ড্রোন কৌশলে আসছে পরিবর্তন


  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ০৪ আগস্ট ২০২১, ১৪:৫৪

বিশ্বের অনেক দেশই এখন সশস্ত্র ড্রোন প্রযুক্তি এবং কৌশল রপ্ত করেছে। এ কৌশল ব্যবহার করেই ড্রোন শক্তির দেশগুলো প্রতিপক্ষের সামরিক টার্গেটে কার্যকরভাবে হামলা করতে পারে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা পদাতিক সৈন্যের বিকল্প হিসেবে ড্রোনের ব্যবহার বাড়িয়েছিলেন। এরপর বিগত কয়েক বছর ধরেই মার্কিন ড্রোন কৌশলে নানা ধরনের পরিবর্তন ও বিবর্তন এসেছে। অন্যান্য দেশগুলোও মার্কিন ড্রোন কৌশল থেকে অনেক কিছু শিখেছে এবং নিজেদের মতো করে ড্রোন ব্যবহারের কৌশল প্রণয়ন করেছে।

মার্কিনিরা সবচেয়ে কার্যকর ও ব্যাপকভাবে ড্রোন ব্যবহার করেছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানে। তালেবান ও অন্যান্য গোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণের জন্য মার্কিনিরা অনেক বেশি নির্ভর করেছিল প্রিডেটর সিস্টেমের ওপর। তবে, মার্কিনিরা যে কারণেই ড্রোন ব্যবহার করুক না কেন, ড্রোনের হামলায় নিহতদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যকই ছিল বেসামরিক নাগরিক। এমনকি নারী ও শিশুদের অনেকেই ড্রোন হামলায় নিহত হওয়ায় মার্কিন ড্রোন অভিযান বিশ্বজুড়ে সমালোচনার শিকার হয়। ২০০৪ থেকে ২০১৯ সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে অন্তত ৬ হাজার ৭৮৬ বার ড্রোন হামলা চালায়। এতে প্রায় ১২ হাজার ১০৫ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হন।

আফগানিস্তানের একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে মার্কিন ড্রোনের আক্রমণ এবং তাতে অসংখ্য বেসামরিক আফগান নাগরিক নিহত হওয়ার পর ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। ড্রোন ব্যবহার করাটা মার্কিনিদের জন্য বেশ বিপজ্জনক পরিণাম নিয়ে আসে। এ ঘটনার পর থেকে আফগান নাগরিকদের মধ্যে তুমুল হতাশা ও ক্রোধ জন্ম নেয়। নতুন করে প্রচণ্ড মার্কিন বিদ্বেষী মনোভাব সৃষ্টি হয়। ফলে, বিপুল সংখ্যক আফগান নাগরিক তালেবান বাহিনীতে যোগ দেয়।

মানবাধিকার কর্মীরাও মার্কিনিদের ড্রোন ব্যবহারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে। প্রেসিডেন্ট ওবামাকেও ড্রোন কিলার হিসেবে সর্বত্র চিত্রায়িত করা হয়। এ ঘটনার এত বছর পর অনেকটা স্বেচ্ছায় এবং প্রকাশ্যে মার্কিন সেনাদের আফগান মাটি থেকে প্রত্যাহার করতে হয়। দিন শেষে ড্রোনের ব্যর্থতাই প্রতীয়মাণ হচ্ছে।

দেখা গেছে, মার্কিন ড্রোনের হামলায় যদি একজন তালেবান সেনা মারা যেত, তাহলে সে পরিবারের এবং ওই অঞ্চলের আরো অনেক মানুষ নতুন করে প্রতিশোধ নিতে তালেবান বাহিনীতে যোগ দিত। এভাবে তালেবানদের সাথে স্থানীয় আফগান নাগরিকদের সখ্যতা গড়ে ওঠে। তালেবানদের বিরুদ্ধে বারবার ড্রোন ব্যবহারের এ কৌশল শেষ পর্যন্ত মার্কিনিদের জন্য বুমেরাং হয়েছে।

এরপর আসা যাক সিরিয়ায় ড্রোনের ব্যবহার নিয়ে। আমেরিকানরা আফগানিস্তানের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সিরিয়ায় কৌশল পাল্টায়। আফগানিস্তানের সাথে তুলনা করলে দেখা যাবে, সিরিয়ায় মার্কিন ড্রোন কৌশল পুরোপুরি ব্যর্থ হয়নি। বরং তারা সেখানে বেশ কিছুটা লক্ষ্য অর্জন করতে পেরেছে। মার্কিন ড্রোনের ঝুঁকি ও ক্ষতির মাত্রাও কমে এসেছে।

সিরিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নিনজা বোমাও ব্যবহার করেছে। সিরিয়ার এ বোমা ব্যবহারে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি। নিনজা বোমাগুলো এমন বোমা যেখানে ৬টি উড়ন্ত ব্লেড আছে। এ বোমাগুলো খুবই কার্যকর। যেগুলো সঠিকভাবে প্রতিপক্ষকে হামলা চালাতে পারে। ফলে বেসামরিক নাগরিক হত্যার ঝুঁকিও অনেকটা কমে আসে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরও বেশ কিছু টার্গেটেও সফলভাবে হামলা চালিয়েছে। এই কৌশল ব্যবহার করে সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ গঠন প্রকৃতিই অনেকটা পরিবর্তন করে দিয়েছে। সুনির্দিষ্ট হামলাকে কেন্দ্র করে যুদ্ধরত গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। সিরিয়ায় আল নুসরার কয়েকজন শীর্ষ নেতা ড্রোন হামলায় মারা গেলে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে উঠে।

কট্টরপন্থী ব্যক্তিদেরকে হত্যা করে এবং নবীনদের ওপর এ হত্যার দায় চাপিয়ে নতুন করে দূরত্ব বৃদ্ধি করে। কুটরাজনীতির এসব কৌশলের সাথে ড্রোনের মতো নতুন প্রযুক্তি যুক্ত হওয়ায় বেসামরিক নাগরিক হত্যার পরিমাণ কমে আসে। এ কারণেই আফগানিস্তানের তুলনায় সিরিয়ায় বেসামরিক নাগরিকের হতাহতের সংখ্যা কমে আসে এবং অনেকটা লক্ষ্যও অর্জন হয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নানা কৌশলে সিরিয়ায় বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে বির্তক সৃষ্টি করেছে। অভ্যন্তরীণ ভারসাম্য নষ্ট করে দিয়েছে। মার্কিনিদের এ কৌশল সিরিয়াতে ব্যাপকভাবে সফল হচ্ছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও অন্যান্য আরও কিছু দেশ অবশ্য ড্রোন নিয়ে ভিন্ন কৌশল ও পরিকল্পনায় অগ্রসর হয়েছে। ড্রোনের বিষয়ে তুরস্কের দৃষ্টিভঙ্গি ও কৌশল মোটামুটি গোছানো। শুধুমাত্র ড্রোনের ওপর নির্ভর না করে তুরস্ক একটি সমন্বিত কর্মকৌশল প্রণয়ন করেছে। ড্রোন, চেক পয়েন্ট এবং স্থানীয় অংশীদারের সহযোগিতা- এসব কিছুকে মিলিয়ে তুরস্ক সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে নিজেদের কৌশল রপ্ত করেছে।

অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, তুরস্ক সাম্প্রতিক কয়েকটি যুদ্ধে ড্রোনের কার্যকর ব্যবহারের মাধ্যমে প্রথাগত যুদ্ধের ধারণায় নতুনত্ব নিয়ে এসেছে। একইসাথে তুরস্ক আসলে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে ড্রোনের ব্যবহারে রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়েছে। মার্কিনিরা যেমন ড্রোনের মাধ্যমে প্রতিপক্ষের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিদের টার্গেট করে হামলা চালিয়েছে। তুরস্কও ঠিক একই কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে উত্তর ইরাকে পিকেকে-র শীর্ষ নেতাদেরকে ড্রোন দিয়েই কাবু করেছে।

চলতি বছরের মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত তুরস্কের ড্রোন হামলায় পিকেকে-র ১৩ জন শীর্ষ নেতা নিহত হয়েছেন। পাশাপাশি, তুরস্ক ড্রোনের সাহায্যে সীমান্তবর্তী এলাকায় অভিযানও পরিচালনা করেছে। সিরিয়া সীমান্তে ড্রোন ব্যবহার করে তুরস্ক দায়েশ, পিকেকে-র সিরিয়া সংস্করণ তথা ওয়াইপিজির বিরুদ্ধে ভালো সফলতা পেয়েছে। এক্ষেত্রে তুরস্কের এমএএম-এল মিউনিশনগুলো অধিক কার্যকর প্রমাণ হয়েছে। এসব ড্রোনে বেসামরিক নাগরিক হতাহতের ঝুঁকিও তুলনাূলক কম। এই ড্রোনগুলো দিয়ে তুরস্ক মূলত প্রতিপক্ষের সামরিক লক্ষ্যবস্তুগুলোকেই টার্গেট করে থাকে।

ড্রোনের পাশাপাশি চেক পয়েন্ট তুরস্ককে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করার ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা দিয়েছে। উত্তর ইরাকে তুরস্ক একাধিক চেকপয়েন্ট চালু করেছে। একইসঙ্গে ড্রোন দিয়ে পিকেকের সম্ভাব্য কার্যক্রমগুলোকে তত্ত্বাবধান ও প্রতিরোধ করারও চেষ্টা করা হয়।

উত্তর ইরাকের এ অঞ্চলগুলো পাহাড়ঘেরা এবং দুর্ভেদ্য। তারপরও চেকপয়েন্ট ও ড্রোনের যৌথ আক্রমণের মুখে পিকেকে খুব বেশি একটা সফলতা পায়নি। তারা তুরস্কের সেনাবাহিনীকেও কার্যকরভাবে মোকাবিলা করতে পারেনি। এমনকি পাল্টা হামলাও করতে পারেনি।

সিরিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মি খুবই সক্রিয়ভাবে আফরিনসহ অনেক এলাকা থেকে ওয়াইপিজি এবং দায়েশকে তাড়িয়ে দিতে তুরস্ককে সহায়তা করেছে। অন্যদিকে, ইরাকে কুর্দিশ আঞ্চলিক সরকার এবং সশস্ত্র বাহিনী পেশমার্গা গোটা এলাকায় পিকেকে সদস্যদেরকে কোণঠাসা করে ফেলে। এতে পিকেকে-র সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়ে। কুর্দিদের মধ্যে এই বিভাজন ও স্থানীয়দের সহযোগিতার কারণে তুরস্ক বেশ কিছু বড় ধরনের সফলতা পেয়েছে।

সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে ড্রোন অভিযান দিয়ে সফলতা পেতে হলে স্থানীয় শরিক সংগঠনগুলোর সহায়তা অপরিহার্য। শুধুমাত্র তাদের কাঠামো ও ঘাঁটির ওপর বোমা নিক্ষেপ করে কার্যকর সফলতা পাওয়া যাবে না। স্থানীয়ভাবে কোনো শক্তিশালী কাঠামো তৈরি না হলে এসব সংগঠন সামরিক অভিযানে সাময়িকভাবে ধরাশায়ী হলে আবারও লোক রিক্রুট করে নতুন করে সামনে আসার সুযোগ পায়।

তবে, স্থানীয় সংগঠন বা বাহিনীদের মধ্যে কাকে বন্ধু বা সহযোগী হিসেবে নেওয়া হচ্ছে, তা বাছাই করা সহজ নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দায়েশকে মোকাবেলা করতে গিয়ে যেভাবে ওয়াইপিজির ওপর ভরসা রেখেছিল, তা তেমন একটা কাজে আসেনি। বিশেষ করে, রাককা এবং দেইর ইজ্জর এলাকায় ওয়াইপিজির কোনো গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করা যায়নি। ফলে ওয়াইপিজিকে কাজে লাগিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়া থেকে দায়েশকে পরাভূত করতে পারেনি।