তুরস্ক কীভাবে শীর্ষ সমরাস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ


  • মেহেদী হাসান
  • ১৯ জুন ২০২১, ১৩:৩৭

তুরস্ক বিশ্বের ১৩তম সমরাস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ। বিশ্বের শীর্ষ ১০০টি সমরাস্ত্র শিল্পের তালিকায় রয়েছে তুরস্কের সাতটি প্রতিষ্ঠানের নাম। ২০২০ সালে তুরস্ক ২ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার সমরাস্ত্র রপ্তানি করেছে। ২০২৩ সাল নাগাদ এটিকে ১০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্য। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের ব্যক্তিগত ইচ্ছা এবং পরিকল্পনার কারণে মাত্র ১০ বছরে তুরস্ক সমারস্ত্র শিল্পে উন্নতি করেছে। পরিণত হয়েছে অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশে। তুরস্ককে সমরাস্ত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার লক্ষ্যে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান গ্রহণ করেছেন বিশেষ পরিকল্পনা। বিনিয়োগ করেছেন ৬০ বিলিয়ন ডলার।

তুরস্ক বর্তমানে বিশ্বে অন্যতম সমরাস্ত্র উৎপাদনকারী দেশ। তুরস্ক আর্মির নিজস্ব প্রয়োজন পূরণ ছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সমরাস্ত্র রপ্তানি করে দেশটি। তুরস্ক আর্মির ৭০ ভাগ সিস্টেম বর্তমানে স্থানীয়ভাবে তৈরি হয়।

সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে তুরস্কে রয়েছে অনেকগুলো বিশ্বমানের সমরাস্ত্র তৈরি প্রতিষ্ঠান। তুরস্কের সবচেয়ে বড় সমরাস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হলো আসেলসান। এটি একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। বিশ্বের শীর্ষ ১০০টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এর অবস্থান ৪৮তম।

অন্যান্য সরকারি সমরাস্ত্র প্রতিষ্ঠান হলো- প্রেসিডেন্সি ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রিজ, রকেটসান, তার্কিশ অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ।

তুরস্কে আন্তর্জাতিক মানের বেসরকারি সমরাস্ত্র প্রতিষ্ঠান হলো- এফএনএসএস, বিএমসি এবং নুরুল মাকিনা। এছাড়া রয়েছে হাভেলসান, টুবিটাক, বেকার, অটেকার-এর মতো নামকরা প্রতিষ্ঠান।

তুরস্ক যেসব সমরাস্ত্র রপ্তানি করে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- প্রশিক্ষণ বিমান, ড্রোন বিমান, হেলিকপ্টার, মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্ক, মিডিয়াম ব্যাটল ট্যাঙ্ক, অ্যান্টি ট্যাঙ্ক ভিহিক্যালসহ বিভিন্ন ধরনের আরমারড ভিহিক্যাল, কমব্যাট ভিহিক্যাল, পিস্তলসহ বিভিন্ন ধরনের ক্ষুদ্রাস্ত্র।

যুক্তরাষ্ট্রের ডিফেন্স নিউজের খবরে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালে তুরস্ক ২ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলারের সমরাস্ত্র পণ্য রপ্তানি করেছে। কোভিডের কারণে ২০২০ সালে তুরস্কের সমরাস্ত্র রপ্তানি ১৭ ভাগ কমেছে। ২০২০ সালে তুরস্ক ২ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার মূল্যের সমরাস্ত্র পণ্য রপ্তানি করেছে।

২০২০ সালে তুরস্কের শীর্ষ সমরাস্ত্র রপ্তানি বাজার ছিল যুক্তরাষ্ট্র। ২০২০ সালে তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রে ৭৮৪ মিলিয়ন ডলার মূল্যের অস্ত্র বিক্রি করেছে। এ বছর তুরস্কের দ্বিতীয় সমরাস্ত্র পণ্য বিক্রির দেশ ছিল আজরাবাইজান। তুরস্ক আজারবাইজানের কাছে ২৬১ মিলিয়ন ডলার মূল্যের অস্ত্র বিক্রি করেছে ২০২০ সালে।

তুরস্কের আরেকটি বড় অস্ত্র বিক্রির দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত। ২০২০ সালে তুরস্ক আবুধাবির কাছে ২০০ মিলিয়ন ডলার অস্ত্র বিক্রি করেছে। এছাড়া পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, কাতারসহ আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, দূরপ্রাচ্য এবং ন্যাটো সদস্য দেশেও চাহিদা রয়েছে তুরস্কের বিভিন্ন অস্ত্রের।

স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্স ইনস্টিউট বা সিপ্রির তথ্য অনুসারে ২০১০ থেক ২০১৯ সালে তুরস্কের সমরাস্ত্র রপ্তানি ২৪০ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। তুরস্কের সমরাস্ত্র শিল্প এই উন্নতি হয়েছে গত ১০ বছরে। ২০১০ সালে বিশ্বের শীর্ষ ১০০টি সমরাস্ত্র প্রতিষ্ঠানের তালিকায় তুরস্কের মাত্র ১টি প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল। ১০ বছরের মাথায় তা বেড়ে ৭টিতে পরিণত হয়েছে। বিশ্বের শীর্ষ ১০০ সমরাস্ত্র প্রতিষ্ঠানের তালিকায় ইসরাইল, রাশিয়া, জাপান এবং সুইডেনের চেয়েও বর্তমানে তুরস্কের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেশি।

যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ডিফেন্স নিউজ ম্যাগাজিন প্রতি বছর বিশ্বের শীর্ষ সমরাস্ত্র প্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রকাশ করে। তুরস্কের যে সাতটি প্রতিষ্ঠান ‘ডিফেন্স নিউজ টপ ১০০’ তালিকায় স্থান পেয়েছে সেগুলো হলো আসেলসান, তার্কিশ অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ বা টিএআই, বিএমসি, রকেটসান, এসটিএম, এফএনএসএস এবং হাভেলসান।

২০২০ সালে প্রকাশিত শীর্ষ ১০০ সমরাস্ত্র প্রতিষ্ঠানের তালিকায় তুরস্কের আসেলসানের অবস্থান ৪৮ তম এবং তার্কিশ অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্টিজ-এর অবস্থান ৫৩তম।

নিজস্ব সমরাস্ত্র শিল্পে উন্নতির কারণে ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালে তুরস্কের সমরাস্ত্র আমদানি ৪৮ ভাগ কমে গেছে আগের ৫ বছরের তুলনায়। তুরস্ক সমরাস্ত্র শিল্প আরো উন্নতির জন্য বিভিন্ন প্রকল্পে ৬০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে।

বিশ্বের ২২টি দেশ বর্তমানে সশস্ত্র ড্রোন নির্মাণ করে। তুরস্ক তার মধ্যে অন্যতম। তুরস্ককে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশের ক্ষেত্রে বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে ড্রোন প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় সফলতা।

তুরস্কের সমরাস্ত্র শিল্পের আজকের অবস্থানের পেছনে রয়েছে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের স্বাধীন, দৃঢ পররাষ্ট্রনীতি এবং পরিকল্পনা। তুরস্ককে সমরাস্ত্রে শিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা এরদোয়ানের লক্ষ্য। তুরস্কের সমরাস্ত্র শিল্প উন্নতির লক্ষ্যে ২০১৮ সলে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এক ডিক্রি জারি করে আন্ডার সেক্রেটারি অব ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রি নিজের অধীনে নিয়ে আসেন এবং এর নাম পরিবর্তন করে রাখেন প্রেসিডেন্সি অব ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রিজ। এরদোয়ানের ইচ্ছা এবং পরিকল্পনা তুরস্কের সমরাস্ত্র শিল্প উন্নতির পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে।

রাশিয়া থেকে এস-৪০০ মিসাইল সংগ্রহ, ভূমধ্য সাগরের জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ আহরণ, লিবিয়াসহ আফ্রিকায় প্রভাব বিস্তারের মতো বিভিন্ন ইস্যুতে তুরস্ক স্বাধীনভাবে পথা চলার নীতি গ্রহণ করেছে। আর এক্ষেত্রে তুরস্ককে সহায়তা করছে দেশীয় সমরাস্ত্র শিল্পের উন্নতি।

তুরস্কের সবচেয়ে বড় সমরাস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান আসেলসানের আয় ২০২০ সালে ২৪ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২০ সালে প্রতিষ্ঠানটি ২ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার মুল্যের সমরাস্ত্র বিক্রি করে। নেট মুনাফা ছিল ৬৩০ মিলিয়ন ডলার।

করোনা সত্ত্বেও ২০২০ সালে আসেলসান ৪৫০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের সমরাস্ত্র বিক্রির চুক্তি করেছে। ১৯৭৫ সালে প্রতিষ্টিত আসেলসানের বিশ্বের ১২টি দেশে শাখা রয়েছে। এয়ার ডিফেন্স এন্ড মিসাইল সিস্টেম, রাডার এন্ড ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার, কমিউনিকেশন এন্ড ইনফরমেশন টেকনোলজি, আনম্যানড সিস্টেম, কমান্ড এন্ড কন্ট্রোল সিস্টেম পভৃতির তৈরির সাথে জড়িত আসেলসান।

প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বলেছেন, ২০২৩ সালের মধ্যে তুরস্কের নিজস্ব তৈরি প্রথম বিমান হ্যাঙ্গার থেকে বের হবে।

চলতি বছর প্রথম চার মাসে যুক্তরাষ্ট্রে তুরস্কের ডিফেন্স এবং এভিয়েশন সামগ্রী রপ্তানি ৫৬ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রে পিস্তলসহ বিভিন্ন ধরনের ক্ষুদ্রাস্ত্র বিক্রি করে । এ বছর প্রথম চার মাসে তুরস্ক ৯৪৯ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলারের সমরাস্ত্র বিক্রি করেছে যার মধ্যে ৩৮৬ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে।

তুরস্ক যত পিস্তল রপ্তানি করে তার ৭৫ ভাগ বিক্রি করে সিস কোম্পানী। এ প্রতিষ্ঠানের পুরস্কার বিজয়ী পিস্তলের নাম কানিক । যুক্তরাষ্ট্রে কানিক পিস্তল রপ্তানী এ বছর প্রথম চার মাসে দ্বিগুন বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বব্যাপী যেসব কোম্পানী যুক্তরাষ্ট্রে পিস্তল বিক্রি করে তার মধ্যে তুরস্কের এ প্রতিষ্ঠানের অবস্থান চতুর্থ।

তুরস্কের সিস বিশ্বের ৬৮টি দেশে পিস্তল বিক্রি করে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র তাদের সবচেয়ে বড় মার্কেট।

করোনা শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্রে তুরস্কের সেমি অটোমেটিক পিস্তল, সেমি অটোমেটিক রাইফেল এবং শটগান বিক্রির পরিমানও বেড়েছে। ২০২০ সালের প্রথম চার মাসের তুলনায় ২০২১ সালে প্রথম চার মাসে যুক্তরাষ্ট্রে তুরস্কে ক্ষুদ্রাস্ত বিক্রির পরিমান দ্বিগুন বৃদ্ধি পেয়েছে।

তুরস্কের নিজস্ব তৈরি মিনি বিমানবাহী রণতরী আনাদুল এ বছরই সার্ভিসে যুক্ত হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। তুরস্ক উদ্ভাবন করছে হেলিকপ্টার ইঞ্জিন। তাদের রয়েছে নিজস্ব তৈরি প্রশিক্ষণ এবং লাইট এটাক বিমান। বর্তমানে তারা উদ্ভাবনের পথে রয়েছে টিএফ-এক্স নামক ফিফথ জেনারেশন স্টেলথ ফাইটার। মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্কসহ তুরস্ক তাদের স্থল বাহিনীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ সমরাস্ত্র নিজেরা তৈরি করে। তুরস্কের রয়েছে নিজস্ব তৈরি বিভিন্ন ধরনের শক্তিশালী রণতরী। ড্রোন বিমান নির্মাণের ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্যের পর এবার তারা সফল পরীক্ষা চালিয়েছে শক্তিশালী আনম্যানড সারফেস ভেসেলের।

তুরস্কের সমরাস্ত্র শিল্প এবং সমরাস্ত্র রপ্তানির ক্ষেত্রে সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের অবনতি। তুরস্ক ২০১৮ সালে পাকিস্তানের কাছে দেড় বিলিয়ন ডলার মূল্যের ৩০টি এটাক হেলিকপ্টার বিক্রির চুক্তি করে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বাধার কারণে তুরস্ক এসব হেলিকপ্টার এখন পর্যন্ত ডেলিভারি দিতে পারেনি।

কাতারও তুরস্ক থেকে ১০০ মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্ক কেনার চুক্তি করেছে। এটি তুরস্কের সবচেয়ে বড় অস্ত্র বিক্রি চুক্তি। তুরস্ক জার্মানির সহায়তায় নির্মাণ করে আলটে নামক মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্ক। কিন্তু জার্মানির অসহযোগিতার কারণে তুরস্ক এসব ট্যাঙ্কও সময়মতো নির্মাণ করতে পারছে না।

তুরস্ক গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সমরাস্ত্রের ইঞ্জিনের ক্ষেত্রে বিদেশী প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল। এটি তুরস্কের সমরাস্ত্র শিল্পের বিকাশের ক্ষেত্রে এখন বড় বাধ। বিভিন্ন দেশ থেকে তুরস্ক অসহযোগিতা এবং বাধার শিকার হচ্ছে। তুরস্ক চেষ্টা করছে ইঞ্জিনের ক্ষেত্রে পরনির্ভরশীলতা কাটিয়ে উঠে নিজেইরা হেলিকপ্টার, ট্যাঙ্কসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সমরাস্ত্রের ইঞ্জিন তৈরির।

সিরিয়ায় তুরস্কের কুর্দি বিরোধী অভিযানের ফলে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ অবরোধ আরোপ করে তুরস্কের ওপর। এতে ক্ষতির মুখে পড়ে তুরস্কের সমরাস্ত্র শিল্প।

আফ্রিকাসহ সারা বিশ্বে চাহিদা বাড়ছে তুরস্কের ইমপ্রোভাইজ এক্সপ্লোসিভ ডিভাইসের আরমারড ভিহিক্যালের।

বেসরকারি এফএনএসএস, অটোকার, বিএমসি এবং নুরুল মাকিনা তৈরি করে রপ্তানিযোগ্য বিভিন্ন ধরনের আরমারড ভিহিক্যাল।

সমরাস্ত্র রপ্তানির সাথে সাথে তুরস্ক বিভিন্ন দেশের সাথে যৌথ সমরাস্ত্র নির্মাণ এবং প্রযুক্তি সরবরাহেও অবদান রাখছে। কাজাখস্তান, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, আজারবাইজান, ইন্দানেশিয়ার সাথে তুরস্কের যৌথ সমরাস্ত্র শিল্প রয়েছে।