যে যুদ্ধবিমান নিয়ে মার্কিন রাজনীতিতে বিভক্তি


  • আহমেদ বায়েজীদ
  • ৩০ জুলাই ২০২১, ১৫:৫৮

যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনী চাইছে তাদের বহরে থাকা এ-টেন ওয়ারথগ যুদ্ধবিমানকে অবসরে পাঠাতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যুগের বিমানটির পরিচালনা যেমন ব্যয়বহুল, তেমনি এটি ধীরগতির এবং পুরনো দিনের প্রযুক্তিসম্বলিত। কিন্তু দেশটির রাজনীতিকরা বিমানবাহিনীর এই প্রস্তাব আটকে দিয়েছেন। এর আগেও অনেকবার বিমানটিকে সার্ভিস থেকে সরিয়ে দিতে চাইলেও বিভিন্ন কারণে তা আটকে গেছে।

প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও চান ওয়ারথগ বিমানগুলোকে অবসরে পাঠাতে। কারণ, এগুলোর পেছনে এত খরচ হচ্ছে যে, সেই অর্থ অনায়াসে বিমান বাহিনীকে আধুনিকায়নে কাজে লাগানো যাবে। কিন্তু বাইডেন প্রশাসনের প্রস্তাবিত প্রতিরক্ষা বাজেট উত্থাপনের পরই তার দল ডেমোক্র্যাট দলীয় পার্লামেন্ট মেম্বারদের পক্ষ থেকেই বিমানটিকে সার্ভিসে রাখার জন্য প্রস্তাব উঠেছে। আর এদের নেতৃত্ব দিচ্ছে অ্যারিজোনার ডেমোক্র্যাট সিনেটর মার্ক কেলি, যিনি ২০২২ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনেও এই আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চান।

গত দুই দশক ধরেই এ-টেন যুদ্ধবিমানকে অবসরে পাঠাতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনী; কিন্তু এটি নিয়ে আলোচনা জোরদার হওয়ার পর মনে হচ্ছে ডেমোক্র্যাটরা সিনেটে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে কাজে লাগিয়ে সেটি আবারো আটকে দিবে।

আর্থিক কারণে স্থানীয় রাজনীতকদের অনেকে বিষয়টির বিরোধীতা করছেন। কারণ কোন এলাকায় সামরিক বিমান বহর মোতায়েন থাকলে তা ওই এলাকার অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। অ্যারিজোনা অঙ্গরাষ্ট্রের টুকসন এলাকায় ডেভিস-মনথান বিমান ঘাঁটিতে এ-টেন বিমানের একটি বহর মোতায়েন রয়েছে। টুকসনের সাবেক মেয়র থমাস ভলগির বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক খবরে বলা হয়েছে, ওই বিমান বহরটি স্থানীয় অর্থনীতিতে প্রতিবছর অন্তত ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অবদান রাখে। এমনকি ওই অঞ্চলের মানুষের জন্য বড় কর্মসংস্থানের উৎসও এটি।

কারণ একটি বিমান বহরের জ্বালানি তেলসহ এর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রচুর অর্থ খরচ করা হয়, এই বিশাল প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত থাকে অনেক মানুষ। সিনেটর মার্ক কেলি সিনেটের বরাদ্দ কমিটির কাছে লেখা এক চিঠিতে ২০২২ অর্থ বছরে এ-টেন প্রকল্পের ২৭২ মিলিয়ন ডলারের বরাদ্দ পুনর্বহাল করার অনুরোধ জানিয়েছেন। এবং যে বিমানগুলো অবসরে পাঠানোর চিন্তা করা হয়েছে সেগুলোর সংস্কারের জন্য ৬১৫ মিলিয়ন ডলার নতুন বরাদ্দ চেয়েছেন।

১০০ আসনের মার্কিন সিনেটে বর্তমানে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের আসন সমান ৫০টি করে; কিন্তু কোন ভোটাভুটিতে পক্ষে-বিপক্ষে সমান ভোট পড়লে ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস ভোট দেবেন। যেটিকে বলা হয় টাইব্রেকিং ভোট। আর ভাইস প্রেসিডেন্টের ভোটের কারণে ডেমোক্র্যাটদের উত্থাপিত প্রস্তাবই জয়ী হবে।

থমাস ভলগি বলেন, এখানকার সব নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা এ-টেন বিমানকে মার্কিন বিমান বাহিনীর বহরে দেখতে চান। এ-টেন বিমানটি আমাদের নিরপত্তা ও যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যদের রক্ষায় যে দায়িত্ব পালন করছে বিকল্প কোন বিমান না এনে সেটিকে সরানো ঠিক হবে না।

একই আসনের সাবেক সিনেটর জন ম্যাককেইনও এ-টেন বিমানগুলোকে ঘাঁটিতে রাখার পক্ষে ছিলেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। অন্যদিকে মার্কিন বিমান বাহিনী চাইছে এই বিমান বহরটিকে অবসরে পাঠিয়ে সেই অর্থ ঘাঁটিতে বাড়তি জনবল নিয়োগের পেছনে খরচ করতে। এছাড়া হাইপারসনিক অস্ত্র প্রকল্পেও বাড়তি বিনিয়োগের আশা করছে বিমান বাহিনী। সম্প্রতি ইউএস এয়ারফোর্সের লেফট্যানেন্ট জেনারেল ডেভিড নাহোম হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের শুনানিতে বলেছেন, এই বিমানটিকে অবসরে পাঠানো না হলে নতুন বিমানগুলোর জন্য মেকানিক ঘাঁটতি দেখা দেবে।

এ-টেন বিমানটি পুরনোর মডেলের একটি যুদ্ধবিমান। এটি মূলত একটি ফাইটার-বোম্বার। এ ধরণের বিমান ফাইটার হিসেবে তৈরি করা হলেও এটি বোম্বার হিসেবেও কাজ করতে পারে। ফ্রন্ট লাইন সৈন্যদের এয়ার সাপোর্ট দিতে বিমানটি খুবই কার্যকর। যেটি প্রথম মোতায়েন করা হয়েছিল ১৯৭৬ সালে। ভিয়েতনাম যুদ্ধে বিমান বাহিনীর বেশ কয়েকটি বিমান হারানোর পর যুক্তরাষ্ট্র একটি স্পেশালাইজড অ্যাটাক এয়ারক্রাফটের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। ১৯৬১ জুন মাসে তৎকালীন মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ম্যাক নামরা বিমানবাহিনীকে আদেশ দেন দুটি এয়ারক্রাফট ডেভলপমেন্টের, যার একটি হবে লং রেঞ্জ স্ট্রাইক এয়ারক্রাফট আরেকটি বিশেষ ভাবে ফাইটার-বোম্বার মিশনের জন্য। কিন্তু যা তৈরি হলো সেগুলোতে সন্তুষ্ট হতে পারলো না সেনা কর্মকর্তারা। কোনটির পারফরম্যান্স খারাপ, কোনটি বা অত্যধিক ব্যয় বহুল।

এরপর ১৯৬৭ সালে ২১টি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কাছে কম ব্যয়বহুল প্রকল্প নিয়ে পরিকল্পনা চায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। ছয়টি কোম্পানি তাদের পরিকল্পনা জমা দেয়। এরপর ফাইটার-বোম্বারের প্রাথমিক নকশা তৈরির দায়িত্ব দেয়া হয় ফেয়ারচাইল্ড রিপাবলিক নামের বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠানকে। ১৯৭২ সালের মে মাসে নিউ ইয়র্কের কারখানায় তৈরি এ-টেনের প্রথম প্রোটোটাইপ আকাশে ওড়ে। এরপর শুরু হয় নির্মাণ কাজ এবং ১৯৭৫ সালে পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে এর প্রথম বিমানটি আকাশে ওড়ে।

এরপর ফুল স্কেলে এই এয়ারক্রাফটের উৎপাদন শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। এতই দ্রুত যে, প্রতি মাসে গড়ে ১৩টি বিমান সরবরাহ করে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি। ১৯৮৪ সালের মধ্যেই ৭১৫ বিমানটি বিমান তৈরি করতে সক্ষম হয় ফেয়ারচাইল্ড রিপাবলিক। অ্যাটাক এয়ারক্রাফটের শক্তিতে রাশিয়ার চেয়ে পিছিয়ে থাকায় যুক্তরাষ্ট্র দ্রুত এই বিমানটির সংখ্যা বাড়াতে মরিয়া হয়ে ওঠে। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্র এই বিমানটির ওপর এতটাই নির্ভর হয়ে পড়ে যে, দ্রুত অনেকগুলো ঘাঁটিতে এই বিমানের বহর মোতায়েন করা হয়।

কিন্তু সেসব ষাট কিংবা সত্ত্বুরের দশকের কথা। এরপর ফাইটার জেটের প্রযুক্তি অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে। যে কারণে অনেক বারই এই বিমানটিকে অবসরে পাঠানোর আলোচনা উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রে। ২০০৭ সালে মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ঠিক করে ২০২৮ সালের পর আর বিমানটিকে সার্ভিসে রাখা হবে না। পঞ্চম প্রজন্মের স্টেলথ ফাইটার এফ-থার্টি ফাইভের বহর প্রস্তুত হয়ে গেলে এ-টেনকে সরিয়ে নেয়া হবে। পাশাপাশি এম-কিউ নাই রিপার ড্রোনকেও এর বিকল্প হিসেবে চিন্তা করা হয়। কিন্ত স্থল বাহিনীর কমান্ডাররা এ-টেন বিমানের এয়ার সাপোর্টকেই যুদ্ধক্ষেত্রে চান বলে জানিয়ে দেন।

২০১৫ সালের আবার প্রতিরক্ষা বাজেটে অর্থ সাশ্রয়ের কারণ দেখিয়ে বিমানটিকে অবসরে পাঠানোর প্রস্তাব ওঠে। তাছাড়া বর্তমান সময়ে আধুনিক এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের বিপক্ষে এই বিমানটির টিকে থাকা কঠিন হবে বলে মনে করা হয়। কিন্তু বিমানটিতে একই সাথে বিভিন্ন ধরণের বোমা বহন করা যায় আবার এর জন্য লজিস্টিক সাপোর্টও লাগে তুলনামূলক কম। যে কারণে বিমানটিকে অনেকেই সার্ভিসে রাখতে চান।

সিঙ্গেল সিট ও ডাবল ইঞ্জিনের বিমানটি ছোট রানওয়েতেও উড্ডয়ন ও অবতরণে সক্ষম। যে কারণে সব ধরণের এয়ারফিল্ডে এটি ব্যবহারের সুবিধা পেয়ে যায় মার্কিন বিমান বাহিনী। এমনকি সাধারণ রাস্তাও এর রানওয়ে হিসেবে ব্যবহার করা যায়। ৪৫ হাজার ফুট উচ্চতায় এটি উড়তে সক্ষম। তবে বিমানটির গতি তুলনামূলক কম। এর সর্বোচ্চ গতি প্রতি ঘণ্টায় ৫৬০ কিলোমিটার। অবশ্য কম গতির কারণে একটি মাটিতে থাকা টার্গেটে আঘাত হানার ক্ষেত্রে অনেক সুবিধা পায়।

৫৩ ফুট চার ইঞ্চি লম্বা বিমানটির খালি অবস্থায় ওজন ১১ হাজার ৩২১ কেজি। বেশ কয়েক ধরণের বোমা বহন করতে পারে এই ওয়ারথগ। এর মধ্যে রয়েছে আনগাইডেড আয়রন বোমা, সিবিইউ সিরিজের ক্লাস্টার বোমা, পাভওয়ে সিরিজের লেজার গাইডেড বোমা, জয়েন্ট ডিরেক্ট অ্যাটাক মিউনিশন প্রভৃতি। ফ্লেয়ার বোমা, টার্গেটিং পড বিস্ফোরকও বহন করতে পারে এই ফাইটার।

যুদ্ধক্ষেত্রে এ-টেন ফাইটার-বোম্বার প্রথম ব্যবহৃত হয় ১৯৮৩ সালে। ওই বছর ক্যারিবীয় অঞ্চলের দ্বীপদেশ গ্রেনাডায় সামরিক অভিযানের সময় এই বিমানের কাভার নিয়ে দেশটিতে প্রবেশ করে মার্কিন মেরিন সেনারা। তবে মার্কিন মেরিন সেনারা কোন বাধার মুখে না পড়ায় ওই যুদ্ধে বিমানটিকে একটি বোমাও ফেলতে হয়নি। ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধে বিমানটি ফুল স্কেলে যুদ্ধে জড়ায়। ইরাকি বাহিনীর নয়শোর বেশি ট্যাংক, ২ হাজার অন্যান্য সামরিক যান এবং ১২০০ কামান ধ্বংস করে বিমানটি। এছাড়া ইরাকের দুটি সামরিক হেলিকপ্টারও ভূপাতিত হয় এ-টেন ফাইটারের কামানের গোলায়। তবে ওই যুদ্ধে ইরাকের সারফেস টু এয়ার মিসাইলে ভূপাতিত হয় চারটি এ-টেন বিমান। অন্য দুটি আঘাত প্রাপ্ত হয়ে ঘাঁটিতে ফিরতে পারলেও সেগুলো পরবর্তীতে আর আকাশে উড়তে পারেনি। তারপরও সব মিলে উপসাগরীয় ওই যুদ্ধে বিমানটির অপারেশনকে সফল হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়।

যার ফলে বিমানটিকে বদলে ফেলার চিন্তা বাদ দেয় পেন্টাগনের নীতি নির্ধারকরা। বসনিয়া যুদ্ধেও বিমানটির সফলতার পরিচয় দিয়েছে। সার্ব বাহিনীর অনেক সামরিক স্থাপনা ও যানবাহন গুড়িয়ে দিয়েছে এর পাইলটরা। কসভোতে ন্যাটো জোটের সামরিক অভিযানেও এ-টেন ফাইটার-বোম্বার অংশ নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ২০০১ সালে আফগানিস্তানের সামরিক অভিযানের সময় এই বিমানের একটি বহর মোতায়েন করা হয় পাকিস্তানে। সেখান থেকে তারা অংশ নেয় অপারেশন অ্যানাকোন্ডা নামের একটি সামরিক অভিযানে। আফগানিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের দখলে যাওয়ার পর বাগরাম ঘাঁটি থেকে বিমানটি বিভিন্ন এলাকায় তালেবান অবস্থানের ওপর বোমা হামলা চালায়। এছাড়া ইরাক ও লিবিয়ার সামরিক অভিযানে বিমানটি ব্যবহৃত হয়েছে।

তবে বর্তমান সময়ে আধুনিক ফাইটার জেট ও এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের বিপ্লবের কারণে এ-টেন বিমানটি তার কার্যকারিতা হারাবে। এ যাত্রায় সিনেটরদের বাধায় টিকে গেলেও অদূর ভবিষ্যতে এটিকে সার্ভিস থেকে সরিয়ে দিতেই হবে যুক্তরাষ্ট্রকে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের এফ-৩৫-এর পূর্ণাঙ্গ বহর তৈরি হয়ে গেলে পুরনো দিনের এই বিমানটিকে হয়তো জাদুঘরেই পাঠিয়ে দেওয়া হবে।