রাশিয়ার সামরিক সক্ষমতা আসলে কতটুকু?

রাশিয়ার ট্যাঙ্কের বহর পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বড় বলে ধারণা করা হয় - ছবি : সংগ্রহীত

  • হায়দার সাইফ
  • ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ২০:৩১

ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে এখন পুরো পশ্চিমা বিশ্বের মুখোমুখি হয়েছে রাশিয়া। এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি আলোচিত প্রশ্ন হলো রাশিয়া কি পারবে পশ্চিমের মোকাবেলা করতে? তাদের সামরিক সক্ষমতা আসলে কতটুকু? ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছিল রাশিয়া। কিন্তু সেখান থেকে ধীরে ধীরে তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। প্রেসিডেন্ট পুতিনের শাসনে অনন্য উচ্চতায় চলে গেছে রাশিয়ার সামরিক শক্তি। 


ইউক্রেন সীমান্তে রাশিয়া যে বিপুল সামরিক শক্তি মোতায়েন করেছে, তা অনেক ধরণের বিতর্ক উসকে দিয়েছে। এর একটি হলো রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনীর সক্ষমতা আসলে কতটুকু। ১৯ শতক থেকেই মস্কো গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে টিকে আছে। শীতল যুদ্ধের সময় পরাশক্তির পর্যায়ে চলে যায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর গঠিত নতুন রাশিয়ান ফেডারেশান মারাত্মক অর্থনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়েছিল। তখন তারা আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে নিজেদের গুটিয়ে রেখেছিল।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে রাশিয়া যতটুকু অর্থনৈতিক উন্নতি করতে পেরেছিল, তা একটা মাত্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল; কিন্তু প্রেসিডেন্ট ভ্লদিমির পুতিনের অধীনে মস্কো নতুন সামরিক উন্নয়ন কর্মসূচি নিয়ে বহুদূর এগিয়ে গেছে। এ জন্য বরাদ্দ করা হচ্ছে মোটা অঙ্কের বাজেট। এই কর্মসূচির অধীনে দেশের সামরিক বাহিনীকে করা হয়েছে আধুনিকায়ন। এর মধ্যে বিমান বাহিনী থেকে নিয়ে নৌবাহিনী - সবই আছে। সেই সাথে সুপারসনিক ক্রুজ মিসাইলসহ অন্যান্য অস্ত্র তৈরির ক্ষেত্রেও এগিয়ে গেছে রাশিয়া।

পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার সামরিক সক্ষমতা নিয়ে সবসময় প্রশ্ন তুলেছে; কিন্তু মস্কো সম্প্রতি স্বল্প সময়ের মধ্যে ইউক্রেন সীমান্তের কাছে সামরিক মোতায়েন করেছে। বেলারুশ থেকে নিয়ে পূর্ব ইউক্রেন পর্যন্ত এলাকায় যে ভাবে তারা সৈন্য মোতায়েন করেছে, সেটা পশ্চিমের রাজধানীগুলোকে সতর্ক করে দিয়েছে। বিশেষ করে ওয়াশিংটন এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্ক হয়ে গেছে।

আসাদ সরকারের আমন্ত্রণে সিরিয়ার সঙ্ঘাত পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপ করেছিল রাশিয়া। সেখানে রাশিয়া তার নতুন হাইপারসনিক অস্ত্রের প্রদর্শনী করার সুযোগ পেয়েছে। বিশ্বের মানুষ সিরিয়ার মাটিতে রাশিয়ান অস্ত্রের শক্তি দেখেছে। এগুলো কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তার একটা ধারণা হয়ে গেছে বিশ্ববাসীর।

ইউরোপে নিযুক্ত মার্কিন সেনাবাহিনীর সাবেক কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল বেন হজেস বলেছেন, এটা স্বীকার করতে আমার বিব্রত লাগছে, কয়েক বছর আগে যখন রাশিয়ার কালিবর মিসাইলগুলো কাস্পিয়ান সাগর থেকে উড়ে এসে সিরিয়ার বিভিন্ন টার্গেটে আঘাত হানছিল, তখন আমি বিস্মিত হয়েছি। এই আমেরিকান জেনারেল আরও বলেন, এটা আমার কাছে ছিল একটা বিস্ময়ের মতো। তারা যে এতদূর এগিয়ে গেছে, সেটা আমার জানাই ছিল না।

অর্থনৈতিক সমস্যা ও পশ্চিমা চাপের মধ্যেও পুতিনের রাশিয়া সফলভাবে সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়ন করেছে। এই আধুনিকায়নের ফলে ক্রেমলিনের নেতাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জোরালো হয়েছে। সে কারণে তারা সিরিয়া সঙ্ঘাত পরিস্থিতি থেকে নিয়ে ভেনেজুয়েলা ও আফগানিস্তানের মতো জায়গায় নিজেদের শক্তির প্রয়োগ করছে।

অতি সম্প্রতি রাশিয়া পরিস্কারভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে যে, পশ্চিম সীমান্তের কাছে তারা ন্যাটোর সম্প্রসারণকে সহ্য করবে না। বিশেষ করে ইউক্রেনের মতো দেশে। যেখানে রয়েছে বিপুল সংখ্যক রুশভাষী জনগোষ্টি। যাদের সাথে মস্কোর শক্তিশালী ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ রয়েছে।

১৯৯০ দশকের শুরুর দিকে যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়, তখন রাশিয়ার সবচেয়ে দুর্দিন চলছিল। এমনকি সেই সময়েও রাশিয়ার বহরে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পারমাণবিক অস্ত্র ছিল। এই অস্ত্র সম্ভারের কারণে রাশিয়ার প্রতিরোধ সক্ষমতা সবসময় অটুট ছিল। এই মুহূর্তে বিশ্বের অন্য যে কোন পরাশক্তির তুলনায় রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রের সংগ্রহ সবচেয়ে বড়।

রাশিয়ার বিমান বাহিনীকে যুক্তরাষ্ট্রের পরেই বিশ্বের দ্বিতীয় শক্তিশালী বিমান বাহিনী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। গত এক দশকে বিমান বাহিনীতে এক হাজারেরও বেশি জঙ্গি বিমান যুক্ত করেছে রাশিয়া। এর মধ্যে অত্যাধুনিক সু-৩৫ বিমানও রয়েছে। এই তথ্য প্রকাশ করেছে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়।

প্রযুক্তির দিক থেকে সু-৩৫ রাশিয়ার সবচেয়ে অত্যাধুনিক জঙ্গি বিমান। ইউক্রেনের প্রতিবেশী ও রাশিয়ার মিত্র বেলারুশে এখন এই বিমান মোতায়েন করেছে মস্কো। রাশিয়ার বিমান বাহিনীতে কৌশলগত বোমারু বিমানও রয়েছে। বিশ্বের আর মাত্র দুটি দেশের কাছে এই বিমান রয়েছে। তারা হলো যুক্তরাষ্ট্র আর চীন।

বিমান বাহিনীর মতোই রাশিয়ার নৌবাহিনীও যুক্তরাষ্ট্রের পরেই বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর নৌবাহিনী। মস্কো এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সাবমেরিনের বহর পরিচালনা করতে পারে। এই সাবমেরিনগুলো ব্যালিস্টিক মিসাইল বহনে সক্ষম।

রাশিয়ার স্থল বাহিনীর আকারও বিশাল। তিনি মিলিয়নের বেশি সেনা রয়েছে এই বাহিনীতে। এদের মধ্যে রিজার্ভ সেনাও রয়েছে। সেনা সংখ্যার দিক থেকে এটা বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্থল বাহিনীগুলোর একটি।

রাশিয়ার ট্যাঙ্কের বহর পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বড় বলে ধারণা করা হয়। তাদের বহরে যে টি-৭২বি৩ ট্যাঙ্ক রয়েছে- এই ট্যাংকে নতুন থার্মাল অপটিক্স প্রযুক্তি যুক্ত করে সেটাকে আরও শক্তিশালী করা হয়েছে। ফলে, এটা এখন অন্ধকারেও লড়তে পারবে। এই ট্যাঙ্কে যে গাইডেড মিসাইল রয়েছে, সেটা যত দূরের টার্গেটে আঘাত হানতে পারে, বিশ্বের আর কোন ট্যাঙ্কের সেই সক্ষমতা নেই। খোদ আমেরিকান সামরিক বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ এটি।

রাশিয়ার যে ইসকান্দার-এম রকেট রয়েছে, এগুলোর উৎপাদন সম্পূর্ণ হয়েছে পুতিনের তত্ত্বাবধানে। এগুলো হলো রাশিয়ার নতুন প্রজন্মের ব্যালিস্টিক মিসাইল। সম্প্রতি ইউক্রেন সীমান্তে এই মিসাইলগুলো মোতায়েন করেছে রাশিয়া। ইউক্রেনের যে কোন টার্গেটে এই মিসাইলগুলো আঘাত হানার ক্ষমতা রাখে।

রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনী আকারেই শুধু বড় নয়। এদেরকে যথেষ্ট সুশৃঙ্খলভাবে গড়ে তুলেছে রাশিয়া। রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলকভাবে যাদেরকে নিয়োগ দেয়া হয়, এদের সংখ্যা পুরো সামরিক জনবলের ৩০ শতাংশ। সেখানে এখনও ১৮ থেকে ২৭ বছর বয়সী সব পুরুষ নাগরিকের জন্য সামরিক বাহিনীতে কাজ করা বাধ্যতামূলক; কিন্তু বাহিনীর মূল শক্তি হলো উচ্চ বেতনভুক্ত সুপ্রশিক্ষিত সেনারা। এদের সংখ্যা চার লাখের মতো।

রাশিয়ার নেতা থেকে শুরু করে সামরিক বাহিনীর নিম্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদেরকেও যথেষ্ট স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিয়েছে। বেসামরিক নেতাদের ক্ষেত্রে যেটা খুব একটা দেখা যাবে না। এই সিদ্ধান্তের কারণে সামরিক বাহিনীর মধ্যে নৈতিক মনোবল এবং কাজের গতি অনেক বেড়ে গেছে।

সিরিয়ার সঙ্ঘাত পরিস্থিতিকে সামরিক শক্তির প্রশিক্ষণ ও পরীক্ষার ক্ষেত্র হিসেবে কাজে লাগিয়েছে মস্কো। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী সের্গেই কে শোইগুর ভাষ্যমতে, রাশিয়ার বিমান বাহিনীর ৯২ শতাংশ জনবল এবং নৌবাহিনীর ৬২ শতাংশ জনবলের এখন প্রত্যক্ষ যুদ্ধের অভিজ্ঞতা হয়েছে।

আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউটের ক্রিটিক্যাল থ্রেটস প্রজেক্টের ডিরেক্টর ফ্রেড কাগান মনে করেন, রাশিয়ার যে সব অস্ত্র আকাশ পথে ব্যবহার করা যায়, তার সবগুলোই তারা সিরিয়ায় ব্যবহার করেছে।

প্রেসিডেন্ট পুতিনের সর্বোচ্চ চেষ্টা সত্বেও রাশিয়ার সামরিক ব্যায়ের পরিমাণ অতটা বাড়েনি। সামরিক ব্যায়ের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের পরে চতুর্থ স্থানে রয়েছে রাশিয়া।

অস্ত্রনির্ভর যুদ্ধের বাইরে রাশিয়া তার শত্রুদের বিরুদ্ধে হাইব্রিড যুদ্ধের সক্ষমতাও বাড়িয়ে তুলেছে। সামরিক শক্তির পাশাপাশি শত্রুর রিুদ্ধে কূটনীতি, সাইবার হামলা, সোশাল মিডিয়া এবং অন্যান্য উপায়ে হামলার সক্ষমতাও তাদের অনেক বেড়ে গেছে।

আজারবাইজানে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন কূটনীতিক ম্যাথিউ ব্রায়জা মনে করেন, রাশিয়াকে আসলে প্রতি মুহূর্তে ন্যাটোর বিরুদ্ধে হাইব্রিড যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হচ্ছে। এর অর্থ হলো, অস্ত্রশক্তি বাদ দিয়ে মনস্তাত্ত্বিক, মাল্টিমিডিয়া, সোশাল মিডিয়া, অর্থনৈতিকসহ সব ধরণের অভিযান চালিয়ে প্রতিপক্ষকে দুর্বল করার চেষ্টা চলছে। এ ক্ষেত্রে বড় ধরনের অগ্রগতি হয়েছে রাশিয়ার। হাইব্রিড যুদ্ধের সক্ষমতা অর্জন করাটা অনেক ক্ষেত্রে অস্ত্র উৎপাদনের চেয়েও কঠিন। রাশিয়ার এই সক্ষমতা অর্জনের অর্থ হলো, আধুনিক যুদ্ধ কৌশল রপ্ত করার ক্ষেত্রেও তারা যথেষ্ট এগিয়ে গেছে।