বিশ্বসেরা যে ১০ যুদ্ধবিমান দুনিয়া কাঁপাচ্ছে

এফ-৩৫ লাইটনিং-২ - সংগৃহীত

  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ২৬ অক্টোবর ২০২৩, ১৫:০০

যুদ্ধবিমান যে-কোনো দেশের বিমানবাহিনীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কারণ, যুদ্ধবিমানগুলো অধিকাংশ সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, দ্রুত এবং শক্তিশালী সমরযান হিসেবে আবির্ভূত হয়। এখনও পর্যন্ত অনেক দেশই পুরনো এবং সস্তা মডেলের যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে। তবে যে-সব দেশের বিমানবাহিনী শক্তিশালী, তারা বরাবরই প্রতিপক্ষের তুলনায় এগিয়ে থাকার জন্য অত্যাধুনিক সামরিক সরঞ্জাম সংগ্রহ করার চেষ্টা করে।

বিশ্বসেরা যুদ্ধ বিমানের তালিকার শীর্ষে রয়েছে লকহিড মার্টিনের এফ থার্টি ফাইভ লাইটনিং টু নামের পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান। ২০০৬ সাল থেকে এর নির্মাণ শুরু হয়। তখন থেকেই এফ থার্টি ফাইভ সবচেয়ে উন্নত বিমান হিসেবে স্বীকৃত। এর স্টেলথ প্রযুক্তি, সেন্সর ফিউশন, ইঞ্জিন এবং ডেটা নেটওয়ার্কিং সক্ষমতা এবং উন্নত রাডারের সাথে অন্য কোনো যুদ্ধবিমানের মিল নেই। এর পাইলটরাও বিশেষ এক ধরনের হেলমেট পরিধান করে যা তাদেরকে বাইরের পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন থাকতে সহায়তা করে।

এই জেটটি তার শক্তিশালী স্টেলথ এবং সেন্সর ফিউশন প্রযুক্তির কারণে ভিজুয়াল-রেঞ্জের বাইরের যুদ্ধে অনেকটা অপরাজেয় অবস্থায় থেকে যায়। ডগফাইটেও এর পারদর্শিতা খুবই ভালো। ২০১৭ সালে, মডেলের প্রথম রেড ফ্ল্যাগ অনুশীলনের সময়, এফ থার্টি ফাইভ ২০:১ অনুপাতে কিলিং স্কোর করেছিল। এত ভালো সফলতা পাওয়া গেছে বিমানগুলোর উন্নত প্রযুক্তির জন্যই। এই বিমানগুলো সব দিক থেকে টার্গেটে ট্র্যাক এবং আক্রমণ করতে পারে।

এফ থার্টি ফাইভের তিনটি স্বতন্ত্র ভেরিয়েন্ট রয়েছে। প্রচলিত টেকঅফ এবং ল্যান্ডিংয়ের জন্য এফ থার্টি ফাইভ এ। এগুলো সাধারণত নিয়মিত যুদ্ধবিমান হিসেবে কাজ করে। অন্যদিকে এফ থার্টি ফাইভ বি বিমানগুলো ভার্টিকালি টেকঅফ ও ল্যান্ডিং করতে পারে। আর এফ থার্টি ফাইভ সি বিমানগুলো বিমানবাহী রণতরীতে অবতরণ করার জন্যই ডিজাইন করা হয়েছে।

প্রাথমিকভাবে, এই জেটটির উন্নত সংস্করণ করতে গিয়ে বেশ কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছিল। প্রাথমিকভাবে এফ টুয়েন্টি টু-র বিকল্প কোনো সস্তা বিমান তৈরির জন্য এফ থার্টি ফাইভ তৈরি করা হচ্ছিল। এফ থার্টি ফাইভের নির্মাণ ব্যয় এখন কমানো হয়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র এখন নিয়মিতভাবে বিপুল সংখ্যক এফ থার্টি ফাইভ রপ্তানির অফার পাচ্ছে।

তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে চীনের প্রথম পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান জে টুয়েন্টি। এফ টুয়েন্টি টু এবং এসইউ ফিফটি সেভেনের তুলনায় এগুলো বেশ ভারি ও শক্তিশালী। এই বিমান তৈরির মাধ্যমে চীনের বিমান শিল্পখাত এক ধাপ এগিয়ে যায়। উন্নত এভিওনিক্স থাকায় এটি পিপলস লিবারেশন আর্মির সক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে। এটি থ্রাস্ট-ভেক্টরড ইঞ্জিন এক্সট্রাকশন করা ছাড়া এই বিমানগুলো প্রতিপক্ষের বিমানের মতো কার্যকর নাও থাকতে পারে।

চেংডু জে-২০ এর স্টেলথ ডিজাইন এখনও অবিশ্বাস্যভাবে উন্নত। যদিও এই বিমানের সঠিক বৈশিষ্ট্যগুলো এখনো চূড়ান্তভাবে নিশ্চিত করা হয়নি। এটি আকাশ যুদ্ধে এখনো হুমকি সৃষ্টি করে চলেছে। পাশাপাশি এর উন্নত সংস্করণ তৈরির কার্যক্রমও চলছে। এর ইঞ্জিন এখনও পরীক্ষা করা হচ্ছে।

তালিকার তৃতীয় অবস্থানে থাকা লকহিড মার্টিন এফ টুয়েন্টি টু র‌্যাপটর হলো প্রথম কোনো পঞ্চম প্রজন্মের বিমান যা সার্ভিসে যুক্ত হয়েছিল। এই বিমান প্রথমবারের মতো স্টেলথ প্রযুক্তি সংযোজন করা হয়। এই বিমানের থ্রাস্ট ভেকটরিং ইঞ্জিন এবং উন্নত অস্ত্র সিস্টেম একে ডগফাইটিংয়ে এগিয়ে রাখে। তাছাড়া এর সেন্সরও অনেক শক্তিশালী।

ইউনাইটেড স্টেটস এয়ার ফোর্স হলো এফ-টুয়েন্টি টু পরিচালনার একমাত্র প্লাটফর্ম। অন্য কোনো দেশের কাছে এই বিমানটি হস্তান্তর করার ক্ষেত্রে সেই সময়ে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। কারণ বিমানগুলো প্রয়োজনের চেয়েও বেশি উন্নত ছিল। এফ টুয়েন্টি টু পরবর্তীতে নিয়মিতভাবে বিদেশে মোতায়েন করা হয়েছিল। একাধিক যুদ্ধমিশনেও বিমানটি ব্যবহৃত হয়। বিমানটি নিয়মিত আপগ্রেড করায় দুই দশকেরও বেশি আগে ডিজাইন করা এই বিমান এখনো বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত যুদ্ধ বিমানগুলোর মধ্যে একটি।

চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে কোরিয়ার তৈরি কাই কেএফ টুয়েন্টি ওয়ান বোরামায়। ইন্দোনেশিয়ার সাথে মিলে দক্ষিণ কোরিয়া এই বিমানটি তৈরি করেছে। এই বিমানটি দক্ষিণ কোরিয়ার বিমান শিল্পের অগ্রগতির পরিচয় বহন করে। এই বিমানগুলোতে স্টেলথ প্রযুক্তি, উন্নত এইএসএ রাডার সিস্টেম এবং এফ থার্টি ফাইভ প্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করে বেশ কিছু প্রযুক্তিও সংযোজন করা হয়েছে। এই বিমানগুলোকে ৪.৫ প্রজন্ম বা ক্ষেত্রবিশেষে পঞ্চম প্রজন্মের বিমান হিসেবে গণ্য করা হয়। কেএফ টুয়েন্টি ওয়ান বিমান প্রথমবারের মতো উড্ডয়ন করে ২০২২ সালের জুলাই মাসে। আরো বেশ কিছু প্রোটোটাইপ বিমান এখন নির্মাণাধীন রয়েছে। ২০২৬ সাল থেকে সামরিক বাহিনীকে এই বিমানগুলো সরবরাহ করার পরিকল্পনা করেছে। আগামীতে বোরামায় বিমানগুলোতে আরো উন্নত প্রযুক্তি সংযোজনের কথা রয়েছে। নতুন নতুন ভেরিয়েন্টও আসবে।

তালিকার পঞ্চম অবস্থানে থাকা এসইউ ফিফটি সেভেন ফেলন হলো রাশিয়ার প্রথম স্টেলথ প্রযুক্তির যুদ্ধবিমান। বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা এবং অযাচিত বিলম্বের কারণে এর সম্প্রসারণমূলক কার্যক্রম দেরি হয়। যদিও বিমানটিকে আরো কয়েক বছর আগেই চালু করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এখনো পর্যন্ত এই বিমানের মজুদ খুব একটা বেশি নয়।

আগামী দিনে এস ইউ ফিফটি সেভেনে আরও শক্তিশালী ইঞ্জিন যুক্ত করার প্রস্তুতি চলছে। এতে করে বিমানটির কার্যকারিতা আরো উন্নত হবে। সার্বিকভাবে এসইউ টুয়েন্টি সেভেনের ধারণাও আরো বিস্তৃত হবে। রাশিয়ার এই বিমান স্টেলথ বৈশিষ্ট্য এবং উন্নত রাডার সিস্টেমসহ একটি ভারি ওজনের ফাইটার।

তালিকার ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে চীনের তৈরি শেনইয়াং এফসি থার্টি ওয়ান গির ফ্যালকন যুদ্ধবিমান। এই বিমানটি প্রায় এক দশক আগে প্রথম নজরে আসে। এফ সি থার্টি ওয়ানকে এখনো উম্মোচিত করা হয়নি। তবে এই বিমানগুলো চীনের নতুন ক্যারিয়ার ভিত্তিক বিমানের কাছাকাছি।

এই বিমানটি চীনের তৈরি প্রথম কোনো পঞ্চম প্রজন্মের বিমান যা বিভিন্ন দেশেও রফতানি করা হবে। যদিও এর প্রকৃত কার্যকারিতা এখনো নিশ্চিত করা হয়নি। তবে সাম্প্রতিক বেশ কিছু ছবি থেকে বোঝা গেছে, এফসি থার্টি ওয়ানে ইঞ্জিনের জন্য পৃথক জায়গা থাকবে, নতুন একটি ক্যানোপি থাকবে। আরো বেশ কিছু প্রযুক্তিও এখানে উন্নত করা হয়েছে।

তালিকায় সপ্তম অবস্থানে আছে বোয়িং এফ-ফিফটিন ইএক্স। এটি একটি চতুর্থ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান। অনেকে হয়তো বিশ্বাসও করতে চাইবে না যে, ২০২২ সালে এই যুদ্ধবিমানটি তার ৫০তম জন্মদিন উদযাপন করেছে। এত বছর পার হয়ে গেলেও এখনো এই বিমানটি একটি শক্তিশালী যুদ্ধ মেশিনই রয়ে গেছে। এটি বিশ্বের একমাত্র ফাইটার জেট যা ১০০ টিরও বেশি এয়ার-টু-এয়ার কিলে সফল হয়েছে অথচ এতগুলো অপারেশন করেও আকাশ থেকে আকাশে কোনো ক্ষতির সম্মুখীন হয়নি।

বিমানটি ক্রমাগত আপগ্রেড করা হয়েছে। এর নতুন উদ্ভাবিত সংস্করণ পুরনো সংস্করণের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত প্রযুক্তি সম্বলিত। বোয়িং কোম্পানির তৈরি এফ-ফিফটিন ইএক্স হলো এই যুদ্ধবিমানের সর্বশেষ সংস্করণ। এই সংস্করণে একটি নতুন রাডার, সর্বশেষ এভিওনিক্স এবং উন্নত অস্ত্র প্রযুক্তি সংযোজন করেছে। ফলে আকাশযুদ্ধে এই বিমানটি এখনো গুরুত্বপূর্ণ।

তালিকার আট নম্বরে আছে ইউরোফাইটার টাইফুন। ইউরোফাইটার টাইফুনকে একটি যৌথ ইউরোপীয় যুদ্ধবিমান হিসেবে ডিজাইন করা হয়েছিল। এর কার্যক্ষমতা অনেক বেশি এবং প্রযুক্তিও বেশ উন্নত। ইউরোপ বিমানটি তৈরি করলেও ইউরোপের বাইরে অনেক দেশই এই বিমানের বিষয়ে প্রচণ্ড আগ্রহ দেখিয়েছে। ফলে, এখন এই যুদ্ধবিমানটি একাধিক মহাদেশে সমাদৃত।

ইউরোফাইটার টাইফুন যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইতালি, কাতার এবং সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের কিছু শক্তিশালী বিমান বাহিনী এই বিমানগুলো নিয়মিত ব্যবহার করে। টাইফুনের এই গ্রহণযোগ্যতার কিছু যৌক্তিক কারণ আছে। টাইফুন হলো সবচেয়ে উন্নত এবং শক্তিশালী চতুর্থ প্রজন্মের জেটগুলির মধ্যে একটি। এর সর্বশেষ রূপ ট্রাঞ্চ থ্রিতে নতুন অনেকগুলো প্রযুক্তি সংযুক্ত হয়।

২০২০ সালে আরও উন্নত ট্রাঞ্চ ফোরচালু করা হয়েছিল, যেখানে ট্রাঞ্চ থ্রি এর তুলনায় ইলেক্ট্রনিক্স এবং অস্ত্র ব্যবহার পদ্ধতি আরো উন্নত করা হয়।

দাসলতের রাফালে এবং ইউরোফাইটার টাইফুন- এই দুটো যুদ্ধবিমান অনেকটা একই রকম। কারণ এই বিমানগুলো প্রাথমিক অবস্থায় একটি বিমান হিসেবেই বিকাশ শুরু করেছিল। পরবর্তীতে ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে এসে ফ্রান্স এই কর্মসূচিকে বিভক্ত করে। নিজস্ব প্রয়োজনে একটি পৃথক ফাইটার তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয়। রাফালে টাইফুনের চেয়েও অগ্রসর একটি বিমান। কেননা এতে রয়েছে স্টেলথ প্রযুক্তি। ফ্রান্সও তার রাফালে ক্রমাগত আপগ্রেড করছে। এফ থ্রি হচ্ছে রাফালের সর্বশেষ ভেরিয়েন্ট। এতে রয়েছে অত্যাধুনিক অস্ত্র সিস্টেম এবং সেন্সর। রাফালে এফ ফোরের বর্তমানে উন্নয়ন কার্যক্রম চলমান। আগামীতে এতে রাডার এবং উন্নত এভিওনিক্স সিস্টেম যুক্ত করা হবে।

তালিকার ১০ নম্বরে নাম আছে রাশিয়ার সুখোই ব্র্যান্ডের এসইউ থার্টি, এসইউ থার্টি ফাইভ, এসইউ থার্টি সেভেন, চীনের শেনইয়াং জে-সিক্সটিন। এই বিমানগুলোর সবগুলোই তৈরি হয়েছে বিখ্যাত সুখোই বিমান এসইউ টুয়েন্টি সেভেনের প্লাটফর্র্মের ওপর ভিত্তি করে। এই বিমানগুলোর প্রতিটি ৪.৫ প্রজন্মের। কিন্তু প্রতিটি বিমানের আবার ভিন্ন ভিন্ন রূপ ও কার্যকারিতা রয়েছে। তবে এসইউ থার্টি ফাইভ এস বিমানটিকে এই সবগুলো বিমানের চূড়ান্ত ও সর্বশেষ সংস্করণ হিসেবে বিবেচনা করা যায়।

রাশিয়ার তৈরি এই বিমানে সর্বশেষ ইলেকট্রনিক্স সিস্টেমের পাশাপাশি ফিউজলেজের অনেকগুলো উন্নত বৈশিষ্ট্য রয়ে গেছে। এর প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হলো থ্রাস্ট ভেক্টরিং ইঞ্জিনের অগ্রভাগ যেগুলো যেকোনো দিকে ঘুরতে পারে। ফলে বিমানটিও খুবই কৌশলী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।

যে যুদ্ধবিমান যত বেশি উন্নত তা ততটাই কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। তাই, যুদ্ধবিমানে সাধারণত সর্বশেষ প্রযুক্তিই ব্যবহার করা হয়। রাশিয়ার সুখোই চেকমেট, ভারতের এইচএএল এএমসিএ, কিংবা তুরস্কের টিএফ-এক্সকে এই তালিকায় শামিল করা হয়নি। কারণ, এগুলোর কোনোটাই এখনো অপারেশনে আসেনি।