পাকিস্তানকে এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম দিচ্ছে চীন


  • মোতালেব জামালী
  • ০৮ নভেম্বর ২০২১, ১৭:২৪

পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা আরও নিখুঁত করেছে। অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে দেশটি চীনের তৈরি এইচকিউ-৯-পি বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা যুক্ত করেছে। এইচকিউ-৯-পি হচ্ছে একটি উচ্চ থেকে মধ্যম রেঞ্জের বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা। একই সঙ্গে এটাকে কৌশলগত দূরপাল্লার সারফেস টু এয়ার মিসাইল বা ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র হিসেবেও বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এটি একটি সমন্বিত বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা।

আধুনিক সমন্বিত বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় থাকে লোকবল, সরঞ্জাম, অস্ত্র, রাডার, ব্যাটারি ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাঠামো। এসব কিছু মিলেই বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা তৈরি হয়। যা শত্রুপক্ষের বিমানের নিজেদের আকাশসীমায় প্রবেশের চেষ্টাকে কার্যকরভাবে প্রতিহত করে। সমন্বিত ব্যবস্থার অর্থই হচ্ছে একাধিক প্রতিরক্ষাব্যবস্থা মিলে একটি ব্যবস্থা তৈরি করা। অর্থাৎ সিস্টেমের মধ্যে সিস্টেম। এ ধরনের সমন্বিত প্রতিরক্ষাব্যবস্থা নিজেদের আকাশ নিরাপদ রাখতে নজরদারি করে, যুদ্ধ ব্যবস্থাপনা ও আকাশ নিয়ন্ত্রণে রাখে। কোনো একক প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় সাধারণত এসব সুবিধা পাওয়া যায়।

পাকিস্তানে সমন্বিত বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা অবশ্য নতুন কিছু নয়। ১৯৮০-র দশকের শেষের দিকে পাকিস্তান তার নিরাপত্তার জন্য সমন্বিত বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। তখন থেকেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে শুধু নয়, বিমানবাহিনীর আধুনিকায়ন করার জন্যও একটি স্বতন্ত্র শাখা খোলে। তখন থেকেই এই দফতরটি পাকিস্তনের প্রতিটি বাহিনীর জন্য আধুনিক অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম এবং সমন্বিত প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সংগ্রহের কাজ করে যাচ্ছে।

নতুন যোগ করা এই ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থা ১০০ কিলোমিটার রেঞ্জের মধ্যে জঙ্গি বিমান, ক্রুজ মিসাইল দৃষ্টিসীমার বাইরে থাকা অস্ত্রের হামলাসহ বিভিন্ন ধরনের হামলা প্রতিহত করতে সক্ষম।

বর্তমান সময়ে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের কারণে প্রতিনিয়ত নানা ধরনের অত্যাধুনিক অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম উদ্ভাবন করা হচ্ছে। বিশেষ করে অত্যাধুনিক ড্রোন ও জঙ্গিবিমান তৈরি করা হচ্ছে। এর ফলে আকাশ প্রতিরক্ষায় চ্যালেঞ্জও বাড়ছে। সে কারণে সমন্বিত বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা পাকিস্তানের নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন দেশটির সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া। তিনি বলেছেন, আঞ্চলিক ভূরাজনীতি ও নিরাপত্তাব্যবস্থার কথা মাথায় রেখেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের আকাশ সীমায় যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে এইচকিউ-৯-পি বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা মোতায়েন করেছে।

চরম অর্থনৈতিক সংকট ও বৈদেশিক ঋণ থাকার পরও পাকিস্তান তার সশস্ত্র বাহিনীকে আধুনিক অস্ত্রসজ্জিত ও শক্তিশালী করে গড়ে তোলার এই পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে দেশটি চীনের কাছ থেকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সামরিক সরঞ্জাম কিনছে। বিশেষ করে বিমান ও নৌবাহিনীর জন্য এ ধরনের অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম কেনা হচ্ছে।

ভারত মহাসাগর ও আরব সাগরে ভারতের নৌবাহিনীর একক আধিপত্য রুখে দিতে এবং পাকিস্তান নৌবাহিনীর নেভাল আক্রমণ সক্ষমতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে বাড়াতে যুদ্ধজাহাজ, ক্ষেপণাস্ত্র ও অন্যান্য প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সরবরাহ করে যাচ্ছে দেশটির ঘনিষ্ঠ মিত্র চীন। এর অংশ হিসেবেই বিমানবাহিনীর জন্য চীনের কাছ থেকে এইচকিউ-৯-পি সিরিজের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম বা বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সংগ্রহ করেছে পাকিস্তান। এর ফলে শত্রুর যে কোনো হুমকি মোকাবিলায় পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী সক্ষম হবে বলে দেশটির সরকার আশা করছে।

চীনের এই এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম মূলত রাশিয়ার এস-৩০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থার হেভিওয়েট উন্নত সংস্করণ। এটির প্রতিটি মিসাইল টার্গেটের দিকে ৪ দশমিক ৫ ম্যাক গতিতে গিয়ে হামলা করতে পারে। এইচকিউ-৯-পি এর অপারেশন রেঞ্জ ৩০০ কিলোমিটার। এটি তার এইচটি-২৩৩ রাডারের সাহায্যে মোট ১০০টি টার্গেটকে শনাক্ত করতে পারে। ১২টি টার্গেটের বিরুদ্ধে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করতে সক্ষম। এই রাডারটি ইসরায়েল ও চীনের যৌথ উদ্যাগে গৃহীত প্রকল্পে তৈরি করা হয়েছে। প্রতিটি ক্ষেপণাস্ত্র ৩৫ কিলোমিটার উচ্চতায় যে কোনো টার্গেটকে ধ্বংস করতে সক্ষম বলে চীন দাবি করেছে।

চীনের কাছ থেকে অত্যাধুনিক জে-১০সিই যুদ্ধবিমান ও মিসাইলও কিনছে পাকিস্তান। সম্প্রতি, ভারত ফ্রান্সের রাফালে যুদ্ধবিমান কেনায় পাকিস্তানও নিজেদের বিমানবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করেছে। পাকিস্তানের বিমান বহরে জে-১০সিই যুদ্ধবিমান যুক্ত হলে তা ভারতের জন্য আরেকটি চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা দেবে। ফ্রান্সের কাছ থেকে ভারতের দুই স্কোয়াড্রন রাফালে জঙ্গিবিমান কেনা একটি গেম চেঞ্জার হবে বুঝতে পেরেছে পাকিস্তান। ফলে তারাও মরিয়া হয়ে চীনের কাছ থেকে ৩০টি জে-১০সিই জঙ্গিবিমান ও বিমানবাহিনীর অত্যাধুনিক এয়ার-টু-এয়ার মিসাইল কিনতে চাচ্ছে।

জে-১০সিই হচ্ছে চীনের চেংদু জে-১০ যুদ্ধবিমানের রফতানি মডেল। এটিকে বলা হয় মার্কিন এফ-১৬ এর আধুনিক সংস্করণ। রাফালের মতোই সেমি-স্টেলথ প্রযুক্তি সম্পন্ন ৪ দশমিক ৫ জেনারেশনের যুদ্ধবিমান এটি। ২০০৯ সালে পাকিস্তান প্রথম জেএ-১০ কেনার আগ্রহ প্রকাশ করে। কিন্তু পাকিস্তানের সঙ্গে চীন যৌথভাবে জেএফ-১৭ তৈরির কাজে হাত দিলে জেএ-১০ কেনার বিষয়টি আড়ালে চলে যায়। ভারত রাফালে কেনায় চীন ও পাকিস্তান এই যুদ্ধবিমান কেনার বিষয়ে আবারও আলোচনা শুরু করেছে।

জে-১০সিই ছাড়াও পাকিস্তন স্বল্পপাল্লার পিএল-১০ ও দূরপাল্লার পিএল-১৫ এয়ার-টু-এয়ার মিসাইল চেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ক্রমেই ভারতের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠায় চীন এখন পাকিস্তানের অত্যাধুনিক অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম সংগ্রহের প্রধান উৎস হয়ে উঠেছে।

জে-১০সিই হলো চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির ব্যবহার করা জে-১০ জঙ্গিবিমানের রফতানি সংস্করণ। এতে এইএসএ রাডার, ফায়ার কন্ট্রোল সিস্টেম ও ইনফ্রারেড প্রযুক্তি রয়েছে। পাকিস্তান বিমান বাহিনী রাফালে থাকা মেটেওর এয়ার-টু-এয়ার মিসাইল নিয়েই উদ্বিগ্ন নয়, মিকা মিসাইল নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে। কারণ মিকা মিসাইলও বিমান থেকে ছোড়া যায়।

পাকিস্তানের জঙ্গিবিমানের জন্য বড় ধরনের হুমকি সৃষ্টি করবে ভারতের এস-৪০০ বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা বা মাঝারি পাল্লার সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল সিস্টেম। পাকিস্তানের বিমান বাহিনীর হাতে বর্তমানে ১২৪টি জেএফ-১৭ ফাইটার রয়েছে।

এইচকিউ-৯-পি ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থার পাশাপাশি পাকিস্তান সেনাবাহিনী এল ওয়াই ৮০, এইচকিউ ১৬এ মিডিয়াম রেঞ্জ ও স্বল্পপাল্লার এফএম ৯ বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থাও মোতায়েন করেছে। এছাড়াও পাকিস্তান বিমান প্রতিরক্ষা মহড়া ‘আল বায়জাও’ সম্পন্ন করেছে। এ বছর করাচিতে আল বায়জা-২ মহড়ার সময় পাকিস্তান তার বিভিন্ন অস্ত্রব্যবস্থার পরীক্ষাও করেছে। এসব পরীক্ষার মধ্যে ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্রও রয়েছে।

এর আগে ২০১৫ সালে পাকিস্তান চীনের কাছ থেকে আটটি এয়ার-ইনডিপেনডেন্ট প্রপালশন পাওয়ার্ড সাবমেরিন কেনার চুক্তি করে। ২০১৭ সালে পাকিস্তান বিমানবাহিনী পঞ্চম প্রজন্মের জঙ্গিবিমান-প্রজেক্ট আজম-এ চীনের সহায়তা নিশ্চিত করে। এরপর ২০১৮ সালে পাকিস্তান নৌবাহিনী চীনের কাছ থেকে আরও দুটি টাইপ ০৫৪এ ফ্রিগেট কেনার চুক্তি করে। ২০২১ সালের মধ্যে এ ধরনের ফ্রিগেট সংখ্যা চারটিতে দাঁড়াবে।

অস্ত্রের জন্য পাকিস্তান কেবলমাত্র চীনের ওপর নির্ভর করায় বিস্ময়ের কিছু নেই। আসলে একটি শীর্ষ সামরিক শিল্প শক্তি হিসেবে চীনের উত্থানের কারণে পাকিস্তান তার সাপ্লাই চ্যানেল যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপ থেকে চীনের দিকে সরিয়ে এনেছে। কারণ পশ্চিমাদের সরবরাহব্যবস্থায় তাৎক্ষণিক কোনো জটিলতা তৈরি হলে তা থেকে পাকিস্তান ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অপরদিকে ইসলামাবাদ চীনের কাছ থেকে সহনীয় মূল্যে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির অস্ত্র আমদানি করতে পারছে।

পাকিস্তান ও চীনের মধ্যে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। পাকিস্তানের ওপর চীনের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। প্রধান সরবরাহকারী হিসেবে চীন চাইলে পাকিস্তানের প্রচলিত ও পারমাণবিক অস্ত্রের সামর্থ্যকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। বহু দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র এটা করতে চেয়েছে। তবে পাকিস্তানকে সামরিকভাবে শক্তিশালী হওয়ার পথে চীন বাধা দিতে চায় না বলেই মনে হয়।

বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে বরং পাকিস্তানকে আরও শক্তিশালী করার দিকেই মনযোগী হয়েছে বেইজিং।

ভারতের সাথে দুই দেশেরই চরম বৈরিতার সম্পর্ক। ভারতের হুমকি মোকাবিলায় সে কারণেই বেইজিং পাকিস্তানকে সামরিকভাবে শক্তিশালী করে তুলছে। দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে কৌশলগত অংশীদারিত্ব গড়ে উঠেছে। বন্ধুপ্রতীম দেশ দুটি সমন্বিতভাবেই ভারতের দিক থেকে আসা যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে চায় বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। তার অংশ হিসেবেই চীন পাকিস্তানকে অত্যাধুনিক সব অস্ত্র দিয়ে শক্তিশালী করছে।