আবুধাবিতে চীনা সামরিক বিমান


  • মেহেদী হাসান
  • ০৮ জুন ২০২১, ১৫:০৪

চীনের দুটি সামরিক বিমান কয়েকদিন আগে অবতরণ করেছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের একটি এয়ারপোর্টে। বিমান থেকে নামানো হয়েছে বোঝাই করা অনেক বাক্স। এ ঘটনা ধরা পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দাদের কাছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্লেষকদের মতে, বাক্সে থাকতে পারে অস্ত্র ও প্রযুক্তিপণ্য। সংযুক্ত আরব আমিরাত চীনের সাথে সামরিক এবং প্রযুক্তিগত সম্পর্ক বৃদ্ধি করেছে। সামরিক বিমান অবতরণের ঘটনা এর সর্বশেষ নজির। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আরব আমিরাতের সর্ম্পক জটিল রূপ নিয়েছে।

বাইডেন প্রশাসন সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছে ৫০টি এফ-৩৫ ফাইটার জেটসহ ২৩ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি করতে রাজি হলেও চীনের সাথে আরব আমিরাতের সামরিক সহযোগিতা যুক্তরাষ্ট্রকে নতুন করে চিন্তিত করেছে। অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে ২৩ বিলিয়ন ডলার অস্ত্র বিক্রি চুক্তির ভবিষ্যৎ। বেইজিংয়ের সাথে আবুধাবির সামরিক সম্পর্ক বৃদ্ধিতে উদ্বিগ্ন যুক্তরাষ্ট্র। ২৩ বিলিয়ন ডলার অস্ত্র বিক্রির ক্ষেত্রে আবুধাবির কাছ থেকে নিরাপত্তা গ্যারান্টি চাচ্ছে ওয়াশিংটন।

এফ-৩৫, ড্রোন প্রযুক্তিসহ যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র প্রযুক্তি চীন বা তৃতীয় কোনো দেশের কাছে যেন হস্তান্তর না হয় সে বিষয়ে নিশ্চয়তা চেয়েছে বাইডন প্রশাসন। এজন্য উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল এরইমধ্যে আবুধাবি সফর করেছে। এছাড়া ইসরায়েলের নিরাপত্তাসহ এসব অস্ত্র ব্যবহারের ওপর বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র।

অপরদিকে আবুধাবিও চাইবে না মূল্যবান অস্ত্র কিনে শর্তের অধীনে ফেলে রাখতে। তারা চাইবে এমন দেশ থেকে অস্ত্র কিনতে যা তারা স্বাধীনমতো ব্যবহার করতে পারবে। ফলে ২৩ বিলিয়ন ডলার অস্ত্র বিক্রি নিয়ে অনিশ্চয়তার পাশাপাশি ওয়াশিংটন-আবুধাবি সম্পর্কের অবনিতও ঘটতে পারে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র শঙ্কিত উপসাগরীয় অঞ্চলে চীনের ধীরে ধীরে প্রবেশ নিয়ে।

ইয়েমেন যুদ্ধের কারণে সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছে ২৩ বিলিয়ন ডলার অস্ত্র বিক্রি চুক্তি স্থগিত করেছিল বাইডেন প্রশাসন। কিন্তু এ সুযোগে সংযুক্ত আরব আমিরাত চীনের দিকে ঝুকে পড়তে পারে এ আশঙ্কায় বাইডেন প্রশাসন ঘোষণা দেয় সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছে ৫০টি এফ-৩৫ ফাইটার জেট, ১৮টি রিপার ড্রোন বিমানসহ ২৩ বিলিয়ন ডলার অস্ত্র বিক্রি চুক্তি পুনরায় বিবেচনা করবে। কিন্তু সর্বশেষ চীনা সামরিক বিমান অবতরণ এবং অজানা বস্তুর বাক্স আনলোডের ঘটনায় পুরো বিষয়টি জটিল রুপ নিয়েছে।

ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে উপসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম মিত্র সংযুক্ত আরব আমিরাত। চীনের সাথে আমিরাতের ক্রমবর্ধমান সামরিক সহযোগিতায় উদ্বিগ্ন যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছ থেকে নিশ্চয়তা চায় তাদের অস্ত্র প্রযুক্তি চীন বা অন্য কোনো দেশের কাছে যাতে না যায়।

অনেক আগে থেকে চীন মধ্যপ্রাচ্যের অস্ত্র বাজারে প্রবেশের চেষ্টা করছে। এ নিয়ে শঙ্কিত যুক্তরাষ্ট্র। মধ্যপ্রাচ্যের অস্ত্র বাজারে চীনের প্রবেশ ঠেকাতেই যুক্তরাষ্ট্র আমিরাতের কাছে অস্ত্র সরবরাহে রাজি হলেও এখন অন্য ইস্যু সামনে হাজির হয়েছ। তা হলো চীনের সাথে আমিরাতের সামরিক সম্পর্ক।

চীন-আমিরাত সম্পর্ক বৃদ্ধি বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে সে বিষয়ে নিয়ার ইস্টার্ণ এফেয়ার বিষয়ক ট্রাম্পের এসিসট্যান্ট সেক্রেটারি ডেভিড শেনকার বলেন, আমিরাতের কাছে এফ-৩৫ বিমান বিক্রি মানে হলো যুক্তরাষ্ট্রের ওপর আমিরাতের এককভাবে নির্ভরতা বোঝায়। এ অস্ত্র সরবরাহের আগে যুক্তরাষ্ট্রকে আরো অনেক কিছু করতে হবে।

চীন চেষ্টা করছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে সম্পর্ক ঘণিষ্ঠ এবং সম্প্রসারণ করতে। ২০২০ সালে চীন বিষয়ে পেন্টাগনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীন যেসব রাষ্ট্রের সাথে সামরিক সম্পর্ক বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো সংযুক্ত আরব আমিরাত।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিষয়ক কয়েকজন কর্মকর্তার মতে চীন আমিরাতে একটি নৌ ঘাটি নির্মানের আশা করছে। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতে কিছু সামরিক স্টাফ পাঠানোর বিষয়ে চীন আমিরাতের সাথে আলোচনা করেছে। উপসাগরীয় অঞ্চলে চীনের সামরিক এবং নিরাপত্তা তৎপরতায় যুক্তরাষ্ট্রের শঙ্কা বেড়েই চলছে। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে একটি অস্ত্র বোঝাই জাহাজ চীন থেকে এডেন উপসাগরের দিকে যাত্রা করে।

এফ-৩৫ এবং ড্রোন বিমান বিক্রি নিয়ে সামনে এগুতে চাইলেও বাইডেন প্রশাসন এখন আমিরাতের কাছে শর্ত আরোপ করতে চাইছে। ট্রাম্প প্রশাসন যেসব শর্তে আমিরাতের কাছে ২৩ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি চুক্তি করেছে তাতে ঘাটতি পেয়েছে বাইডেন প্রশাসন।

অপর দিকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বক্তব্য হলো তারা যদি অন্য দেশের কাছ থেকে অস্ত্র কেনে তাহলে এ অস্ত্র কোথায় কখন কিভাবে তারা ব্যবহার করবে তার সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার তাদের। কিন্তু শর্ত সাপেক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র কিনলে সংযুক্ত আরব আমিরাতের এসব অস্ত্র ব্যবহারের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে না।

কংগ্রেসে ইতোমধ্যে প্রস্তাব আনা হয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত যাতে কোনো অবস্থাতেই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে এফ-৩৫ বিমান ব্যবহার করতে না পারে এবং এসব অস্ত্র বিক্রির কারণে ইসরায়েলের নিরাপত্তা যেন বিঘ্নিত না হয় সে বিষয়ে বাইডেন প্রশাসনকে নিশ্চয়তা অর্জন করতে হবে।

ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের বরাতে জানানো হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র আমিরাতের সাথে আলোচনায় তিনটি বিষয় উত্থাপন করেছে। ইসরায়েলের সামরিক গুনগত শ্রেষ্ঠত বজায় রাখতে হবে, চীনসহ তৃতীয় কোনো দেশের কাছে এফ-৩৫ এবং ড্রোন টেকনোলজি হস্তান্তর করা যাবে না এবং ইয়েমেন, লিবিয়াসহ যেসব অঞ্চলে সংযুক্ত আরব আমিরাত যুদ্ধ করছে সেখানে এ অস্ত্র ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের অন্য আরেক কর্মকতা ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে জানান, সংযুক্ত আরব আমিরাত যদি চীনকে ঘাটি নির্মানের অনুমতি দেয় তাহলে এ অস্ত্র বিক্রির আর কোনো সম্ভাবনা নেই। এটা তাদের পরিষ্কার জানানো হয়েছে।

শুধু সংযুক্ত আরব আমিরাত নয়, চীন সৌদি আরবকেও সহযোগিতা করছে বেসামরিক পারমাণবিক কার্যক্রমে। এতে প্রমাণ হয়, চীন মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে । যা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য উদ্বেগের। ট্রাম্প প্রশাসনের সময় যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক উপস্থিতি কমানোর কাজ শুরু করে। ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে দেশের অভ্যন্তরে অভিযোগ ওঠে রাশিয়া এবং চীন যখন ধীরে ধীরে মধ্যপ্রাচ্যে প্রবেশ করছে যুক্তরাষ্ট্র তখন সেখান থেকে নিজেদের গুটিয়ে আনছে।

সংযুক্ত আরব আমিরাত-চীন সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ নিয়ে আলোচনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিনিধি দল ইতোমধ্যে আবুধাবী সফর করেছেন । হোয়াইট হাউজ, স্টেট ডিপার্টমেন্ট এবং প্রতিরক্ষা বিভাগের সিনিয়র কর্মকর্তারা ছিল এ প্রতিনিধি দলে।

ডেভিড শেনকারের মতে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্ত্র পাওয়ায় অনিশ্চয়তার কারণে আমিরাত বিকল্প হিসেবে চীনের সাথে নিরাপত্তা সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্লেষকদের মতে সংযুক্ত আরব আমিরাত যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা অংশীদার। আল কায়েদা, আইএস বিরোধী লড়াই এবং আফগানিস্তানে সেনা মোতায়েনে আবুধাবি ওয়াশিংটনের সাথে এক সাথে কাজ করেছে। তারা ইসরায়েলের সাথে শান্তি চুক্তি করেছে। কথিত আব্রাহাম একর্ডস স্বাক্ষরকারী দেশ।

আরব উপদ্বীপের সাথে চীনের সম্পর্ক সিল্ক রোডের সাথে। চীন-সংযুক্ত আরব আমিরাত সম্পর্ক শুরু হয় ৩৫ বছর আগে। চীনা প্রেসিডেন্ট এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট ২০১৮ সালে দেশটি সফর করেন। চীনা টেলিকম কোম্পানী হুয়াওয়ে ৫জি প্রোভাইডার হিসাবে উপসাগরীয় অঞ্চলে কার্যক্রম সম্প্রসারণ করেছে।

কোভিড-১৯ ভ্যাক্সিনের জন্য চীনা রাষ্ট্রীয় ফার্মাসিউটিক্যাল ফার্ম সিনোফার্মের অংশীদার হয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। চীনা সরকারি তথ্য অনুসারে গত এক দশকে এসকর্ট মিশন হিসেবে ৩১টি ফ্লিট, ১০০টি রণতরী এবং ২৬ হাজার সৈন্য ও কর্মকর্তা পাঠিয়েছে এডেন উপসাগর এবং সোমালিয়া অফসোর অঞ্চলে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে ধীরে ধীরে যুক্তরাষ্ট্র সরে আসায় এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব বাড়ছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে চীনের বাণিজ্য, প্রযুক্তি এবং বিনিয়োগ সম্পর্ক এর অংশমাত্র।