চীনকে মোকাবিলায় গুয়ামে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রগুদাম


  • আহমেদ বায়েজীদ
  • ২৩ জুলাই ২০২১, ১৪:৪১

যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ড থেকে সাড়ে ১১ হাজার কিলোমিটার দূরের এক ছোট্ট জনপদ গুয়াম দ্বীপ। পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের এই দ্বীপটিকে যুক্তরাষ্ট্র বানিয়েছে এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বড় অস্ত্রগুদাম হিসাবে। এখানে রয়েছে একটি বিমানঘাঁটি এবং একটি নৌঘাঁটি। আছে সাবমেরিন আর যুদ্ধবিমানের বিশাল বহর। স্থাপন করা হয়েছে সর্বাধুনিক এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম।

যুক্তরাষ্ট্র সামরিক বাহিনীর প্যাসেফিক কমান্ডের জয়েন্ট ইন্টেলিজেন্স সেন্টারের সাবেক ডিরেক্টর কার্ল স্কুস্টারের মতে, গুয়াম হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে একটি পার্মানেন্ট এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার বা স্থায়ী বিমানবাহী রণতরী। একটি বিমানবাহী রণতরী যেমন যুদ্ধবিমানের বিশাল একটি বহর নিয়ে সমুদ্রে ভেসে যুদ্ধ করতে পারে। পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে গুয়াম দ্বীপ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তেমনই একটি সম্পদ। যে কারণে যুক্তরাষ্ট্র এই দ্বীপটিকে তার উল্লেখযোগ্য একটি সামরিক ঘাঁটি হিসেবে গড়ে তুলেছে।

দ্বীপটি এমন একটি জায়গায় যেখান থেকে এশিয়া মহাদেশের মূল ভূখণ্ড, অস্ট্রেলিয়া এবং প্রশান্ত মহাসগরীয় ছোট ছোট দ্বীপপুঞ্জের ওপর সহজেই নজর রাখা যায়। পুরো অঞ্চলের ওপর নজরদারি ও গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের জন্য যুক্তরাষ্ট্র এখানে আধুনিক প্রযুক্তির কোনো কমতি রাখেনি।

পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের মাইক্রোনেশিয়া অঞ্চলের একটি দ্বীপ গুয়াম। দ্বীপটির আয়তন ২১০ বর্গমাইল। জনসংখ্যা ১ লাখ ৬৮ হাজার প্রায়। গুয়ামের রাজধানী হাগান্ত। মাইক্রোনেশিয়া এবং ওশেনিয়া অঞ্চলে সবচেয়ে বড় দ্বীপ গুয়াম। এর অবস্থান মেরিনা আইল্যান্ডের সর্ব দক্ষিণে । এটি মেরিনা চেইনের অংশ।

ফার্ডিনান্ড মেগালান নামের পর্তুগিজ নাবিক সর্বপ্রথম গুয়াম দ্বীপে আসেন। পর্তুগিজ হলেও ফার্ডিন্যান্ড চাকরি করতেন স্পেনে। স্পেনের রাজার অনুরোধে নাবিক ফার্ডিনাল্ড স্পেনের হয়ে বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করেছেন। ফার্ডিন্যান্ডের আগমনের পর প্রায় সাড়ে তিনশ বছর এ দ্বীপ ছিল স্পেনের দখলে। ১৮৯৮ সালে স্পেন-আমেরিকা যুদ্ধে স্পেনের পরাজয়ের ফলে এ দ্বীপ দখল করে যুক্তরাষ্ট্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে গুয়াম দ্বীপের দখল নেয় জাপান। ১৯৪৪ সালে সেটি আবার উদ্ধার করে যুক্তরাষ্ট্র।

সামরিক ও রাজনৈতিক কারণে গুয়াম খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূখণ্ড। যে কারণে এই ছোট দ্বীপটিকে যুক্তরাষ্ট্র বেশ গুরুত্ব দিচ্ছে। মার্কিন বিমান বাহিনীর ইন্দো প্যাসিফিক কমান্ডের প্রধান জেনারেল কেনেথ উইলসব্যাকের মতে, সারা বিশে^র মধ্যে গুয়াম কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূখণ্ড। এবং এটি আমাদের সবচেয়ে পূর্ব দিকের ভূখণ্ড যেখান থেকে দ্রুত যে কোনো সামরিক প্রয়োজনে সাড়া দেয়া যাবে।

ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চল দিয়ে নৌপথে পরিচালিত হয় বিশ^ বাণিজ্যের ৪৪ শতাংশ। এই বাণিজ্যের একটি বড় অংশ যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের। যে কারণেও এই অঞ্চলটির সমুদ্র পথ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আবার যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যে কয়েকটি দেশের সামরিক উত্তেজনা ও প্রতিযোগিতা চলছে, তার মধ্যে উত্তর কোরিয়া ও চীন এই অঞ্চলে। এই দুটি দেশের কাছ থেকে সব সময়ই সামরিক হুমকিতে থাকে যুক্তরাষ্ট্র।

চীন থেকে গুয়ামের দূরত্ব ৪ হাজার ৭৫১ কিলোমিটার। উত্তর কোরিয়ার রাজধানী পিয়ং ইয়ং থেকে এর দূরত্ব ৩ হাজার ৪শ কিলোমিটার। যে কারণে এই দুই প্রতিপক্ষের ওপর নজর রাখা এবং যে কোনো পরিস্থিতিতে তাদের সাথে মোকাবেলার জন্য গুয়াম যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ন। এই অঞ্চলে মিত্র দেশগুলোর সাথে মহড়া, তাদের প্রশিক্ষণসহ অনেক কিছু যুক্তরাষ্ট্র গুয়াম থেকে নিয়ন্ত্রণ করে।

দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের সময় ১৯৪৪ সালে জাপানি সেনাদের হটিয়ে পুনর্দখল করার পর যুক্তরাষ্ট্র এখানে স্থাপন করে এন্ডারসন বিমান ঘাটি। এখানে যুক্তরাষ্ট্র আর্মির যেসব স্থাপনা রয়েছে তার মধ্যে রয়েছে- গুয়াম নৌঘাঁটি, এন্ডারসন বিমান ঘাটি, কোস্ট গার্ড সেক্টর, অর্ডন্যান্স এনেক্স, নেভাল কম্পিউটার এন্ড টেলিকমিউনিকেশন্স স্টেশন, জয়েন্ট ফোর্স হেডকোর্য়াটার্স, গুয়াম ন্যাশনাল গার্ড। এছাড়া রয়েছে সাবমেরিন স্কোয়াড্রন, নেভাল স্পেশাল ওয়ারফেয়ার ইউনিট ওয়ান। যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসেফিক কমান্ড, প্যাসেফিক নৌবহর, সপ্তম নৌবহর এবং ৩০তম নেভাল কনস্ট্রাকশন রেজিমেন্টের কেন্দ্র গুয়াম দ্বীপ।

২০১৭ সালে উত্তর কোরিয়ার হুমকির পর জানা যায়, গুয়াম দ্বীপের নৌঘাঁটিতে পরমাণু শক্তিচালিত ৪টি ফাস্ট এটাক সাবমেরিন ও দুটি সাবমেরিন টেন্ডার রণতরী রয়েছে। অ্যাটাক সাবমেরিনগুলো থেকে দূর পাল্লার পারমাণবিক মিসাইল ও টর্পোডো ছোড়া যায়। গুয়াম দ্বীপে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য সংখ্যা সাত হাজারের উপরে। এদের প্রায় সবাই নৌ এবং বিমান বাহিনীর। এছাড়া আছে স্পেশাল ফোর্সের একটি ইউনিট।

গুয়ামে যুক্তরাষ্ট্র ঠিক কী পরিমাণ সমরাস্ত্র মজুদ করেছে তার সঠিক বিবরণ কখনো প্রকাশ করা হয় না। ধারণা করা হয় যুক্তরাষ্ট্র তার সব ধরণের শক্তিশালী অস্ত্র এখানে রেখেছে। জেনারেল কেনেথ উইলসব্যাক বলেন, এই দ্বীপ থেকে আমরা যে পরিমাণ ফায়ার পাওয়ার জোগান দিতে পারবো তা অবিশ^াস্য। প্রয়োজনীয় সব কিছুই এখানে মজুদ রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, এখানকার বিমানঘাঁটিতে দুটি রানওয়ে রয়েছে যার একেকটি বিশাল। এছাড়া পার্কিং এরিয়াসহ সব কিছু পর্যাপ্ত। গোলাবারুদ মজুদ করার জায়গাটিও বিশাল। কাজেই এটি একটি পর্যাপ্ত বিমানঘাঁটি।

অস্ত্র, গোলাবারুদ ছাড়াও গুয়াম দ্বীপে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিমান, সাবমেরিন ও যুদ্ধজাহাজের জ¦ালানীসহ প্রয়োজনীয় সব কিছুরই রয়েছে বিশাল মজুদ। কোনো কারণে যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডের সাথে পরিবহন ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেলেও যাতে এই ঘাঁটি অনেক দিন কার্যক্রম চালাতে পারে সে দিকটি চিন্তা করেই এখানে এসব আয়োজন করা হয়েছে। একই অঞ্চলে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি থাকলেও বিকল্প হিসেবে গুয়াম দ্বীপকেও প্রস্তুত রেখেছে ওয়াশিংটন। অন্য একটি দেশের ঘাঁটি থেকে যুদ্ধ করতে হলে সেই দেশের সম্মতির প্রয়োজন রয়েছে। দেশটি যুদ্ধ না চাইলে ওই ঘাঁটি থেকে লড়াইয়ে নামা সম্ভব নয়। এ কারণটিও গুয়ামে বিশাল রণপ্রস্তুতির নেপথ্যে কাজ করছে।

জেনারেল কেনেথ উইলসব্যাক বলেন, প্রতিটি স্বার্বভৌম দেশের নিজস্ব প্রতিরক্ষা নীতি রয়েছে এবং সেই নীতিকে সম্মান জানাতেই হবে; কিন্তু গুয়াম থেকে সেনা মুভ করাতে আমাদের কোনো কিছুর জন্যই অপেক্ষা করতে হবে না। ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলে যে কোনো যুদ্ধে গুয়াম দ্বীপ হবে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ পরিচালনার প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। যুক্তরাষ্ট্রের মুল ভূখণ্ড থেকে অনেক দূরের এই ঘাটিটি ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধেও ব্যবহার করা হয়েছে। ইন্দো- প্যাসেফিক অঞ্চলে যে কোনো যুদ্ধে এই দ্বীপটি যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ সক্ষমতা বহুগুন বাড়িয়ে দিবে।

গুয়াম দ্বীপের অ্যান্ডারসেন বিমানঘাঁটিতে মোতয়েন আছে এফ-২২ র‌্যাপটর ফাইটার জেটের বিশাল একটি বহর। এছাড়া আছে এফ-১৬ ফাইটার। আর বি-১বি ল্যান্সার, বি-টু স্প্রিট কিংবা বি-৫২ বোম্বারগুলোর মধ্যে থেকে পালা করে অনেকগুলো রাখা হয় গুয়ামে। এছাড়া গত বছর গুয়াম থেকে মহড়া চালিয়েছে পঞ্চম প্রজন্মের সর্বাধুনিক এফ-৩৫ ফাইটার।

এখনো গুয়াম দ্বীপের ঘাঁটিতে এই বিমানটি মোতায়েন করা না হলেও অদূর ভবিষ্যতে এর একটি বহর দেখা যাবে এখানে। গুয়ামে আছে সামরিক হেলিকপ্টারের একটি স্কোয়াড্রন। গুয়াম বিমানঘাঁটিতে আছে বিশাল দুটি রানওয়ে। যার কারণে এখান থেকে অল্প সময়ে অনেকগুলো যুদ্ধবিমান অপারেশনে নামতে পারবে।

উত্তর কোরিয়া হামলার হুমকি দেওয়ার পর গুয়ামের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমেও উন্নতি করা হয়েছে। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে এখানে বসানো হয়েছে থাড নামের অত্যাধুনিক মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম। টার্মিনাল হাই অলটিচ্যুড এরিয়া ডিফেন্স বা থাড গুয়ামের দিকে উড়ে আসে ট্যাকটিক্যাল বালেস্টিক মিসাইল সনাক্ত ও পাল্টা মিসাইল ছুড়ে আকাশে ধ্বংস করতে পারবে।

যুক্তরাষ্ট্র মনে করছে রাশিয়া, চীন, উত্তর কোরিয়াসহ ওই অঞ্চলের বৈরী দেশগুলো চাইলেই গুয়ামকে টার্গেট বানাতে পারে। যে কারণে গুয়ামের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের দিকে নজর দেয় ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন। আপাতত একটি থাড ব্যাটারি বসানো হলেও এই সংখ্যা বাড়তে পারে নিকট ভবিষ্যতে। এছাড়া এখানে লকহিড মার্টিনের তৈরি এজিস ব্যালেস্টিক মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম মোতায়েনের বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে মার্কিন সামরিক বাহিনীতে। এই ডিফেন্স সিস্টেমটি স্থাপন করলে সেটি পুরো দ্বীপকে ৩৬০ ডিগ্রি কাভারেজ দিতে পারবে বলে মনে করা হয়।