যদি সত্যি সত্যি ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়, তাহলে তেহরান বেশ কিছু কারণে একটু সংকটেই পড়ে যাবে। যদি যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়, তাহলে কারও জন্যই লড়াইটা খুব সহজ হবে না। বিশেষত, পরাশক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের এমন কিছু শক্তিমত্তা রয়েছে, যা ইরানের জন্য বড় আকারের উদ্বেগের কারণ। এর আগে ইরান ও ইরাকের মধ্যে যখন যুদ্ধ শুরু হয়, তখন দুই দেশই একে অপরের তেলের ট্যাঙ্কারগুলোকে টার্গেট করে সুবিধাজনক অবস্থানে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়েছিল। ইরান-ইরাক যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর প্রথম তিন বছরে ৪৮টি তেলবাহী বাণিজ্যিক জাহাজ প্রতিপক্ষের আক্রমণের শিকার হয়েছিল।
একের পর এক তেলবাহী জাহাজ ঝুঁকির মুখে পড়ে যাওয়ায় বৈশ্বিক শক্তিগুলোর টনক নড়ে যায়। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র গোটা ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। তাই তারা তেলের ট্যাঙ্কার এবং বাণিজ্যিক জাহাজগুলোকে পাহারা দেওয়ার জন্য পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে নৌবাহিনীর পৃথক একটি টাস্কফোর্স পাঠায়। এখন যদি ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ শুরু হয়, তাহলে কী ধরনের যুদ্ধবিমান ও সমরাস্ত্র যুক্তরাষ্ট্র ব্যবহার করতে পারে, আসুন জেনে নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের হাতে থাকা ৫টি অস্ত্র ইরানের জন্য বরাবরই উদ্বেগজনক হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এর মধ্যে প্রথমেই বলতে হয় এফ-টোয়েন্টি র্যাপটরের কথা। ২০১৩ সালে যখন ইরানের ওপর মার্কিন ড্রোনগুলো নজরদারি করার সময় ইরানি বিমানগুলো এ ড্রোনকে টার্গেট করে। এরই প্রতিক্রিয়ায় ওয়াশিংটন আরও উন্নতমানের হাই ভ্যালু এয়ার এসেট এসকর্ট দিয়ে ডোন প্রেরণ করতে শুরু করে। নতুন এই উন্নত এসকর্টগুলোই এফ টোয়েন্টি টু র্যাপটর নামে পরিচিত।
এই বিমানগুলো পঞ্চম প্রজন্মের বিমান। অন্যদিকে, ইরান এগুলোকে মোকাবিলা করছিল পুরনো ধাঁচের এফ-ফোর ফ্যান্টম দিয়ে। এই বিমানগুলোও আমেরিকার তৈরি, তবে তা পঞ্চম প্রজন্মের বিমান মোকাবেলার জন্য যথেষ্ট ছিল না। ফলে, র্যাপটরের পাইলটেরা খুব সহজেই ইরানের ব্যবহৃত এফ-ফোর ফ্যান্টমকে ধরাশায়ী করতে পারছিল। ফলে, ইরানের আকাশে মার্কিনিদের শ্রেষ্ঠত্বই যেন বারবার প্রমাণিত হতো। এফ-টোয়েন্টি টুকে তৈরিই করা হয়েছিল এজন্য। ফলে, স্বাভাবিকভাবেই ইরানের বিমান বাহিনী নতুন প্রজন্মের র্যাপটরের বিপরীতে সেই অর্থে কোনো প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারেনি। যখনই ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে উত্তাপ ছড়াত, তখনই যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে পারস্য মহাসাগরীয় অঞ্চলে র্যাপটর মোতায়েন করত।
যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় শক্তিশালী সমরাস্ত্র ছিল বি-টু স্টিলথ বোমারু বিমান। যুক্তরাষ্ট্র ইরানের যে বিষয়টি নিয়ে সবচেয়ে বেশি আতঙ্কিত হয়, তা হলো ইরানের চলমান পারমাণবিক প্রকল্প। যদি কখনও এই পারমাণবিক প্রকল্পের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক পন্থায় সমাধান করার কথা চিন্তা করে, তাহলে সেক্ষেত্রে তাদের হাতে মোক্ষম অস্ত্র হয়ে উঠবে বি-টু বোমারু বিমান।
ইরানের প্রতিরক্ষা ব্যুহটি বাড়তি শক্তিশালী হয়েছে দেশটির ভৌগলিক অবস্থানের কারণে। আয়তনে ইরান প্রতিবেশী দেশ ইরাকের চেয়ে তিনগুণ বড়ো। গোটা পশ্চিম ইউরোপের সবগুলো দেশ মিলে যে আকৃতি হয়, এককভাবে ইরানের আয়তন তার প্রায় সমান। ইরানের অধিকাংশ পারমাণবিক স্থাপনা এবং অন্যান্য সামরিক ঘাঁটিগুলো দেশটির অভ্যন্তরে শক্তিশালী কাঠামোতে স্থাপন করা হয়েছে। সাধারণভাবে এসব স্থাপনায় হামলা চালানো বেশ কঠিন। এক্ষেত্রে বি-টু বিমানই সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে ধারণা করা হয়। এই বিমানগুলোর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান নরথপ গ্রুম্ম্যান দাবি করছে, বি-টু বিমান দিয়ে দূরপাল্লার আক্রমণ করা তুলনামূলক সহজ হবে। তাছাড়া এই বিমানটিকে প্রতিকূল অবস্থায় বিশে^র সবচেয়ে টেকসই বিমান হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বি টু বিমান দিয়ে শুধু দুর্গম এলাকাতে আক্রমণ পরিচালনাই নয়, বরং এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমকেও সহজে ভেদ করা সম্ভব। এ বিমানগুলো একবার তেল নিয়ে ৬ হাজার নটিক্যাল মাইল এবং আকাশে ভাসমান অবস্থায় আরেকদফা তেল নিয়ে ১০ হাজার নটিক্যাল মাইল পরিমাণ পথ অতিক্রম করতে পারে। পাশাপাশি বি-টু বিমানগুলো অনেক বেশি পেলোড বহন করতে পারে। বি-টু বিমানের হামলা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যথাযথ হয়। নরথপ গ্রুম্ম্যান আরও দাবি করছে, এই বিমানগুলো ২০ টন পরিমাণ নিউক্লিয়ার অর্ডন্যান্স বহন করতে পারে এবং যেকোনো আবহাওয়ায় নির্দিষ্ট গন্তব্যে তা পৌঁছেও দিতে পারে।
পারমাণবিক প্রকল্পের পর ইরানের হাতে দ্বিতীয় যে মারাত্মক অস্ত্র আছে তাহলো এটু-এডি কর্মকৌশল। ইরানের হাতে যেমন অনেক অ্যান্টি শিপ মিসাইল রয়েছে, আবার মধ্যপাল্লার গাইডেড মিসাইলও রয়েছে। ইরান নিজেদের ভৌগলিক অবস্থানের সুবিধা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিপরীতে এই মিসাইলগুলো ব্যবহার করে। ইরানের আরেকটি সুবিধাজনক দিক হলো, ইরানের অভ্যন্তরে হরমুজ প্রণালীর ১ হাজার ৩৫৬ মাইল পরিমাণ বিস্তৃত উপকূলীয় সীমানা রয়েছে।
ফলে, পারস্য উপসাগরে টহল দেওয়া মার্কিন নৌযানগুলোকে আক্রমণ করার ক্ষেত্রে ইরান বাড়তি সুবিধা পায়। তাছাড়া ইরান যদি কখনও হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেওয়ারও চিন্তা করে, তাহলে হয়তো যুক্তরাষ্ট্রকে ইরানের উপকূলীয় কিছু এলাকা দখল করতে হবে। আর তা করতে হলে যুক্তরাষ্ট্রকে জল ও স্থল- উভয়স্থানে চলার যোগ্য বা উভচর ধরনের যান ব্যবহার করতে হবে।
ইরানের জন্য দুঃসংবাদ হলো, মার্কিন মেরিন সেনারা এরই মধ্যে অনেকগুলো সংস্করণে উভচর যান তৈরি করে ফেলেছে। এমন কিছু যান মার্কিন সেনাদের কাছে আছে, যা তড়িৎ নোটিশে ৮ নট স্পিডে এসে শত্রুপক্ষের ১২ মাইল এলাকার ভেতরে গিয়ে মেরিন পদাতিক সেনাবাহিনীকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দিয়ে আসতে পারবে। তাছাড়া এই যানগুলো দিয়ে প্রতিপক্ষের রেখে যাওয়া যেকোনো মাইন সনাক্ত করে তা ধ্বংস করাও সম্ভব হবে। সর্বশেষ যে সামরিক প্রযুক্তি নিয়ে ইরানের আতঙ্ক রয়েছে তা হলো- লেজার প্রযুক্তি।
সামরিক খাতের লেজার পদ্ধতিটি নিয়ে এখনও কাজ চলছে। প্রাথমিকভাবে এ সম্পর্কে খুবকম ধারণাই পাওয়া গেছে। তবে, বেশ কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত খবর থেকে জানা গেছে, মার্কিন নৌ বাহিনীর লেজার উইপন সিস্টেমগুলো সর্বশেষ যে পরীক্ষাগুলো চালিয়েছে, তাতে ধারণার চেয়েও ভালো ফলাফল পাওয়া গেছে। দেখা গেছে, লেজার প্রযুক্তি দিয়ে খুব অল্প সময়ে এবং কার্যকরভাবে প্রতিপক্ষের টার্গেটগুলো শনাক্ত করা যায় এবং অনেক কঠিন কঠিন টার্গেটও বেশ সফলভাবে ধ্বংসও করা যায়।
ইরান ও ইরানের এটু-এডি কৌশলের জন্য এগুলো বড়ো আকারের উদ্বেগ তৈরি করেছে। ইরানের নৌপথে এতদিন সফলতা পাওয়ার একটি বড় কারণ ছিল তারা খুব হালকা অস্ত্রে সজ্জিত এমন কিছু স্পিডবোট দিয়ে পারস্য উপসাগরে অবস্থানরত মার্কিন নৌযানগুলোকে টার্গেট করতে পারত। তাছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরান ড্রোনখাতেও বেশ বিনিয়োগ করেছে। আগামীতে হয়তো আমেরিকার বিরুদ্ধে ইরান এসব ড্রোনও ব্যবহার করতে চাইবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যদি লেজার সিস্টেম প্রয়োগ শুরু করে, তাহলে ইরানের নৌ অভিযান ও ড্রোন অভিযান- দুটোই হুমকির মুখে পড়বে। ইরানের ড্রোন ও লাইট আমর্ড স্পিডবোট নির্মাণে বেশি ব্যয় হলেও লেজার সিস্টেম প্রয়োগ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র খুব স্বল্প খরচেই তা ধ্বংস করে দিতে পারবে।
ব্যয়বহুল কোনো প্রযুক্তিকে যদি খুব সস্তায় কাবু করে দেওয়া যায়, তাহলে নির্মাতা দেশগুলো যুদ্ধকালীন সময়ে বড়ো আকারের অস্ত্র ও অর্থ সংকটে পড়ে যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র লেজার সিস্টেমের ওপর জোর দিচ্ছে, কারণ প্রথাগত মিসাইল সিস্টেমের তুলনায় লেজার সিস্টেমে খরচ অনেকটাই কম। তাছাড়া মিসাইল একটানা নিক্ষেপ করা হলে এর মজুদ শেষ হয়ে যায়, কিন্তু লেজার সহজে শেষ হয় না।
যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকেরা লেজার সিস্টেমকে বৈপ্লবিক ও যুগান্তকারী আবিষ্কার হিসেবেই আখ্যা দিয়েছেন। লেজারের একটাই অসুবিধা আর তা হলো- সব আবহাওয়ায় তা সমান কার্যকর থাকে না। যুক্তরাষ্ট্র এখন এই দুর্বলতাও কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। আর তেমনটা সম্ভব হলে ইরানের নীতি নির্ধারকদের কপালে যে ভাঁজ বাড়তে থাকবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।