গাজায় চলছে ইসরায়েলের অস্ত্র পরীক্ষা

- সংগৃহীত

  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ১৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৪:৫৮

ইসরায়েলের অস্ত্রভান্ডার ও সমরাস্ত্র সক্ষমতা নিয়ে ব্যাপক গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়। পৃথিবীর অনেক দেশের সমরাস্ত্র লেনদেন বা কেনাবেচার তথ্য প্রকাশ্য থাকলেও ইসরায়েল এক্ষেত্রে অস্বাভাবিক ধরনের গোপনীয়তা বজায় রাখে। ইসরায়েলের কাছে কী পরিমাণ অস্ত্র রয়েছে কিংবা কার কাছে তারা কোন অস্ত্র কী পরিমাণে বিক্রি করেছে, তার কোনো তথ্য সামরিক বিশেষজ্ঞদের হাতে নেই। ২০১৯ সালে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, ইসরায়েল কার কাছে অস্ত্র বিক্রি করেছে তার কোনো নথি নেই। কারা এগুলো বানিয়েছে আর কোথায় এগুলো গিয়েছে তাও অজানা। অ্যামনেস্টির মতে অস্ত্র নির্মাণ থেকে শুরু করে রফতানি পর্যন্ত গোটা প্রক্রিয়া অনেকগুলো ধাপ পার করে হওয়ার কারণেই এই প্রক্রিয়া আড়াল করা সম্ভব হয়।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গত ২২ অক্টোবর একটি ফুটেজ প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর মাগলান কমান্ডো গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে ১২০ মিলিমিটারের প্রিসিশন গাইডেড মর্টার বোমা স্থাপন করছে। এ বোমাটি নির্মাণ করেছে এলবিত সিস্টেম নামে হাইফার একটি প্রতিষ্ঠান। কোম্পানিটি ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সাথে মিলে কাজ করছে ২০২১ সাল থেকে। তখন থেকেই তাদের ওয়েবসাইটে এই বোমার গুণাগুণ বর্ণনা করে আসছে। সেই সময়ে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছিলেন বেনি গান্তজ। তিনি এখনও নেতানিয়াহুর যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার একজন সদস্য।

বেনি গান্তজ আয়রন স্টিং নামে নতুন সামরিক প্রযুক্তির প্রশংসা করতে গিয়ে বলেছিলেন, এর মাধ্যমে উন্মুক্ত পরিসরে এবং শহুরে যুদ্ধে প্রতিপক্ষকে সঠিকভাবে টার্গেট করে হামলা চালানো সম্ভব হবে। এতে বেসামরিক ক্ষয়ক্ষতিও কমিয়ে নিয়ে আসা সম্ভব হবে বলে তিনি দাবি করেছিলেন। কিন্তু এগুলো যে সত্যের অপলাপ, তা এখন স্পষ্ট। আয়রন স্টিং—এর মতো যে কোনো সমরাস্ত্র কতটা কার্যকর, তা ইসরায়েল যাচাই করে ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্বিচারে হামলা চালানোর মাধ্যমে।

ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের এই অস্ত্র নিরীক্ষার কৌশল নতুন কিছু নয়। ২০১৪ সালে গাজার তৃতীয় যুদ্ধের সময় ইসরায়েলি সেনারা একটি বেসামরিক ট্যাক্সির ওপর স্পাইক ড্রোন নামক একটি ড্রোন নিক্ষেপ করে। এতে ট্যাক্সিটি ধ্বংস হয় এবং ভেতরে থাকা ৬ জন বেসামরিক যাত্রী নিহত হয়। এই স্পাইক ড্রোনটি কয়েক হাজার কিউব বহন করতে পারে, যা বিস্ফোরণের আশপাশের ২০ মিটার দূরত্বে থাকা যে কোনো ব্যক্তিকে আঘাত করতে সক্ষম। যদি কেউ এই ড্রোন হামলা থেকে বেঁচেও যায় তারপরও কিউব বিস্ফোরণের কারণে তার শরীরের নানা অঙ্গ পুড়ে যাবে। ২০১৪ সালে ইসরায়েল এই ড্রোন দিয়ে গাজার ওপর বেশ কয়েকটি অভিযান চালানোর পর বিভিন্ন দেশে তা প্রচার করা হয়। এরপর বেশ কয়েকটি দেশ ইসরায়েল থেকে এই ড্রোন সংগ্রহ করে।

ইসরায়েলি আরেকটি ড্রোন হলো এইতান। এগুলো মনুষ্যবিহীন আকাশ যান। ২০০৭ সাল থেকে এই ড্রোন সার্ভিসে আসে। এটি নির্মাণ করে ইসরায়েলি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ইসরায়েল অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্টি্রজ। এ ড্রোনগুলো একটানা ৪০ ঘণ্টা আকাশে উড়তে পারে। একসাথে চারটি স্পাইক মিসাইল বহন করতে পারে। ২০০৮—৯ সালে গাজায় অপারেশন কাস্ট লিড নামের যুদ্ধে এইতান ড্রোন প্রথম ব্যবহার করে ইসরায়েল। এ যুদ্ধে ৩৫৩ জন শিশু নিহত হয় এবং আহত হয় আরও ৮৬০ জন। ৩৫৩ শিশুর মধ্যে ১১৬ জন মারা যায় এইতান ড্রোনের মিসাইলের আঘাতে। এই যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ২০০৮ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে অন্তত ১০টি দেশ এইতান ড্রোন কেনার জন্য ইসরায়েলের কাছে অর্ডার দেয়।

ইসরায়েলের সমরাস্ত্রের সবচেয়ে বড় ক্রেতা ভারত। দেশটি ২০০৮ থেকে ২০১১— এই তিন বছরে ইসরায়েল থেকে ১০০টি মনুষ্যবিহীন ড্রোন কেনে। এরমধ্যে ৩৪টি এইরাত হিরন ড্রোন। ফ্রান্স কেনে ২৪টি। ব্রাজিল ১৪টি আর অস্টে্রালিয়া ১০টি।

ইসরায়েল গাজার বিরুদ্ধে পরিচালিত প্রতিটি যুদ্ধকে তাদের অস্ত্র বিক্রির মার্কেট হিসেবে ব্যবহার করেছে। গাজায় তারা নজরদারি ও আক্রমণের জন্য যে অস্ত্র ও সিস্টেম ব্যবহার করে, সেগুলো পরে অনেক দেশ কেনার জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠে। অস্ত্র বিক্রি করে ইসরায়েল বিপুল অর্থ উপার্জন করে।

ইসরায়েলের এই অস্ত্র কেনাবেচার বড়ো উদ্দেশ্য হলো, ফিলিস্তিনিদের বিষয়ে বিভিন্ন দেশকে ক্ষেপিয়ে তোলা এবং নিজেদের দখলদারিত্বের যে নেতিবাচক ভাবমূর্তি তাতে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করা। এর মাধ্যমে ইসরায়েল রাষ্ট্র হিসেবে তার বৈধ অবস্থান আরো বেশি শক্তিশালী করতে চাইছে।

অনেক সময় ইসরায়েল অস্ত্র কেনাবেচাকে চাপ তৈরির কৌশল হিসেবেও ব্যবহার করে। কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট গুসতাভো পেট্রো হামাসের ৭ অক্টোবরের হামলাকে সন্ত্রাসী অভিযান বলতে অস্বীকার করায় এবং গাজায় ইসরায়েলের শিশুহত্যার নিন্দা করায় ইসরায়েল কলম্বিয়ায় সব ধরনের অস্ত্র ও নিরাপত্তা প্রযুক্তি বিক্রি স্থগিত করেছে। কলম্বিয়া হলো ১০টি দেশের অন্যতম, যারা নিয়মিতভাবে ইসরায়েল থেকে সমরাস্ত্র সংগ্রহ করে।

ইসরায়েল এ মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সামরিক ড্রোন বিক্রিকারী দেশ। ২০১৭ সালের পরিসংখ্যান বলছে, গোটা বিশে^ যত সামরিক ড্রোন রফতানি করা হয়েছে তার দুই তৃতীয়াংশই করেছে ইসরায়েল। আয়রন স্টিং—এর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এলবিত ভূমিতে ব্যবহারযোগ্য সমরাস্ত্রের ৮৫ শতাংশ এবং ইসরায়েলের মোট ব্যবহারকারী ড্রোনের ৮৫ শতাংশ তৈরি করে থাকে। ২০১৪ সালের গাজা যুদ্ধের পর থেকে ইসরায়েলের অস্ত্র রফতানির হার আরও বেড়ে যায়।

২০১৪ সালের যুদ্ধে হারমেস ফোর ফিফটি এবং হারমেস নাইন হান্ডে্রড ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। সে সময় যুদ্ধের ৩৭ শতাংশ হতাহতের ঘটনা ঘটেছিল এই ড্রোনের কারণে। সে যুদ্ধের পর এলবিত তার হারমেস নাইন হান্ডে্রড ড্রোন রফতানির জন্য ২০টি দেশের সাথে চুক্তি করেছিল। যার মধ্যে ছিল ফিলিপাইন, চিলি, কলম্বিয়া, আইসল্যান্ড, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আরও বেশ কিছু দেশ। ২০২৩ সালে এসেও এই ড্রোন রফতানি কার্যক্রম চলছে। জানা গেছে, চলতি বছরের মার্চ মাসে এলবিত তার হারমিস ড্রোনের ১২০ নম্বর অর্ডারটি সংশ্লিষ্ট দেশে পাঠিয়েছে।

এবারের গাজা যুদ্ধে ইসরায়েল যেসব ড্রোন ব্যবহার করছে তার অন্যতম হলো নিজোজ বা স্পার্ক নামে নজরদারি ড্রোন। এটি তৈরি করেছে ইসরায়েলের রাষ্ট্রীয় সমরাস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রাফায়েল। এই প্রতিষ্ঠানের কাছে এখনও পর্যন্ত ১০ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অস্ত্রের রফতানি অর্ডার পেন্ডিং অবস্থায় রয়েছে।

ইসরায়েলের আরেকটি অন্যায্য আচরণ হলো, তারা এখনও পর্যন্ত আর্মস ট্রেড চুক্তিতে সাক্ষর করেনি। এই চুক্তির একটি শর্ত হচ্ছে, অস্ত্র বিক্রির পর তা গণহত্যা বা মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনে ব্যবহৃত হতে পারে এমন শংকা থাকলে অস্ত্র বিক্রি করা যাবে না। ইসরায়েল এই শর্ত মানতে রাজি নয়।

এ কারণে বিতর্কিত অনেক শাসক ইসরায়েলের অস্ত্র সংগ্রহ করে নিজ দেশের জনগণের বিরুদ্ধে তা প্রয়োগ করে নিজেদের ক্ষমতায় থাকার মেয়াদ প্রলম্বিত করে। এর আগে ১৯৭৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী শাসকগোষ্ঠীকেও এ কারণে ইসরায়েল অস্ত্র সরবরাহ করেছিল। ১৯৮০ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত এল সালভেদরের গৃহযুদ্ধ চলাকালীন সময়েও ইসরায়েল শাসকগোষ্ঠীকে অস্ত্র দিয়েছিল। আর এ অস্ত্র ব্যবহার করেই সে সময়ে দেশটির ৭৫ হাজার বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করা হয়।

১৯৯৪ সালে ইসরায়েলের তৈরি বুলেট, রাইফেল আর গ্রেনেড ব্যবহার করে রুয়ান্ডায় গণহত্যা চালানো হয়েছিল। যাতে সব মিলিয়ে ৮ লাখের বেশি মানুষ নিহত হয়। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৫ সালে সার্বিয়ান আর্মিকেও ইসরায়েল সমরাস্ত্র প্রদান করে। যা দিয়ে অসংখ্য বসনিয়ান মুসলিমকে হত্যা করা হয়।

২০১৭ সালে আন্তর্জাতিকভাবে মিয়ানমারে সমরাস্ত্র বিক্রি বন্ধ করা হয়। তবে ইসরায়েলের হারেৎজ পত্রিকা জানিয়েছে, ২০২২ সাল পর্যন্ত ইসরায়েল গোপনে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা প্রশাসনকে অস্ত্র সরবরাহ করে এসেছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে ইসরায়েল আজারবাইজানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ড্রোন, মিসাইল এবং মর্টার রফতানি করে। আজারবাইজান নাগারনো—কারাবাখ যুদ্ধের সময়ও ইসরায়েল থেকে বিপুল অস্ত্র সংগ্রহ করে।

সরকারি পর্যায়ে যে অস্ত্র কেনাবেচা হয় তার বাইরেও ব্যক্তিগত বা বেসরকারি পর্যায়েও ইসরায়েল বিপুল পরিমাণে অস্ত্র বিক্রি করে থাকে। অবৈধ প্রক্রিয়ায় এ ধরনের অস্ত্র বিক্রির বিষয় অনেক ক্ষেত্রে অস্বীকার করে থাকে। যেসব রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান স্বৈরশাসনের কারণে আন্তর্জাতিকভাবে নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়েন তারাও অস্ত্র সংগ্রহের জন্য ইসরায়েলের ওপরই ভরসা রাখেন। স্বৈরশাসকদের অস্ত্র, ড্রোন ও নজরদারি যন্ত্রপাতি আমদানির নির্ভরযোগ্য দেশ হচ্ছে ইসরায়েল।

ফিলিপাইনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রডরিগো দুতার্তে ২০১৮ সালে সামরিক বাহিনীকে শুধুমাত্র ইসরায়েলের কাছ থেকেই অস্ত্র নিতে বলেছিলেন। কারণ, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। ইসরায়েল কখনও কোনো স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে শাস্তি বা নিষেধাজ্ঞা প্রদানে রাজি হয় না। এ কারণে বিশ্বজুড়ে সকল স্বৈরশাসকদেরই আস্থার জায়গা হলো ইসরায়েল।

এবার গাজায় ইসরায়েল যে নৃশংসতা চালাচ্ছে সেখানেও তারা নতুন অনেক অস্ত্রের পরীক্ষা করছে বলে আভাস পাওয়া গেছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আশরাফ আল কুদ্রা এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, তাদের মেডিকেল টিম গাজায় আহত ও নিহতদের শরীরের কিছু অংশ পোড়া অবস্থায় পেয়েছেন। এরা ইসরায়েলের যে বোমায় নিহত বা আহত হয়েছেন তা তাদের কাছে অজানা। এ রকম কোনো বোমা বা বোমার আঘাতজনিত শারীরিক প্রতিক্রিয়া তারা বিগত সময়ের কোনো যুদ্ধে দেখেননি।

গাজার আল—শিফা হাসপাতালের বার্ন এবং প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক ডা. আহমেদ আল মোখাল্লালাতি টরেন্টো স্টারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, এবার যারা আহত হচ্ছেন তাদের আঘাত বেশ গভীর। অনেকেই তৃতীয় বা চতুর্থ ডিগ্রির অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় তাদের কাছে আসছেন। অনেকের চামড়ায় টিস্যু ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছে। এগুলো ফসফরাসের কারণে হয়েছে কিনা তা এখনও বলা যাচ্ছে না।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এই বক্তব্যের কোনো প্রতিক্রিয়া ইসরায়েলের তরফ থেকে পাওয়া যায়নি। তবে এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়, ইসরায়েল এবারের যুদ্ধে আয়রন স্টিং ব্যবহার করেছে এবং স্পার্ক ড্রোনের নতুন সংস্করণও তারা গাজাবাসীর ওপর নিক্ষেপ করে থাকতে পারে।