো ১০০ পাউন্ড ওয়ারহেডসহ ২৩ মাইল পর্যন্ত পথ পাড়ি দিতে পারে। এফপিভিতে যখন ফিক্সড উইংস সংযুক্ত করা হয়, তখন রাশিয়ার ল্যানসেটের মতো সমরযানও ঝুঁকিতে পড়ে যায়।

এফপিভি ওয়ারহেড ট্যাঙ্ক, কর্মী বাহক এবং স্ব-চালিত বন্দুক থেকে সেনাদের নিরাপত্তা দেয় এবং তাদেরকে আর্টিলারি লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছাতে সহায়তা করে। এফপিভির সফল হওয়ার কারণ এর সূক্ষ্মতা। একদম পরিখার ভেতরে কিংবা বাঙ্কারে উড়ে যাওয়ার ক্ষমতাও এফপিভির আছে।

আটিলারি তার প্রথাগত পন্থায় যেখানে প্রত্যাশিত সফলতা নিশ্চিত করতে পারছে না, সেখানে এফপিভির মতো স্বল্পদামের ড্রোনগুলোর নানামুখী সফলতা ভিন্নভাবে ভাবতে বাধ্য করছে। তাই আগামী দিনগুলোতে আর্টিলারির অনেক ফাংশন যে এফপিভি বা ছোট আকৃতির ড্রোনগুলো নিয়ে নেবে, তা এখন অনেকটা নিশ্চিত করেই বলা যায়।