এশিয়ায় সামরিক প্রভাব বাড়াবে যুক্তরাষ্ট্র


  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ১৪ জুন ২০২১, ১৬:০৩

যুক্তরাষ্ট্র অন্যান্য সঙ্ঘাতময় অঞ্চল থেকে সরে এসে এশিয়ায় সামরিক পর্যবেক্ষণ ও প্রভাব বাড়াতে চাইছে। প্রায় এক যুগ ধরে পূর্ব এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন সেনা মোতায়েন বাড়ছে। বদলে যাওয়া বিশ্ব পরিস্থিতি ও ক্ষমতার রাজনীতিতে চীনের আকস্মিক উত্থানের কারণেই যুক্তরাষ্ট্রকে এশিয়ার প্রতিরক্ষা কৌশলের বিষয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগ জানাচ্ছে, বহির্বিশ্বে মার্কিন সেনা মোতায়েনে বড় আকারের পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। কোল্ড ওয়ারের সময় ইউরোপের নানা দেশে মার্কিন সেনা মোতায়েনের পরিমাণ অনেক বাড়ানো হয়েছিল। ২০০০ সাল পর্যন্ত মার্কিন সেনাবাহিনীর সর্ববৃহৎ ব্যাটেলিয়নগুলো মোতায়েন ছিল জার্মানিতে। আর সবচেয়ে কম সংখ্যক সেনা মোতায়েন ছিল উত্তর আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ এশিয়ায়। নাইন ইলভেনের ঘটনার পর মার্কিন সামরিক কৌশলে ফোকাস পরিবর্তন হয়ে মধ্যপ্রাচ্যে চলে আসে। এ সময় শুধু ইরাক ও আফগানিস্তানেই ১ লাখের বেশি মার্কিন সেনা নিয়োজিত করা হয়। সর্বশেষ ১০ বছরে এশিয়ায় মার্কিন সেনা মোতায়েনের এ গতি অব্যাহত থাকে।

বিশ্বের সামরিক পরাশক্তির হিসাবেও অনেকটা পরিবর্তন এসেছে। একসময় সাবেক সেভিয়েত ব্লকে যেসব দেশের রমরমা অবস্থা ছিল, এ সকল দেশের ৫০ শতাংশ সামরিক শক্তিই এতদিনে নিঃশেষ হয়ে গেছে। এ দেশগুলোর সমরাস্ত্রগুলোও সেকেলে হয়ে পড়েছে। এ দেশগুলোর জায়গায় এখন এশিয়ার কিছু দেশ চলে এসেছে। এমনকি ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনের মতো দেশও গত এক যুগে তাদের সামরিক সক্ষমতা প্রায় ৪০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি করেছে। অন্যদিকে ভারতের সামরিক সক্ষমতা বেড়েছে ১৫ শতাংশ। এশিয়ার দেশগুলোর সামরিক খাতে ব্যয়ও অনেক বেড়েছে।

বিশ্বের নব্য সামরিক পরাশক্তি চীন অগ্রসর হচ্ছে অনেক ভেবেচিন্তে। চীন আগের তুলনায় সামরিক বাহিনীর সদস্যসংখ্যা কিছুটা কমিয়েছে। কিন্তু তারা মনোযোগ দিয়েছে সামরিক হার্ডওয়্যার নির্মাণে। এ খাতে বাজেট বাড়ানো হয়েছে। বেইজিং যুদ্ধবিমানের সংখ্যা অনেকটা বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। জাপানের হাতে থাকা যুদ্ধবিমান ও মার্কিন ঘাঁটিতে যত বিমান রয়েছে, তার সবগুলো এক করলে যে সংখ্যা দাঁড়ায়, এককভাবে চীনের বিমান সংখ্যা তার চেয়ে অনেক বেশি।

চীন নিজেদের মতো করে অসংখ্য মিসাইল ও সাবমেরিনও তৈরি করেছে। এ মুহূর্তে চীনের সেনাবাহিনীর হাতে ৯৫০টি মাঝারি পাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইল রয়েছে। অথচ ১৯৯৫ সালে চীনের কাছে স্বল্প পাল্লার মাত্র ৫০টি ব্যালিস্টিক মিসাইল ছিল। আর ২০১৯ সালে এসে চীনের হাতে স্বল্প দূরত্বের ব্যালিস্টিক মিসাইলের সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার। সামরিক কৌশল ও সমরাস্ত্র খাতে চীনের এই অপ্রতিরোধ্য উত্থান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। এরই প্রতিক্রিয়ায় মার্কিন নীতি নির্ধারকরা ইউরোপ থেকে সামরিক ফোকাস সরিয়ে এনে এশিয়ার ওপর নির্ধারণ করতে চাইছেন।

প্রায় দুই যুগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্য নিয়েই বেশি ব্যস্ত ছিল। আর এ সময়ে চীনের দিকে যথেষ্ট নজর দিতে পারেনি। এ সুযোগ নিয়ে চীনরা নিজেদের সামরিক বাহিনীকে আধুনিকায়ন করার মতো সময় পেয়ে যায়। চীন এখন যে কোনো হিসেবেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিপজ্জনক প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিতে পরিণত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যস্ততা আর চীনের আধিপত্য বিস্তারে এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবে ঘাটতি দেখা দেয়। যুক্তরাষ্ট্র এই ঘাটতি এখন পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। চীন এবং চীনের মিত্রদের কাউন্টারে নতুন একটি অবস্থান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আবার এশিয়ায় আধিপত্য তৈরি করতে চাইছে।

২০২১ সালের এপ্রিলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট এবং জাপানের প্রধানমন্ত্রী একটি যৌথ বিবৃতিতে তাইওয়ান প্রণালীতে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার কথা বলেছিলেন। তাইওয়ানের বিষয়ে জাপান ও মার্কিনিদের এ মনোভাব চীনের সাথে পুরনো দুরত্বকে যেন নতুন করে সামনে নিয়ে আসে। জাপান ও মার্কিন নীতি নির্ধারণী মহল সে সময়ে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব নিয়েও আলোচনা করেন। এ বৈঠক থেকে মার্কিন কর্তৃপক্ষ জাপানের পক্ষে তাদের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে। পাশাপাশি, জাপানের সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং জাপানের সাথে সহযোগিতামূলক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখার বিষয়েও দুই দেশের নেতারা একমত হন।

জাপান-মার্কিন বন্ধুত্ব ও তাইওয়ান নিয়ে চীনের দৃষ্টিভঙ্গি যে বদলায়নি তা পরিস্কার। দক্ষিণ চীনা সাগরে চীন গত কয়েক বছরে তাদের টহলদারি ও অন্যান্য সামরিক তৎপরতা বাড়িয়েছে। চীনকে মোকাবেলা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও ভারত মিলে কোয়াদ নামের যে জোটটি তৈরি করেছে চীন তা ভালোভাবে গ্রহণ করেনি।

চীন মনে করছে, সমুদ্রসীমার মালিকানা নিয়ে তারা যে দাবি করে আসছে, তাকে কাউন্টার দেয়ার জন্যই কোয়াদ নামের জোটটি করা হয়েছে। চীন আরো বিশ্বাস করে বিগত বছরগুলোতে অর্থনৈতিক ও সামরিক খাতে চীন যেভাবে সমৃদ্ধ হয়েছে তা মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়েই যুক্তরাষ্ট্র চীনবিরোধী মিত্রজোটগুলো গঠন করছে।

অনেক বিশ্লেষক মনে করেন চীনকে ঘিরে এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতা মোকাবিলায় চীন এ অঞ্চলের ছোট দেশগুলোর সাথে নিবিড় সর্ম্পক গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। এ ক্ষেত্রে দেশটি অর্থনৈতিক সামর্থ্যকে কাজে লাগাচ্ছে। পাকিস্তান, নেপাল ও বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর সাথে চীনের অর্থনৈতিক ও সামরিক সর্ম্পক জোরদার হচ্ছে। এরমধ্যে পাকিস্তান চীনের পরীক্ষিত ও পুরানো মিত্র। বাংলাদেশের সাথে চীনের সর্ম্পক বেশ ঘনিষ্ট। বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি সমরাস্ত্র কিনে থাকে চীন থেকে। এদিকে আফগানিস্তান ঘিরেও চীনের তৎপরতা বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য প্রত্যাহারের পর আফগানিস্তানে চীন আরো বেশি সম্পৃক্ত হতে পারে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য প্রত্যাহারের পর সেখানে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে বলে চীন শঙ্কা প্রকাশ করেছে। তবে পাকিস্তান ও আফগানিস্তান হয়ে ইরান পর্যন্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য চীন বেশ সক্রিয় রয়েছে।

সম্প্রতি ইরানে ৪০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে। এই বিনিয়োগের বড় একটি অংশ ব্যয় হবে বন্দর ও অবকাঠামো নির্মাণে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন গণমাধ্যমে এমন খবর এসেছে, ইরানে চীনা বিনিয়োগ সুরক্ষার জন্য সেখানে চীনা সৈন্যদের উপস্থিতি থাকতে পারে। এছাড়া আগামী দিনে সমরাস্ত্র কেনার ক্ষেত্রে ইরান যে চীনকে বেছে নেবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

এশিয়ায় এই ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনকে সামনে রেখে কোয়াড গঠনের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে তৎপর হয়ে উঠেছে। ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার মতো দেশগুলোর সাথে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরক্ষা সহযোগিতা জোরদার করার উদ্যোগ নিয়েছে। এছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার ছোট দেশগুলোর সাথে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা নিয়ে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যার অন্যতম লক্ষ হচ্ছে এসব দেশের ওপর চীনের প্রভাব কমানো।