হাইপারসনিক গতির বিমান নির্মাণের পথে চীন


  • মেহেদী হাসান
  • ০৯ জুন ২০২১, ১৪:২৪

অবিশ্বাস্য দ্রুত গতির হাইপারসনিক বিমান নির্মাণ করতে যাচ্ছে চীন। দুই ঘণ্টারও কম সময়ে পৃথিবীর যে কোনো দূরবর্তী এয়ারপোর্টে পৌঁছানো যাবে এ বিমানের সাহয্যে। রাজধানী বেইজিংয়ে চীন স্থাপন করেছে হাইপারসনিক উইন্ড টানেল। এ টানেলে শব্দের চেয়ে ৩০ গুণ বেশি বা ম্যাক ৩০ গতিতে ফ্লাইট সিমুলেট করতে সক্ষম। শব্দের চেয়ে ৩০ গুণ গতি মানে এক ঘণ্টায় ২৩ হাজার কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে।

শুনতে সায়েন্স ফিকশন বা কল্পকাহিনী মনে হলেও বাস্তবে সত্য খবর। বেইজিংয়ে চীনের হাইপারসনিক উইন্ড টানেলের মাধ্যমে প্রযুক্তির বিভিন্ন ক্ষেত্রে চীন পশ্চিমাদের তুলনায় কয়েক দশক এগিয়ে যাবে।

বেইজিংয়ে নির্মাণ করা হয়েছে দুটি হাইপারসনিক উইন্ড টানেল। প্রথমটির নাম জে-১২ এবং দ্বিতীয়টির নাম জেএফ-২২। জেএফ-২২ হাইপারসনিক উইন্ড টানেল ম্যাক- ৩০ গতিতে ফ্লাইট সিমুলেট করতে সক্ষম। দুটি হাইপারসনিক উইন্ড টানেলের মাধ্যমে চীন এখন উদ্ভাবনের চেষ্টা করছে হাইপারসনিক গতির বিমান। কোনো বস্তুর গতি শব্দের চেয়ে ৫ গুণ বেশি হলে তাকে হাইপারসনিক গতি বলে।

চাইনিজ একাডেমি অব সায়েন্স এর গবেষক হান গিলাই বলেন, এ দুটি হাইপারসনিক উইন্ড টানেল মিলিতভাবে চীনকে অন্যান্য শক্তিশালী দেশের তুলনায় ২০ থেকে ৩০ বছর সামনে নিয়ে যাবে।

হাইপারসনিক উইন্ড টানেল বা ফিউচারিস্টিক অ্যারোস্পেস টেকনোলজির সাহায্যে নির্মিত হাইপারসনিক গতির বিমান বিশ্বের যেকোনো স্থানে দুই ঘণ্টা বা তার চেয়েও কম সময়ে পৌঁছানো সম্ভব হবে। এর ফলে সাধারণ মানুষের জন্য স্পেস বা মহাকাশ ভ্রমন সহজ হয়ে যাবে। কারন হাইপারসনিক গতির বিমানে ভ্রমন খরচ প্রচলিত অন্যান্য বিমানের তুলনায় ৯০ ভাগ কম হবে ।

চীনের হাইপারসনিক উইন্ড টানেল টেকনোলজি বিমান ছাড়া বিভিন্ন সমরাস্ত্রেও ব্যবহার করতে পারবে।

উচ্চ গতি সৃষ্টির জন্য চীন মেকানিক্যাল কম্প্রেসর এর পরিবর্তে ক্যামিক্যাল এক্সপ্লোসন ব্যবহার করেছে।

শকওয়েভ সৃষ্টির জন্য রেগুলার গ্যাস স্টোভের তুলনায় ১০ কোটি গুণ বেশি গতিতে জ্বালানি পোড়ানো হয় জেএফ-২২ উইন্ড টানেলে।

যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাধুনিক হাইপারসনিক উইন্ড টানেলের নাম লার্জ এনার্জি ন্যাশনাল শক টানেলস বা লেন্স-২। যুক্তরাষ্ট্রের লেন্স-২ টানেলে ম্যাক- ৩ থেকে ম্যাক- ৯ পর্যন্ত গতিতে ফ্লাইট সিমুলেট করতে সক্ষম।

জাপান এবং জার্মানিওর হাই এনথালপি শক টানেল রয়েছে।

চীনা বিশেষজ্ঞ হান গিলাই জানান, যুক্তরাষ্ট্রের উইন্ড টানেল ফ্লাইট সিমুলেশন ৩০ মিলিসেকেন্ড পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। আর চীনা উইন্ড টানেল জেএফ-২২ ফ্লাইট সিমুলেশন ১৩০ মিলিসেকেন্ড পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। হাইপারসনিক প্রযুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় চীনের অভিজ্ঞতা বেশি । চীন আশা করছে যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় বড় এবং আধুনিক হাইপাসনিক এয়ারক্রাফট নির্মাণ করতে পারবে।

চীনের লক্ষ্য ২০৫০ সাল নাগাদ চীনা আর্মিকে যুক্তরাষ্ট্রের সমকক্ষ করা বা ছাড়িয়ে যাওয়া। একই সাথে ওয়ার্ল্ড ক্লাস আর্মিতে পরিণত করা। চীন হাইপারসনিক প্রযুক্তির পেছনে বিপুল অর্থ এবং সময় ব্যয় করেছে। রাশিয়া ছাড়া একমাত্র চীনের কাছে বর্তমানে রয়েছে হাইপারসনিক মিসাইল। চীনা মাঝারি পাল্লার হাইপারসনিক ব্যালিস্টিক মিসাইলের গতি ম্যাক-১০ বা শব্দের চেয়ে ১০ গুণ। রাশিয়ার কাছে রয়েছে শব্দের চেয়ে ২৭ গুণ বেশি এভানগার্ড হাইপারসনিক মিসাইল। কোনো বোমা বহন ছাড়াই চীনা একটি ডিএফ-১৭ মিসাইলের আঘাতে পৃথিবীর যে কোনো শক্তিশালী বিমানবাহী রণতরী ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।

১৯৬৭ সালের ৩ অক্টোবর প্রথম ১ লাখ ২ হাজার ১০০ ফিট বা ৩১ মাইল উপরে ওঠে একটি বিমান। রেকর্ড এ উচ্চতায় ওঠার পর ঘণ্টায় ৪ হাজার ৫০২ মাইল বেগে উড়ে চলে বিমানটি। বিমানটির এ ওড়ার গতি ছিল শব্দের চেয়ে ৬ দশমিক ৭ গুণ বেশি বা ম্যাক-৬ দশমিক ৭।

বিশ্বে আজ পর্যন্ত এত দ্রুত গতিতে আকাশে উড়তে সক্ষম হয়নি পাইলটযুক্ত কোনো বিমান। এ বিমানটির নাম নর্থ আমেরিকান এক্স-১৫। বিমানটি পরবর্তীতে ৬০ মাইলের বেশি উচ্চতায় উঠেছে । তবে হাইপারসনিক নর্থ আমেরিকান এক্স-১৫ বিমানটি ছিল রকেট চালিত এবং এর রেকর্ড গতি ও উচ্চতায় আরোহন ছিল পরীক্ষামূলক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মোট ৩টি এ ধরনের বিমান নির্মাণ করে এবং ১৯৬৮ সালে এসব বিমান অবসরে পাঠানো হয় ।

রকেট ইঞ্জিন ছাড়া বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুততম বিমান হলো যুক্তরাষ্ট্রের লকহিড মার্টিন নির্মিত এসআর-৭১ ব্ল্যাকবার্ড। ব্ল্যাকবার্ডের সর্বোচ্চ গতি ম্যাক- ৩ দশমিক তিন দুই। তীব্র গতির কারনে সারফেস টু এয়ার মিসাইল এর আক্রমন এড়িয়ে যেতে পারত এ বিমান। ১৯৬৬ সালে এ বিমান সার্ভিসে যুক্ত হয় এবং ১৯৯৮ সালে অবসরে পাঠানো হয়। নাসা এবং যুক্তরাষ্ট্র এয়ার ফোর্স ব্যবহার করে এ বিমান। যুক্তরাষ্ট্র মোট ৩২টি ব্ল্যাকবার্ড নির্মাণ করে।

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের দুটি বিমান নির্মাণ কোম্পানী সুপারসনিক যাত্রীবাহী বিমান নির্মাণের চেষ্টা করছে। এ দুটি সংস্থা হলো বুম সুপারসনিক এবং আরিয়ন। নেভাদাভিত্তিক আরিয়ন গত মার্চে সুপারসনিক যাত্রীবাহী বিমান তৈরির পরিকল্পনা পেশ করেছে। এই বিমান হবে ৫০ আসনের এএস-৩ নামক ম্যাক- ৪ প্লাস গতির।

আরিয়ন ৮ থেকে ১২ আসনের এএস-২ নামক সুপারসনিক যাত্রীবাহী বিমান তৈরি করছিল। সম্প্রতি আরিয়ন জানায় আর্থিক কারনে তাদের এ বিমান তৈরির প্রকল্প পিছিয়ে গেছে। ২০২৩ সালে এ বিমান নির্মাণ শুরুর কথা ছিল। সিএনএন এর প্রতিবেদনে আরিয়নের এ ঘোষনাকে হতাশাজনক আখ্যায়িত করেছে। ২০০২ সাল থেকে তারা সুপারসনিক জেট নির্মাণের কাজ করে আসছিল। এএস-২ সুপারসনিক বিমানের সম্ভাব্য গতি নির্ধারণ করা হয়েছিল ম্যাক ১দশমিক ৪।

আরিয়ন সুপারসনিক বিমান নির্মাণ প্রকল্প অর্থের কারনে পিছিয়ে গেলেও বুম সুপারসনিক কোম্পানী অব্যাহত রেখেছে তাদের সুপারসনিক বিমান নির্মাণ। বুম সুপারসনিক যে বিমান নির্মাণ করছে তার নাম ওভারটিউর। এর গতি শব্দের চেয়ে ২ দশমিক ২ গুণ বেশি বা ম্যাক ২ দশমিক ২। ২০২০ সালের অক্টোবরে উন্মুক্ত করা হয়েছে এর প্রোটেপাইট যার নাম এক্সবি১।

যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি নতুন এ সুপারসনিক বিমানের গতি বর্তমানে দ্রুততম যাত্রীবাহী বিমানের চেয়ে তিনগুণ বেশি। নতুন এ সুপারসনিক বিমানে মাত্র ৪ ঘণ্টায় পৌঁছানো যাবে বিশ্বের যে কোনো দূরবর্তী এয়ারপোর্টে। আর এর ভাড়া হবে মাত্র ১০০ ডলার।

২০২৬ সাল নাগাদ আকাশে উড়তে যাচ্ছে বুম সুপারসনিক। এর যাত্রী ধারণ ক্ষমতা হবে ৬৫ থেকে ৮৮ জন। সুপারসনিক এ বিমান নিউ ইয়র্ক থেকে লন্ডন যেতে সময় লাগবে ৩ ঘণ্টা ১৫ মিনিট। লস এঞ্জেলস থেকে সিডনি যেতে এখনকার তুলনায় সময় কম লাগবে সাড়ে আট ঘণ্টা।

২০০৩ সালে অবসরে যায় ব্রিটিশ-ফরাসী সুপারসনিক যাত্রীবাহী বিমান কনকর্ড। কনকর্ডের গতি ছিল ম্যাক ২ দশমিক শুণ্য চার। অতিরিক্ত ব্যয় আর অতিরিক্ত শব্দের ফলে পরিবেশের প্রতি হুমকির কারনে বন্ধ হয়ে যায় ব্যাপক উৎসাহী আর আলোচিত কনকর্ড। ১৯৭৬ সালে অবসরে পাঠানো হয় বিশ্বের বহুল আলোচিত প্রথম যাত্রীবাহী সুপারসনিক কনকর্ড। মোট ২০টি এ বিমান নির্মাণ করা হয়েছিল।

বুম সুপারসনিকের নির্মাতা বুম টেকনোলজি। এর ইঞ্জিন সংখ্যা হবে তিনটি। নতুন বুম সুপারসনিক বিমানটি ১৯৯ ফিট লম্বা। দুই পাশে থাকবে এক আসনের সারি। চলতি বছরই এর ফ্লাইট টেস্ট করার কথা রয়েছে।

মাত্র ৪ ঘণ্টায় এবং স্বল্প খরচে বিশ্বের যে কোনো দূরবর্তী গন্তব্যে পৌঁছতে সক্ষম হওয়ায় ভবিষ্যতে এ বিমান নিয়ে অনেকে আশাবাদী। বুম সুপারসনিক প্রধান নির্বাহী ব্লেক জানান, বর্তমানে তারা এ বিমান নির্মাণের জন্য ৬ বিলিয়ন ডলারের অগ্রিম অর্ডার পেয়েছেন।